নিতির গল্প

উপন্যাস ৪০

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুন ১৭, ২০২০

গাবতলী মাজার রোড থেকে সকাল আটটায় বাস ছিল। বাস ছাড়তে ছাড়তে সকাল সাড়ে আটটা বাজিয়ে দিল। একশো গজ না এগোতেই যানজট শুরু। গাবতলী আমিনবাজার ব্রিজ পার হতে হতেই সকাল নয়টা পার হয়ে গেল। যানজট একনাগাড়ে নবীনগর পর্যন্ত থাকল। বাস যখন নবীনগর পার হলো তখন ঘড়িতে সকাল এগারোটা। দুপুর দেড়টার দিকে গাড়ি আরিচা ফেরিঘাটে গিয়ে পৌঁছাল। বেশ খিদে পেয়ে গেছে নিতির। সকালে তেমন কিছু খেয়ে আসতে পারেনি। সকাল ছয়টার সময় যখন বাসা থেকে বেরিয়েছে তখনো সূর্য তার খোলস থেকে বের হয়নি। শীতকালের সকাল, জায়গায় জায়গায় বেশ কুয়াশা ছিল। ধীরে বাস চলেছে। ইচ্ছে ছিল সময় পেলে গাবতলী থেকে কিছু খেয়ে নেবে। সে সময় পাওয়া যায়নি। সামনে যানজটের যে অবস্থা, বিকালের আগে বাস ফেরিতে উঠতে পারবে না। নিতি কিছু খেতে বাস থেকে নামল।

পাশেই একটা হোটেল দেখা যাচ্ছে। উপরে একচালা টিন। চারিপাশে টিনের বেড়া। হোটেলের পেছনটা অনাবৃত, ঝাঁপ তুলে রাখা। সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে সবুজ ধানক্ষেত, উন্মুক্ত জলাভূমি দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে বাতাস এসে হোটেলে বসা খরিদ্দারবেশী যাত্রিদের তপ্ত শরীর শীতল করে দিচ্ছে। নিতি দুটো রুটি, একটা ডিম ভাজা, এক প্লেট ডালভাজি অর্ডার দিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটা আট-দশ বছরের ছেলে এসে খাবার দিয়ে গেল। এসব হোটেলগুলো শিশুশ্রমের ঊর্বর ভূমি। অনেক মা-বাবা সন্তান জন্ম দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। একটু বড় হলেই নিজের পেট নিজেকেই চালাতে হয়। এমনকি আয় বেশি হলে মা-বাবাকেও তার ভাগ দিতে হয়। চানাচুরঅলা, বাদামঅলা, সিগারেট বিক্রেতা, পানি বিক্রেতা, জুস বিক্রেতা থেকে শুরু করে ব্যাগ বওয়ার কাজটাও শিশুরা নির্বিঘ্নে করে যাচ্ছে।

নিতি একটা জলের বোতল কিনে নিল। এখানের জল অনিরাপদ। খাওয়াটা ঠিক হবে না। এতটুকু খেতেই পঁয়ষট্টি টাকা খরচ হয়ে গেল। সকাল থেকে রিকশা ভাড়া, বাস ভাড়া, খাওয়া হিসাব করলে প্রায় ছয়শো টাকা খরচ হয়ে গেছে। একজন স্টুডেন্টের পক্ষে এটা কম খরচ নয়। নিতি আবার বাসে উঠে বসল। ব্যাগ থেকে হুমায়ুন আজাদের ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ বইটা বের করে নিল। নিতির প্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। হুমায়ুন আজাদের অন্যান্য রাজনৈতিক প্রবন্ধ, কবিতার মতোই তার শিশুসাহিত্যও নান্দনিক। বইটি বহু আগেই পড়া উচিত ছিল। কত কিছুই তো পড়া উচিত ছিল, সব কিছু কী সময় মতো হয়, হয় না? নিতি বইটি পড়া শুরু করল।

