নিতির গল্প

উপন্যাস ৪৪

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুন ২১, ২০২০

আজ এক মর্মান্তিক দিন। রাহেলা খালার গরু খুঁটির সাথে বাঁধা ছিল। হঠাৎ গরু দড়ি ছিঁড়ে গোয়াল থেকে বেরিয়ে আসে। কীভাবে ধরবে গরুটা? আমগাছের চারটা চিবিয়ে শেষ করে দিল। রাধাদের কাজি পেয়ারা গাছের অর্ধেক পাতা খেয়ে সাবাড় করল। নদীর ধারে অনেকেই অনেককিছু লাগিয়েছে। এবার যদি সেগুলোতে মুখ দেয়? রাহেলা খালার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। তিনি দড়ি ধরে গরু টেনে গোয়ালে আনতে চাইল। গরু সে চাওয়ায় কোন গ্রাহ্যই করল না। এক ছুট লাগাল নদীর দিকে। খালা তাল সামলাতে পারছে না। খালা কী পড়ে যাবে? বয়স্ক মানুষ! কী হবে এখন? খালার হাতে গরুর দড়ি। গরু ছুটছে, খালা ছুটছে। গরু থামছে না, খালাও থামতে পারছে না। হায় হায়! এখন কী হবে? সর্বনাশ করেছে! গাছের শিকড়ে বেঁধে খালা পড়ে গেল যে!

খালা পথের উপর পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গরু এক ছুটে নদীর ঘাটে চলে গেল। চিৎকার করে উঠল, মাগো, মরে গেলাম গো... চিৎকার শুনে আশপাশের মানুষজন ছুটে এলো। কী হয়েছে খালার? পড়ে হাত ভেঙেছে কী? বুড়ো হাড়, এখন কী হবে? পাড়া-পড়শীরা ধরাধরি করে খালাকে ভ্যানে তুলল। মোহাম্মদপুর বাজার থেকে নসিমনে মাগুরা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডা. সুনন্দ ডিউটিতে ছিল। তার সহযোগিতায় একজন অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে খালার হাতে এক্সরে হলো। হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই ডান হাতটা ভেঙেছে। হাতের ব্যন্ডেজ করতে হলো। খালা বাসায় এলো। রাধা কলেজে গিয়েছিল। বাড়ি এসে খালকে এ অবস্থায় দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। খালাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। খালারও রাধাকে পেয়ে চোখের জলের বাঁধ ভেঙে গেল।

রাখির বর এখন নিয়মিত ড্রিঙ্ক করে বাড়ি ফিরছে। বেশিরভাগ দিনই মাতাল থাকে। অশ্লীল গালাগালি করে। এটা-ওটা ভাঙে। কখনো কখনো বাসায় এসেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। রাখির মনে বিন্দুমাত্র সুখ নেই। এমনিতেই জোর করে বিয়ে দিয়েছে। তার উপর মদ্যপ বর। রাখির সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক একেবারেই নেই। রাখির বাবা গহনাপত্র যা দিয়েছিল, তার সব বেচা হয়ে গেছে। এখন প্রায়ই রাখির চুলের মুঠো ধরে বাবার কাছ থেকে টাকা আনতে বলছে। রাখি কথা বললে চড়-থাপ্পর কিছুই বাদ থাকছে না। আজও মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরেছে। দু`একটা কথা হতে না হতেই মদের গ্লাস ছুঁড়ে মারল রাখির দিকে। রাখি সরে যেতে চেয়েও সরতে পারল না। সোজা গ্লাস গিয়ে লাগল রাখির মাথায়। মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বের হতে থাকল। রাখি মাথায় রুমাল চাপা দিয়ে সেই অবস্থায়ই রিক্সা নিয়ে দীপেন বাবুর বারাসাতের বাড়ি এসে পৌঁছাল। বেশ রাত। রক্তাক্ত রাখিকে দেখে পার্বতী দেবীর জ্ঞান হারানোর অবস্থা।

সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে গেল রাখিকে। কয়েকটা স্ট্রেস করতে হলো। দু`দিন বারাসাত হাসপাতালে ভর্তি থেকে রাখি আজ বাড়ি ফিরল। বিয়ের কয়েকমাস না যেতেই রাখির সংসার শেষ হয়ে গেল। এখন বারাসাতে মা-বাবার কাছেই থাকছে সে। আয়ানের নাম্বারটা মুখস্থই ছিল। নতুন করে মা-বাবাকে লুকিয়ে আয়ানের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে তার।

নিতি বিসিআইসির রিটেন পরীক্ষা দিয়েছিল। উত্তীর্ণ হয়েছে। আজ তার ভাইভা। ভাইভা দিতে তার মতো আরো অনেক ছেলেমেয়ে ঢাকার বিসিআইসির প্রধান কার্যালয়ে এসে বসে আছে। তার যা সিরিয়াল তাতে দুপুরের পর ছাড়া ডাক পাবে বলে মনে হয় না। সকালে কোনোরকমে খেয়ে চলে এসেছে। ভাইভার চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন হোটেলে গেলেও কিছু খেতে ইচ্ছে করবে না। নিতি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে দু`ঢোক জল খেয়ে নিল। তারপর ব্যাগ থেকে একটা ভাইভা গাইড বের করে চোখ বুলাতে থাকল। দশ মিনিটও গাইডটা দেখতে পারল না। ভাইভার তো কোন সিলেবাস নেই। কী জানতে চাইবে কে জানে? সময় গড়িয়ে চলেছে। সকাল গিয়ে এখন দুপুর। এইমাত্র ভাইভা রুম থেকে পরীক্ষকরা বেরিয়ে গেলেন। এখন দুপুরের নামাজ ও লাঞ্চ বিরতি। বিরতির পর তার ডাকার একটা সম্ভাবনা আছে। সিরিয়াল অনুযায়ী তার আগে আর দুজন মাত্র আছে। তার পাশে যারা বসে ছিল তাদের অনেকেই নামাজ পড়তে চলে গেল। কেউ কেউ গেল দুপুরের খাবার খেতে। নিতি বসে থাকল। শুধু একবার একটু ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আসল।

এখানে যারা এসেছে, তাদের কাউকেই নিতি চেনে না। ডেকে পরিচিত হতে কোন ইচ্ছায় করল না তার। দু`একজন কথা বলে গেছে। সেটা কুশল বিনিময় ছাড়া আর কিছু নয়। নিতি শুধু তাদের `কেমন আছেন` প্রশ্নের জবাবে `ভালো আছি` বলেছে। সে নিজে কোনও প্রশ্ন করেনি। স্বভাবতই আলাপ দীর্ঘ হয়নি। এইমাত্র এক ঘণ্টা নামাজ ও লাঞ্চের বিরতি শেষ হলো। আবার ক্যান্ডিডেট ডাকা শুরু করেছে। দুজনের পর ঠিকই নিতির ডাক এলো। নিতি ভাইভা রুমে প্রবেশ করে সালাম দিল। একজন তাকে বসতে ইঙ্গিত করলে নিতি সামনের চেয়ারে বসল। লম্বা টেবিল। টেবিলের এক প্রান্তে সে একা। অপর প্রান্তে পাঁচজন বসে আছেন। তাদের চারজন পুরুষ। মধ্যমনি হয়ে বসে আছেন এক বর্ষীয়সী মহিলা। চুলে পাক ধরেছে। চোখে রিমলেস গ্লাস। কোন ভার্সিটির অধ্যাপিকা হবে হয়তো। অন্যরা মাঝবয়সী। পুরুষদের মধ্য থেকে একজন প্রশ্ন করে উঠলেন, আপনার নাম নিতি?

