
নিতির গল্প
উপন্যাস ৩৭
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুন ১৩, ২০২০
আজ মহালয়া। ভোর চারটের সময় নিতিশ বাবু ঘুম থেকে উঠলেন। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। শেফালী দেবী রান্নাঘর থেকে গরম জল করে আনলেন। নিতিশ বাবু গরম জল দিয়ে ভালো করে গা হাত-পা মুছে নিলেন। ঠাকুর ঘরে কাঠের তাকে ধুতি তোলা ছিল। সেটি নামালেন। ঘরে হাঁটাচলার শব্দ পেয়ে নিপু উঠে পড়েছে। লেপের মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে চোখ পিটপিট করছে। কয়েক বছর আগেও এই দিনটাতে নিতি বাড়িতে থাকত। এখন ঢাকা থাকায় আসতে পারে না।
নিতিশ বাবু ধুতি পরে পুরোনো রেডিওটার চ্যানেল পাল্টে আকাশবাণী, কলকাতায় রাখলেন। ঘড়িতে চারটা ত্রিশ বাজে। দীর্ঘ লয়ে শঙ্খ বেজে উঠল। সমবেত কণ্ঠে শিল্পীরা গেয়ে উঠলেন:
যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মূলিনী
যা ধূম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী ।
শক্তিঃ শুম্ভনিশুম্ভদৈত্যদলনী যা সিদ্ধিদাত্রী পরা
সা দেবী নবকোটীমূর্তিসহিতা মাং পাতু বিশ্বেশ্বরী।
নিতিন বাবু শুভ্র বস্ত্র পরে বাইরের বারান্দায় চৌকির উপর বশে আছেন। ঘরের দেয়ালে পিঠ হেলান দেয়া, চোখ নিমীলিত। নিস্তব্ধ ভোরে শুনছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গ্রন্থণায় মহিষাসুরমর্দিনী। দেবী বন্দনা শুরু হয়েছে। দু`হাত কপালে ঠেকিয়ে পূর্বদিকে দেবীর উদ্দেশে প্রণাম করলেন।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ভেসে আসল:
আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।
তন্ময় হয়ে মহিষাসুরমর্দিনী শুনতে শুনতে নিতিশ বাবুর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ভাব সাগরে ডুব দিচ্ছে মন। চোখের সামনে ভেসে উঠছে জগন্মাতা দেবী দূর্গার চিন্ময়ী রূপ। সে রূপ থেকে জ্যোতির বিচ্ছুরণ ঘটছে। অন্ধকার কেটে আলোকিত হয়ে উঠছে বিশ্ব চরাচর। শিল্পী গেয়ে উঠলেন:
বাজলো তোমার আলোর বেণু,
মাতলো যে ভুবন।
আজ প্রভাতে সে সুর শুনে
খুলে দিনু মন।
চণ্ডিপাঠ, দেবীবন্দনা সহযোগে দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে সকাল হয়ে এলো। পূবাকাশ রাঙিয়ে সূর্যদেব উঠে পড়েছেন। সে আলোয় পৃথিবী আলোকময়। নিতিশ বাবু নবগঙ্গা নদীতে পূর্বপুরুষের উদ্দেশে তর্পণ করতে চলেছেন। সহযাত্রী হয়েছে বালক পুত্র নিপু। তার চোখমুখে কৌতূহল। প্রতি বছর এই দিনে বাবা সকালে উঠে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে নদীতে তর্পণ করতে যায়। কেন যায়? আজ বাবার কাছে কারণ জানতে চাইল।
পিতা হাঁটছে। পাশে হাঁটছে পুত্র। পুত্র পিণ্ড দানের কারণ জানতে চাচ্ছে তার পিতার কাছে। সেই পিতা, যাকে সে খুব ভালোবাসে। সেই পিতা, নিয়তির কঠিন পরিহাসে যার মুখাগ্নি করতে হবে তাকেই। এই শিশু বয়সে বালক তার ক্ষুদ্র হৃদয়ে বুঝতেই পারছে না। একদিন এই পিতার উদ্দেশে তাকেই পিণ্ডদান করতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে নদীতে যাবার পথে বালক পুত্রের কৌতূহল দূর করতে নিতিশ বাবু বলে উঠলেন, আমাদের ধর্মে কোনও শুভ কাজ করতে গেলে পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়। তর্পণ মানে খুশি করা। ভগবান শ্রীরাম লঙ্কাজয়ের আগে মহালয়ার তিথিতে এমনই তর্পণ করেছিলেন। সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন, তাঁরা তাঁদের পূর্বপূরুষদের স্মরণ করে, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন।
এ অনুষ্ঠানের নাম মহালয়া হলো কেন বাবা? নিপুর কৌতূহলী মনের দ্বিতীয় প্রশ্ন?
