
নিতির গল্প
উপন্যাস ৪৩
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুন ২০, ২০২০
অষ্টমীর রাত কেটে রৌদ্রময় সকাল এলো। আজ নবমী। আজই পুজোর শেষ দিন। আগামীকাল ভাসান। আগামীকাল বিসর্জন। মনটা ব্যথায় ভরে উঠল নিতির। এক বছরের অপেক্ষা যে পুজোর জন্য, প্রতিমা নিরঞ্জন করে সে পুজো যখন শেষ হয়ে যায়, তখন মনটা ভাড়াক্রান্ত হয়ে যায়। আবার একটা বছরের জন্য অপেক্ষা। আবার আশায় বুক বেঁধে থাকা। প্রতি বছরের মতো এবারও নবমীর দুপুরে খাসির মাংস আর পোলাও রান্না হয়েছে। নিতিদের আত্মীয় পরিজন, পাড়ার সুহৃদ, পারিবারিক বন্ধু-বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। একে একে সবাই আসতে শুরু করল। নিতির মা রান্নাঘরে খাবার গুছিয়ে দিচ্ছে, নিতে অতিথিদের পরিবেশন করছে। নিতিশ বাবু পাশে বসে আছে। অতিথিদের সাথে কথাবার্তা বলছে।
একপর্যায়ে অতিথি সৎকার শেষ হলো। নিতিশ বাবু, নিপু খাবার পর, নিতি ওর মাকে নিয়ে খেতে বসল। আজ পাড়ার অনেকে বাস রিজার্ভ করে ফরিদপুর ঠাকুর দেখতে যাবে। ফরিদপুরের দুর্গাপূজা বিখ্যাত। নিতিও ছোট থাকতে কয়েকবার গেছে। পাড়ার দু`একজন এসেছিল তাদের সাথে যাবার নিমন্ত্রণ করতে। নিতি রাজি হলো না। এখন কী আর সে বয়স আছে? দেখতে দেখতে নবমীর রাত কেটে গিয়ে নতুন সকাল এল। আজ বিজয়া দশমী। দীপ রূপসা নদীতে ভাসান দেখতে এসেছে। দীপের সাথে ওর কাজিন শোভন। শোভনের হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরা। ক্রমাগত ছবি তুলে যাচ্ছে। ওদের সাথে দীপের আরো দশ-বারো জন বন্ধু রয়েছে। সবাই মিলে একটা নৌকা ঠিক করেছে। সে প্রতি বছর এই ভাসান দেখতে ঢাকা থেকে চলে আসে। প্রথম কবে দেখেছিল মনে নেই। আগে মা-বাবা, মাসি-মেসোর সাথে আসতো। এখন দীপ তার সঙ্গী। এবার অবশ্য যশোরে এসেও মাসি-মেসোকে পেল না। ওরা বারাসাত রয়েছে। তাতে কী? অভিভাবক ছাড়া এই বয়সে আনন্দের মাত্রাই আলাদা।
যে রূপসা নদীতে এত আয়োজন, সে রূপসা-পশুর সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বড় নদী। রূপসা মূলত দক্ষিণে মংলা বন্দরের কাছে পশুর নামে প্রবাহিত হয়ে ত্রিকোণ ও দুবলা দ্বীপ দুটির ডান দিক দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। রূপসা নদীর তীরে ফুলতলা বাজার, গিলাতলা, দৌলতপুর ইত্যাদি অবস্থিত। রূপসা ও ভৈরব নদীর সঙ্গমস্থলে খুলনা শহর অবস্থিত। রূপসার উৎস ভৈরব নদ আর মোহনা কাজিবাছা নদী। মাত্র নয় কিলোমিটার চওড়া এ নদী দুর্গাপূজার ভাসানের জন্য বিখ্যাত। হাজার হাজার নৌকা ভাসছে নদীতে। কোন নৌকায় ঠাকুর প্রতিমা। কোন নৌকায় সাউন্ড বক্স বাজিয়ে তরুণদের আনন্দ নৃত্য চলছে। কোন নৌকায় শুধুই দর্শনার্থী, যারা ভাসানের এই নান্দনিক দৃশ্য দেখতে এসেছে। ওরা ভাসান দেখে যখন বাড়ি ফিরে এল তখন রাত দশটা।
দশমীর কুশল বিনিময় করতে নন্দ বাবু নিতিশ বাবুর বাড়ি এসেছে। লুচি-মিষ্টি খাওয়া হলো। বিস্তর হাসাহাসি হলো। এরপর আসল কথাটা পাড়লেন নন্দ বাবু। নন্দ বাবু নিতিশ বাবুর বন্ধু স্থানীয়। নিতিশ বাবু অ্যাক্সিডেন্ট করলে শেফালী দেবী নিতিশ বাবুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। সে টাকার কথা উল্লেখ করে নন্দ বাবু বলে উঠলেন, ও টাকা আর তোমাদের ফেরত দেবার দরকার নেই। বেয়াইমশায়ের কাছ থেকে কেউ কী টাকা ফেরত চাইতে পারে? হা হা হা।
নিতির সাথে তার ছেলে সুনন্দের বিয়ের প্রস্তাব রেখে বলে উঠল, মেয়ের সাথে কথা বলে দেখ নিতিশ, সব ঠিকঠাক থাকলে প্রজাপতি ব্রহ্মার আশীর্বাদে এই ফাল্গুনেই চারহাত এক করে দেব।
