
নিতির গল্প
উপন্যাস ৪২
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুন ১৯, ২০২০
ফেসবুকে শোভনের সাথে দীপের ছবি দেখে নিতি যারপরনাই বিস্মিত! এমন সুন্দর সকালটা রাগে অভিমানে মাটি হয়ে গেল। শোভন দীপের কাজিন। দীপ তো কখনো বলেনি দীপের মাসি থাকে ঢাকাতে। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলে যেমন হয়, নিতির অবস্থা তেমন হলো। নিতি সিদ্ধান্ত নিল, ঢাকায় পৌঁছে রিচির পড়ানোটা ছেড়ে দেবে। রিচির জন্য মন কেমন করতে থাকল। এ ক`দিনে মেয়েটার প্রতি মায়া পড়ে গেছে। তবুও, এখানে আর যাওয়া উচিত হবে না। ভালোবাসা, স্নেহের থেকে আত্মসম্মান বড়। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যেতে দিতে নেই। অন্তত নিজের আত্মসম্মানটুকু আগলে রাখতে হয়। নতুবা নিজের কাছেই নিজে বড় ছোট হয়ে যেতে হয়। নিজেকে নিজে ঘৃণা করার মতো এত বড় শাস্তি বোধহয় পৃথিবীতে আর নেই।
নিতি নিজের মনকে বেশ ভালো করে বোঝাল। কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। মনে যত রক্তক্ষরণই হোক, তাকে পারতেই হবে। না না, কোনোভাবেই আর শোভনদের বাড়িতে তার যাওয়া চলবে না। যে কোনো উপায়ে বন্ধ করতেই হবে। হাজারটা চিন্তা মাথায় নিয়ে, একরকম মন খারাপ করেই নিতি পূজা মণ্ডপে গেল। আজ মহা অষ্টমী। রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজার আয়োজন চলছে। দীপ-লরেটা ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে এসে পৌঁছাল। মন্দির লোকে লোকারণ্য। কোথাও পা ফেলবার জায়গা নেই। মন্দিরে কুমারী পূজার আনুষ্ঠানিকতা দেখতে মানুষের ঢল নেমেছে। হাজার হাজার মানুষ এসে মিলিত হয়েছে মন্দির চত্বরে। ওরা একটু ফাঁকা দেখে মন্দিরের পুকুরধারে এসে দাঁড়াল। মন্দিরের সামনে মাঠ। এই মাঠেই দুর্গামণ্ডপ তৈরি হয়েছে। মণ্ডপের পেছনে সাধু নিবাস। সাধু নিবাসের সাথেই বাঁধানো পুকুর। পুকুরটা বেশ চমৎকার। বাঁধানো সিঁড়িতে ফুলের টব সাজানো। সে টবে শীতের ফুল গাঁদা, ডালিয়া ফুটে রয়েছে। পুকুরে রাজহাঁসের দল খেলে বেড়াচ্ছে। পুকুরের চারিদিকে উঁচু উঁচু আম গাছ। সেসব গাছে পাখির বাসা। ঢাকার বুকে এক টুকরো স্বর্গ যেন।
একজন সাংবাদিক এগিয়ে এল এদিকে। স্বামী গুরুসেবানন্দ, যাকে সবাই মৃদুল মহারাজ নামে চেনে, তিনি পুকুর ধারে দাঁড়িয়েছিলেন। সাংবাদিকটি মহারাজকে পেয়ে প্রণাম করার ভঙ্গিতে মুখ নিচু করে বলে উঠল, প্রণাম মহারাজ।
মহারাজ বলে উঠলেন, প্রণাম। কেমন আছো মুন্নি?
ভালো মহারাজ। আপনি কেমন আছেন?
দেখতেই তো পাচ্ছো। এ ক`দিনে দম ফেলার ফুরসত পাইনি। একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম। তুমি চলে এলে। মহারাজের মুখে হাসি।
সাংবাদিক মুন্নি সাহা আবার প্রশ্ন করে উঠল, মহারাজ, আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন ছিল। নিউজে যাবে, যদি অনুমতি দেন।
কী জানতে চাচ্ছো?
-দর্শকরা পূজা সম্পর্কে সাধারণত যেগুলো জানতে চায় সেসব প্রশ্নই। আপনি অনুমতি দিলে ক্যামেরা অন করতে বলি।
মহারাজ অনুমতি দিলেন। ক্যামেরা অন হলো। সাংবাদিক মুন্নি সাহা প্রশ্ন করে উঠল, মহারাজ, কুমারী পূজা আসলে কী? বাংলাদেশে কবে থেকে কুমারী পূজার আয়োজন চলে আসছে?
মহারাজ তার কৃষ্ণবর্ণ সুন্দর মুখশ্রীর মধ্যে অমূল্য হাসির রেখা টেনে বলে উঠলেন, দেখুন, কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে কুমারী পূজার প্রচলন অনেকটাই কমে গেছে। তবে বাংলাদেশে কিন্তু সূদূর অতীত থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন ছিল। এখন বিভিন্ন শহরে প্রতিষ্ঠিত রামকৃ্ষ্ণ মিশনেই কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে। প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
সাংবাদিক প্রশ্ন করে উঠল, মহারাজ, কুমারী পূজার প্রচলণ কবে থেকে উদ্ভব হয়?