সনাতন ধর্ম অনুসারে, এই দিনে প্রয়াতদের আত্মা মর্ত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আত্মার এই সমাবেশকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। এটি পিতৃপক্ষের শেষ দিন। এ দিন থেকে দেবী পক্ষের শুরু। সনাতন ধর্ম অনুসারে, বছরে একবার প্রয়াত পিতা-মাতার উদ্দেশে পিণ্ড দান করতে হয়। মহালয়ার দিন সেই পিণ্ডদান অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে আহার্য দান করা হয়। জগতের পশুপাখি সেই আহার্য ভক্ষণ করে। যিনি পিণ্ড দান করেন, তিনি এই ভেবে তৃপ্ত হন, তার পূর্বপুরুষেরা পশু-পাখির রূপ ধরে এই খাবার গ্রহণ করবেন।
বাবার সব কথা নিপু বুঝল কি না জানি না, তবে এটুকু বুঝল, বাবা তার ঠাকুরদা, ঠাকুরমার ভালোর উদ্দেশে এই নিয়ম পালন করছেন। মহম্মদপুরের নবগঙ্গার জলে পূর্বপুরুষের উদ্দেশে যেমন তর্পণ হচ্ছে, তেমনি তর্পণ হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। সেই সমুদ্রের ধারে, যার সৈকত লাগুয়া বিলাসবহুল হোটেল কক্ষে রিমি এখনো ঘুমাচ্ছে। গভীর ঘুমে। এই রিমি একজন সেক্সুয়ালি ফ্রাসট্রেটেড ওম্যান। অনেকেই প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর নানাভাবে যৌনতার স্বাদ গ্রহণ করে। রিমির রক্ষণশীল পরিবারে সেসবের সুযোগ হয়নি। বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত সুমনের বহুগামিতা রিমিকে দাম্পত্য জীবনে সুখী করেনি। অবিশ্বাসী করেছে। স্বচ্ছ মানসিকতা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে।
অল্প বয়সে মর্মাহত রিমি এতদিন শুধু বঞ্চিতই হয়নি? জীবনের মানেও খুঁজে পায়নি সে। যৌনতা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের অধিকার। সমাজের নিষ্ঠুর শৃঙ্খল রিমিকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। পুরুষের স্পর্শসুখ পায়নি অনেকদিন। শুভর উদ্দাম আদরে সেই সুখ পেল। পরিপূর্ণ রমণীর জীবন ফিরিয়ে দিল একটি অসংযত রাত। ব্রহ্মমুহূর্তে কাম উত্তেজনা বাড়ে। সারারাতের অবিশ্রাম উন্মত্ততায় ব্রহ্মমুহূর্তে কোনও কিছু টের পাবার সুযোগ হয়নি। ভোরের দিকেই ঘুমে ঢুলে পড়েছে ওদের রাত জাগা চোখ। সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ। ঘুম ভাঙেনি রিমিদের। সকাল সকাল ঘুম ভাঙার কোনও সুযোগও তৈরি হয়নি।
শুটিংয়ের কাজে যারা এসেছে, তারা সময় মতো টাকা পেয়ে যাবে। শুটিং কেন সময়মতো শুরু হচ্ছে না, এটা নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথা নেই। কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ বিচে হাঁটাহাঁটি করছে, কারো চোখে অন্যের সমুদ্র স্নান দেখার দিকেই নিবিষ্ট। এই আলুথালু বেশ কারো কারো উন্মাদ করে তোলে। দৃষ্টিতে বহুগামিতার সুখ সম্ভোগ করে। মানুষ স্বভাবতই বহুগামী। শারীরিকভাবে সম্ভব না হলেও মানসিকভাবে বহুগামিতা কারো পক্ষেই এড়িয়ে চলা সম্ভব হয় না। জাগরণে জোর করে তাকে দমন করার বৃথা চেষ্টা হয় তো করা যেতে পারে? কিন্তু স্বপ্নে? সেখানে কে কাকে বাঁধা দেয়?