যারা জেনেবুঝে পড়াশোনা করে তাদের কাছে হুমায়ূন আজাদ এক আদর্শিক ব্যক্তিত্ব, অনন্য বাঙালি মনিষী। `আব্বুকে মনে পড়ে’ বইটি পড়া যখন শেষ হলো তখন ফেরিতে গাড়ি উঠে গেছে। পরন্ত বিকাল। পূবাকাশে হেলে পড়া সূর্যের লাল-কমলা আভা ফুটে উঠেছে। নদীর বুকে দাঁড়িয়ে অস্তমিত সূর্যটার শেষ রঙ দেখতে বড্ড মনোরম লাগছে। শীতকাল ফেরিতে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগছে। নিতি ওড়নাটা জড়িয়ে নিল।

`আব্বুকে মনে পড়ে` বইটি মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ও দেশ স্বাধীন হবার পরমুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের কাহিনি নিয়ে লেখা এক হৃদয়গ্রাহী গল্পের বই। একটি শিশুর চোখে দেখা, শিশুর মুখে বলা মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখিত হয়েছে এ বইটিতে। এককথায় অভূতপূর্ব বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। অসাধারণ এই বইটি মুক্তিযুদ্ধকে চোখের সামনে তুলে আনে। নিতি বইটি পড়ে অভিভূত, পাঠ মুগ্ধ। ভালো বই পড়লে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তৃপ্ত হয়ে যায় মন। নিতির মন এক ঐশ্বরিক ভালোবাসায় তৃপ্ত হয়ে উঠল।

সন্ধ্যা সাতটার কিছু পরে গাড়ি মাগুরা পৌঁছাল। নিতির বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে গেল। দীর্ঘ চোদ্দ ঘণ্টার জার্নি। অথচ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকলে এতটুকু পথ সাধারণ বাসে চড়েই তিন-চার ঘণ্টায় অনায়াসে চলে আসা যায়। নিতি গ্রামে যাবার বাসে উঠে বসল। গ্রামের বড় রাস্তার মোড়ে বাস এসে থামলে বাস থেকে নেমে পড়ল সে। বাকিটা পথ হেঁটেই যেতে হবে। খুব বেশি পথ না। মাটির রাস্তা দিয়ে দশ মিনিট হাটলেই বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায়। মাটির সরু রাস্তা বেয়ে বাড়ির পথে নিতি পা বাড়াল।

বড় রাস্তা থেকে নামলেই তেমাথার মোড়ে গ্রামের দূর্গামণ্ডপ। আজ পঞ্চমি। প্রতিমা-মণ্ডপের শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জা চলছে। গ্রামের পূজোগুলো প্রতিবছরই অনিশ্চয়তায় থাকে। অর্থের সংকট, দলাদলি, সমন্বয়ের অভাব, নেতৃত্বের অভাব সবমিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই ঢাকে কাঠি পড়ে যায়। তখন তাড়াহুড়ো করে প্রতিমা তৈরি করো, ভেতরের মাটি কাঁচা থাকতেই রঙ করো, শেষমুহূর্তে প্যান্ডেল করো, আলোকসজ্জা করো। এত অনিশ্চয়তার পরেও যখন পূজা হয়, মণ্ডপে মায়ের মুখ আলোয় ঝলমল করে ওঠে, ষষ্ঠী পূজার ঢাক বেজে ওঠে, তখন গ্রামের মানুষের সারা বছরের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

মণ্ডপে মায়ের মুখ দেখে মনের অজান্তেই হাত তুলে একটা প্রণাম করে নিল নিতি। কয়েকজন ছেলে আড়চোখে বিষয়টা লক্ষ্য করলো। ছেলেগুলো নিতির অপরিচিত। বোধহয় প্যাণ্ডেল সজ্জার কাজে এসেছে। বাড়ির উঠানে যখন নিতি পা রাখল তখন মা রান্নাঘরে। আগে থেকেই জানিয়ে এসেছে সে, এখন মোবাইলের যুগে না জানিয়ে আসার কোনও মানেও হয় না। মা মেয়ের জন্য কয়েকটা পদ বাড়িয়ে রান্না করছে। নিতি বাবার সাথে দেখা করতে যাবে এমন সময় দেখল ডা. সুনন্দ বসে আছে বাবার ঘরে। সুনন্দ দা`কে নমস্কার করে নিজের ঘরে চলে এলো নিতি।