মহারাজ হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠলেন, শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে। গল্পে বর্ণিত রয়েছে, কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সে সকল দেবগণের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবি পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয় বলে আমরা জেনেছি।
মহারাজ কুমারী পূজার জন্য কোন বর্ণের, কোন বয়সের কুমারী মেয়ে বেছে নেয়া হয়?
মহারাজ তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, দেখুন, কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়। এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও পূজনীয়। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেয়ের পূজা করা যায়।` বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। ষোল বছর পর্যন্ত বছর ভেদে পূজিত কন্যার ভিন্ন ভিন্ন নাম হয়। এ বছর যেমন ছয় বছরের কন্যা উমা রূপে পূজিত হচ্ছে।
মহারাজ, ঢাকার আর কোথাও এত সাড়ম্বরে কুমারী পূজা হয় না, এখানেই কেন কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়?
কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো, নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে। তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন। এ কারণেও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতি বছর কুমারী পূজার আয়োজন করে আসছে।
দীপ-লরেটা পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল। মহারাজের সাক্ষাৎকার শেষ হলে সাংবাদিক মুন্নি সাহা চলে গেল। দীপ এগিয়ে গেল মহারাজের দিকে। মহারাজের পায়ে প্রণাম করে বলে উঠল, কেমন আছেন মহারাজ?
মহারাজ আন্তরিক বিস্ময়ে মুগ্ধ নয়নে দীপের দিকে চেয়ে বললেন, আরে তুমি, এখনো যশোর যাওনি তাহলে?
না মহারাজ এখনো যাইনি, তবে আজই যাব, সন্ধ্যার ফ্লাইটে।
একাই যাবে, না সঙ্গে কেউ থাকবে?
আমার কাজিন শোভন থাকবে মহারাজ।
ও বেশ, ভালোই হবে। একজন থাকলে যাত্রা আনন্দের হয়।
লরেটা পাশে দাঁড়িয়েছিল। মহারাজের দিকে তাকিয়ে দীপ বলে উঠল, মহারাজ এ লরেটা, আমার বন্ধু।
বেশ, তোমরা প্রসাদ খেয়ে যেও। আমার একটু কাজ আছে, আমি আসছি, বলে মহারাজ চলে যেতে পা বাড়ালেন। `আচ্ছা মহারাজ, আসুন` বলে দীপ লরেটার দিকে তাকাতেই মহারাজ যেতে যেতে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন, প্রসাদ খেয়ে যেও কিন্তু, না খেয়ে চলে যেও না।
দীপ কণ্ঠস্বর একটু উঁচু করে বলে উঠল, আচ্ছা মহারাজ, খেয়ে যাব।
মন্দির থেকে অষ্টমী পূজার অঞ্জলি দিয়ে এসেও নিতির মন ভালো হলো না। এই মাত্র বাড়ি এসে বসেছে। হঠাৎ বাড়িতে রাধাদের কথা শুনে নিতি যেন চমকে উঠল। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ঘোর কাটতেই বলে উঠল, এই তোরা এসেছিস, আয় আয় ভেতরে আয়। মা দেখ কারা এসেছে। তুমি লুচি মিষ্টি প্লেটে সাজাও আমি আসছি, বলে নিতি রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। রাধারা নিতিদের বাড়ি থেকে অষ্টমীর লুচি মিষ্টি খেয়ে নিতিশ বাবু, শেফালী দেবীকে প্রণাম করে বাড়ি চলে গেল।
রিমি পূজাতে যশোর আসেনি। রমেশ বাবু কয়েকবার ফোন করে ডাকলেও নানান অজুহাতে সেকথা এড়িয়ে গেছে। রিমির মাও অনুরোধ করে করে একপর্যায়ে মেয়ের আশা ছেড়েই বছরকার পুজো শুরু করেছে। রিমির যে দূরসম্পর্কের বোনটা ঢাকায় থাকত, তার সাথেও কোন যোগাযোগ রক্ষা করে না সে। এই নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
এখন সে নিয়মিতই কলেজে যায়। তবে যে জন্য কলেজে যেতে হয়, সে জন্য নয়। তার যাওয়ার কারণ ভিন্ন। শুভর ইয়াবার ব্যবসা। রিমি শুভকে ভালোবেসে ওর ফ্লাটে থাকতে শুরু করলে একে একে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রথমে আসক্তি এরপর ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ল। এখন বুঝতে পারে শুভর কাছে ভালোবাসার কোন স্থান নেই। সবটাই শরীর। আবার শরীর থেকেও বেশি মূল্যবান ওর কাছে টাকা। এখন রিমির যে অবস্থা, তাতে আগের জীবনে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। হয়তো সে আগের জীবনে ফিরে যেতেও চায় না। আগের জীবন মানেই তো সেই একাকিত্ব। সুমনের পরিত্যাক্তা হিসেবে বেঁচে থাকা। চলবে