চেতন-অবচেতনে মানুষের আসক্ত মন ভালোলাগা মুখগুলোর দিকে চেয়ে থাকে। নিস্তব্ধ দুপুর, কিংবা নির্জণ রাতে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষকে ছুঁতে চায়, আদরে আহ্লাদে ভরিয়ে তুলতে চায়। এটাই জীবন। রিমি এই বল্গাহীণ জীবনের পথে পা বাড়িয়েছে। কক্সবাজার সৈকতে সূর্যোদয় দেখা যায় না। তাতে অবশ্য দর্শনার্থীর ঘাটতি পড়ে না সকালে। বিশেষ বিশেষ দিনে সৈকত উপচে পড়ে মানুষের আগমনে। আজ তেমনি একটা বিশেষ দিন। মহালয়ার পূণ্য প্রভাতে পর্যটক ছাড়াও কক্সবাজার শহরের অনেক পূন্যার্থী এসেছে সমুদ্রে পূণ্য স্নানের উদ্দেশে।
পৃথিবী বড় বিচিত্র। কারো কাছে এই শরীরটাই সব। কারো কাছে এটার কোন দামই নেই। পরকালের উদ্দেশেই তার সমস্ত কাজ। যেটা দেখেনি, সেটার জন্য কত প্রার্থনা, কত আয়োজন। পরকালে বিশ্বাসীদের কাছে জীবন যদি একবিন্দু জল হয়, পরকাল এক সাগর জল। পরকালে অবিশ্বাসীদের কাছে জীবনই সব। জীবন ছাড়া বাকি সব গল্প। পৃথিবী বড় অশ্চর্যের জায়গা। এখানে সবকিছুর দুইটা দিক আছে। নারীর বিপরীতে পুরুষ আছে। রাতের বিপরীতে দিন আছে। আগুনের বিপরীতে জল আছে। ভালোর বিপরীতে মন্দ আছে। তেমনি স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের বিপরীতে অবিশ্বাসীরাও আছে। পরস্পর বিরুদ্ধ ভাব নিয়েই জগৎ। কেউ যেমন শুধু দিন বা শুধু রাত চাইলেও পাবে না।
তেমনি ভালো শুধু ভালো কিংবা মন্দ শুধু মন্দ চাইলেও পাবে না। সেজন্যই পৃথিবীর সব মানুষ স্রষ্টাই বিশ্বাসী হবে এটা ভাবাই বাতুলতা বা প্রকৃতি বিরুদ্ধ ভাবনা। প্রকৃতি চাইছে বিপরীতধর্মী বৈচিত্র। আমরা সেটা না চাইলে প্রকৃতির কিছু এসে যায় না। প্রকৃতি তার কাজ ঠিক চালিয়ে নেয়। তার উদ্দেশ্য ঠিক সফল করে নেয়। তা না হলে, কে ভেবেছিল চালচুলোহীন সামান্য রাধা, সুনন্দের মতো ছেলের হৃদয় নিমিষেই জয় করে নেবে। বাতাস ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না, একে অপরের সুখচিন্তা ছাড়া এরাও তেমন বাঁচছে না। একে অপরের কণ্ঠস্বর দীর্ঘক্ষণ না শুনলে এদের হৃদয় ব্যথায় ভরে যাচ্ছে। এই অসমবয়স্ক দুটি হৃদয় কেন এতো ব্যকুল হলো তা হয়তো তারাও জানে না। যে জানে, সেই সর্বজীবের ঈশ্বর হয়তো দু`জনের হৃদয় সমুদ্রে ডুবে হাসফাস করার এই দৃশ্য দেখে মুচকি হাসছেন। চলবে