নিতিশ বাবু এক প্রকার খুশিতে জড়িয়ে ধরল নন্দ বাবুকে। এতদিন ধরে যে স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন ভেবে ঠোঁটে আসলেও মুখ ফুটে বলতে পারেনি, আজ যখন সে নিজে এসে ধরা দিচ্ছে, তখন আনন্দের আর সীমা থাকে? নিতিশ বাবু কোন কিছু না ভেবেই বলে উঠল, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য নন্দ। তোমার অমন সোনার টুকরো ছেলে এই গরিব পঙ্গু স্কুলমাস্টারের জামাই হবে, এত স্বপ্নেও ভাবিনি। তোমার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকলাম বন্ধু।
দুই পিতা তাদের সন্তানদের কাছে বিয়ের ব্যপারে কিছু মাত্র না শুনেই, কোন মতামত না নিয়েই, একরকম পরম নিশ্চিন্তে একে অপরের বেয়াই হয়ে উঠল। তাদের এই আনন্দ অশ্রু দেখে উপরে একজন মুখটিপে হেসে উঠলেন। এর মধ্যে এক মাস কেটে গেল। নভেম্বর মাস। শহরে শীত জাঁকিয়ে বসেছে। শুভ এখন বাসায় বসেই ড্রিঙ্ক করে। রিমিও তার সঙ্গী হয়। কখনো দু`জন একসাথে বাসায় বসে ড্রিঙ্ক করছে। কজনো বারে যাচ্ছে। আবার কখনো শুভর দু`একজন বন্ধু এসে ওদের সঙ্গী হচ্ছে।
আগে শারিরীক সম্পর্কটা শুভ আর রিমির মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সে বাঁধা কেটে গেছে। ইয়াবা-মদে উন্মাদ হয়ে যায় ওরা। তখন কোন কিছুই আটকায় না ওদের। মাঝেমধ্যে শুভর বন্ধুদের সামনেই শুভ রিমিকে জড়িয়ে ধরত। একটানে কাপড়চোপড় খুলে ফেলতে চাইত। রিমি তখন দৌড়ে অন্য ঘরে গিয়ে দরজা দিত। উন্মত্ত বন্ধুদের হাসাহাসি দানবের মতো শোনাত রিমির কাছে। এখন নেশার মাত্র এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কোন দিকে হুস থাকে না আর। এই তো গত পরশুও, তিনজনের সাথে একসাথে ফ্লাট করছে ও। একটা আদিম উন্মাদনায় সবকিছু তলিয়ে যায় তখন। নেশা আসক্ত পুরুষগুলোর একমিনিটেই সব পৌরুষ শেষ হয়ে যায়। রিমির তখনো উত্তেজনা থাকে তুঙ্গে। একসাথে তিনজন মিলেও রিমির সাথে পেরে ওঠে না। আজকাল এই আদিম উন্মাদনায় মেতে আছে ওরা।
পূজা শেষ করে নিতি ঢাকায় ফিরে এলে শোভনের মা নিতিকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালো। নিতি টিউশনি ছেড়ে দিতে চেয়েও পারল না। কোন নির্দিষ্ট কারণ দেখাতেই পারল না সে। শোভনের মা-ও নাছোরবান্দা। যেকোনো মূল্যে রিচিকে তার পাড়াতেই হবে। অবিরাম অনুরোধ উপরোধ উপেক্ষা করে তার পক্ষে থাকা সম্ভব হলো না। আবার রিচিকে নিয়ম করে পড়াতে গেল সে। আবার পথের মধ্যে শোভনের হাতে পড়ে তার বাইকে উঠতে হলো। আবার শোভনের সেই বেহায়াপনায় অতিষ্ঠ হবার যোগাড়। আজ নিতি পড়িয়ে চলে যাবার পর, শোভনের বাবার সাথে নিতি-শোভনের বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করছে ওরা মা। আজ নিতির কাছ থেকে নিতির বাবার ফোন নাম্বারটা নিয়ে রেখেছিলেন। নিতিদের বাড়িতে ফোন দিলেন তিনি।
নিতি একটা ত্রিমুখী সংকটে পড়েছে। যা হয়তো নিতি নিজেও জানে না। বাড়ি থেকে সুনন্দের ব্যপারে কথা শুনে এসেছে সে। কিছু বলেনি। ভাববার সময় চেয়েছে। এখন শোভনের মা ফোন নম্বর নিল। কেন নিল সেটাও বেশ বুঝতে পেরেছে সে। মেয়েদের অনুভব শক্তি প্রখর। অন্তত তার সম্পর্কে কে কী ভাবছে, সেটা মুখ দেখেই বুঝতে পারে বেশিরভাগ মেয়ে। নিতি না পারছে কাউকে কিছু বলতে, না পারছে নিজে কিছু করতে। দীপের সাথে একরকম যোগাযোগ নেই তার। অথচ স্বামী হিসেবে দীপ ছাড়া আর কাউকে কল্পনাও করতে পারছে না সে। এমন সময় বিসিআইসির রিটের পরীক্ষার চিঠি এসে পৌঁছাল তার কাছে। চলবে