হ্যাঁ, স্যার।
তিনি বানান করে বলে উঠলেন, আপনার নামের বানান নী-তি না হয়ে, নি-তি হলো কেন?
স্যার বাবা নিতি নামটা ইচ্ছে করেই (বানান করে) নী-তি না দিয়ে নি-তি দিয়েছিলাম। নি-তি, নি-তুই যথাক্রমে নিত্য ও নিত্যই-র কোমলরূপ। নি-তি শব্দের অর্থ রোজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন লিখেছিলেন, `মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে`।
আবার বানান করে নিতি বলে উঠল, আর নী-তি-র অর্থ অনেকগুলো, ১। কর্তব্য নির্ধারণের উপায় বা রীতি অর্থে যেমন ধরুন, এ কাজ আমার নীতিবিরুদ্ধ, ২। ন্যায়সংগত বা সমাজের পক্ষে হিতকর বিধান বা হিতাহিত বিষয়ক উপদেশ অর্থে, যেমন নীতিকথা, ৩। ন্যায়-অন্যায় বা কর্তব্য-অকর্তব্য বিচার অর্থে, যেমন নীতিশাস্ত্র, ৪। শাস্ত্র বা বিদ্যা অর্থে, যেমন রাজনীতি, ধর্মনীতি, অর্থনীতি, ৫। প্রথা বা আচার অর্থে, যেমন, দুর্নীতি, এছাড়া প্রণালী, রীতি ইত্যাদি বোঝাতেও নীতি।
নিতি আবারও বানান করে বলে উঠল, নী-তি-র অনেক মানে হওয়ায় বাবা নী-তি না রেখে আমার নাম নি-তি রেখেছিলেন।
আপনাকে ধন্যবাদ। অন্য একজন বানান করে বললেন, আবার আপনার বাবার নামের বানান নী-তি-শ না হয়ে, নি-তি-শ কেন? আর নি-তি-শ শব্দটির অর্থই বা কী?

নিতি নতুন করে বানান করে বলে উঠল, নি-তি-শ একটা প্রপার নাউন। বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে (বানান করে) নি-তি-শ বা নী-তি-শের কোনও অর্থ দেয়া নেই। তবে কোনও কোনও সূত্র নি-তি-শের অর্থ দিচ্ছে: গুরুতর, ভাগ্যবান, বন্ধুত্বপূর্ণ, উপযুক্ত, সক্রিয়, অস্থির, আধুনিক, মনোযোগী, উদার, স্বাভাবিক ও আনন্দদায়ক।
নিতি নাম কী আপনার পছন্দ? মধ্যিখানের ভদ্রমহিলা হাসিমুখে প্রশ্ন করে উঠল।
হ্যাঁ স্যার। নিজের নাম তো সকলেই ভালোবাসে, (মুখে একটু হাসির রেখা টেনে) তবে বাবার (বানান করে) নী-তি না রেখে, আমার নাম নি-তি রাখার এই ইচ্ছাটা আমার ভালো লেগেছে।
আরেকজন প্রশ্ন করে উঠলেন, চাকরি হলে কী আপনি চাকরি করবেন?
করবো স্যার। নিতি দৃঢ়তার সাথে বলে উঠল।
যদি ঢাকার বাইরে পোস্টিং হয়? তিনি আবার প্রশ্ন করলেন।
পোস্টিং যেখানেই হোক। চাকরি হলে আমি চাকরি করবো স্যার। নিতি দীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠল।

একজন এ পর্যন্ত কোন কথা বলেননি। তিনি বলে উঠলেন, আচ্ছা, আপনি এবার আসতে পারেন।
নিতি ভাইভার কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। মনে মনে ভাবল চাকরিটা হয়তো হবে না তার। চাকরি না দেবার জন্য এসব আলতো-ফালতো প্রশ্ন করেছে। একপ্রকার মন খারাপ করে নিতি হোস্টেলে ফিরে এলো।

কলেজের ছেলেদের সাথে প্রেম করে বিছানায় টেনে এনে নেশা ধরিয়ে কাস্টমার তৈরি করাই এখন রিমির প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেকনাফ থেকে চালান আসে, সে চালান রিমির মতো শিক্ষার্থীবেশী মাদক বিক্রেতাদের মাধ্যমে চলে যায় সমস্ত কলেজে, সমস্ত ভার্সিটিতে। আজও সজল নামে নতুন একটা ছেলের সাথে তার কথা হলো। সজল রিমির কথাবার্তায় মুগ্ধ। কে জানে সজলের কপালে কী আছে? চলবে