সুনন্দ নিতিশ বাবুর প্রাক্তন ছাত্র। প্রতি বছর পূজা শুরুর আগে স্যারকে প্রণাম করতে আসে। এত বড় ডাক্তার হয়ে গেছে, তবুও মনে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। এ বছরটিও তার ভুল হয়নি আসতে। রাধাদের বাড়ি মণ্ডপের পেছনে। ওদের বাড়ি পার হয়েই নিতিশ বাবুদের বাড়ি আসতে হয়। সুনন্দ সদ্য চিনেছে রাধাদের বাড়ি। চাইলে ও বাড়িতেও একটা পা দিয়ে আসতে পারত। চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে সেটা পেরে ওঠেনি। নিতিশ বাবু সুনন্দের কাছে প্রশ্ন করছে, এফসিপিএস তো করছ, পড়াটা শেষ হলে কী করবে ভাবলে?

সুনন্দ একটু চিন্তা করে বলে উঠল, গ্রামে একটা দাতব্য হাসপাতাল করার ইচ্ছে আছে। যেখানে গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা হবে, জানি না পারব কিনা!
পারব কিনা মানে কী? ইচ্ছে থাকলে অবশ্যই পারবে। একবার ভাবো তো। আমার অ্যাক্সিডেন্টের দিন তুমি হাসপাতালে না থাকলে আমার কী হতো? যশোরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, যশোরের ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করে নিতির বন্ধুকে জানান, অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা, সঙ্গে সিস্টার দেয়া, এতকিছু তুমি না থাকলে কে করত? গ্রামে তুমি হাসপাতাল দিলে আমার মতো কত লোকের উপকার হবে।

হ্যাঁ, সেসব ভেবেই তো দিতে চাচ্ছি। কিন্তু দিতে পারব কিনা সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।
সে কী কথা? হ্যাঁ, পারবে না কেন? মানুষের ইচ্ছাশক্তিই তো আসল। ইচ্ছাশক্তি সাক্ষাৎ ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে। ইচ্ছাশক্তির কাছে আর সকল শক্তি তুচ্ছ হয়ে যায়। তুমি বেশ করে কাজে লেগে পড় তো। দেখবে সব সময় মতো হয়ে যাবে।
কিন্তু এত টাকা পাব কোথায়, তাই ভাবছি?
ও তুমি চেষ্টা করলেই পেরে যাবে। দেখ স্বামীজি বলতেন, ‘টাকায় কিছু হয় না, নামেও কিছু হয় না, যশেও কিছু হয় না, চরিত্রে সব হয়। চরিত্রই বাধাবিঘ্নের বজ্রদৃঢ় প্রাচীরের মধ্য দিয়ে পথ করে নিতে পারে।’ তুমি চরিত্রবান ছেলে। তোমার ভয় কিসে? স্বয়ং ঈশ্বর আছেন তোমার সাথে ।

সুনন্দের স্যারের কথাগুলো শুনে খুব ভালো লাগল। স্যারকে প্রণাম করে বাসা থেকে বের হয়ে এল। সুনন্দ চলে যাবার পর নিতি সুনন্দের জলখাবারের প্লেট সরিয়ে কলপাড়ে নিয়ে গেল মাজতে। সুনন্দ নিতিদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে রাধাদের বাড়ির দিকে কয়েক পলক তাকাল। মনের মধ্যে একটা মোচড় দিয়ে উঠল। মানুষ চাইলেও অনেক সময় অনেক কিছু করতে পারে না। একটা অদৃশ্য প্রাচির মানুষের সামনে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে যায়। চলবে