প্রাচ্য তাহেরের গদ্য ‘মৃত্যুরহস্য’

প্রকাশিত : মে ০১, ২০২১

মৃত্যুর কোনো রহস্য নেই। মৃত্যুর মাধ্যমে শুধু রূপ পরিবর্তন হয়। রূপের পরিবর্তনকেই আমরা মৃত্যু বলে মনে করি। ধরা যাক, তুমি তোমার এক বন্ধুকে রেল স্টেশনে বিদায় দিতে যাচ্ছ। তাকে গাড়িতে উঠিয়ে সালাম দিয়ে বিদায় জানালে। গাড়ি ছেড়ে দিলো। তোমার দৃষ্টি থেকে বন্ধুটি সরে গেল। এখন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ না। কিন্তু এর মানে এই নয়, বন্ধুটি কোত্থাও নেই। সে আছে, কিন্তু অন্য কোথাও। ফলে তাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না।

তুমি শিশু ছিলে। যুবক হয়েছো। এখন শিশুটি কোথায় গেল? শিশুটি কি মারা গেছে? সেই শিশুটাকে তো এখন আর দেখা যাচ্ছে না। তুমি যুবক ছিলে, এখন তুমি বুড়ো হয়ে গেছ। যুবকের কী হলো! সে কি মারা গেছে? না, কিছুই হারিয়ে যায়নি, শুধু রূপ পরিবর্তন হয়ে গেছে। শিশুটি যুবক হয়ে গেছে। যুবকই বুড়ো হয়ে গেছে। আর কালকে জীবনই মৃত্যুতে পরিবর্তন হয়ে যাবে। শুধু রূপের পরিবর্তন। দিনে তুমি জেগে ছিলে আর রাতে ঘুমিয়ে পড়বে। দিন আর রাত একই জিনিসের রূপান্তর। যে জেগে ছিল সে-ই ঘুমিয়ে পড়েছে।

বীজের ভিতর বৃক্ষ লুকিয়ে আছে। জমিতে বীজ বপন করো, বৃক্ষ হয়ে যাবে। যখন বীজের ভিতর লুকিয়ে ছিল তখন দেখা যায়নি বৃক্ষকে। ঠিক তেমনি তুমি লুকিয়ে যাও বা বীজের ভিতরে চলে যাও। কোনো কিছুরই মৃত্যু হয় না— বিজ্ঞান এই কথায় একমত পোষণ করে। বিজ্ঞান বলে, কোনো কিছুই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না, রূপান্তর হয় মাত্র। অণু ভাঙলে পরমাণু পাওয়া যাচ্ছে। আবার পরমাণু ভাঙলে নিউটন, প্রোট্রন ও ইলেকট্রন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে না। এক পদার্থের পরমাণু থেকে আরেক পদার্থের পরমাণুতে রূপের পরিবর্তন হচ্ছে।

বিজ্ঞান বলে, পদার্থ বিনাশ করা যায় না। আর এদিকে ধর্ম বলে, চেতনারও বিনাশ নেই। ধর্ম ও বিজ্ঞান এই বিষয়ে একমত হয়েছে, যা আছে তার বিনাশ নেই। মৃত্যু বলতে কিছু নেই। তুমি আগেও ছিলে, পরেও থাকবে। তুমি ঘুমিয়ে রয়েছো। যদি তুমি ঘুম থেকে জাগতে পারো তাহলে তুমি সব কিছু দেখতে পারবে। যা যা তুমি আগে ছিলে, সব দেখতে পারবে। গৌতম বুদ্ধ  তার পিছনের জম্মের কতই না কথা বলেছেন। কখন কি কি হয়েছেন, কখনো পশু, কখনো বৃক্ষ, কখনো রাজা, কখনো ভিখারি, কখনো স্ত্রী, কখনো পুরুষ। যে জাগে তার সব কিছুই স্মরণ হয়। মৃত্যু তো হয় না, মৃত্যু শুধু পর্দাকে নামানো।

তুমি নাটক দেখতে গেছ। নাটক শেষে পর্দা নামানো হলো। তুমি কি মনে করছো, সব লোক মারা গেছে, যারা পর্দার পিছনে চলে গেছে? তারা শুধু পর্দার পিছনে চলে গেছে আবার নতুন করে সাজগোজ করে আসবে, আবার পর্দায় ওঠানো হবে। তখন তুমি সবাইকে চিন্তে পারবে না। কারণ যারা একটু আগে অভিনয় করে গেছে, এখন তারা অন্য চরিত্রে অভিনয় করছে। দুনিয়াতে এটাই হচ্ছে। আর এজন্য দুনিয়াকে নাটক বা রঙ্গমঞ্চ বলা হয়েছে। এখানে শুধু রূপের পরিবর্তন হয়।

সব কিছু এমনই ছিল প্রথম থেকেই, আবার তেমনই হয়ে যাবে। এই দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলে আরেক দুনিয়া তৈরি হয়ে যাবে। তুমি এই দেহকে ছাড়বে আবার অন্য এক দেহে ঢুকবে। তুমি অজ্ঞানকে ছাড়বে, জ্ঞানে ঢুকবে। কিন্তু কোনো কিছুই নষ্ট হবে না। সব এখানে অবিনাশ। তুমি রাস্তায় চলতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা দড়িকে ভয়ের কারণে সাপ দেখছো। ভয়ে তুমি দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলে। তারপর কোনো ব্যক্তির সাথে তোমার দেখা হয়ে গেল। যিনি জানেন যে সেটা দড়ি। সে তোমার হাত ধরে বললো, ভয় পেয়ো না।

যে মারা যায় একমাত্র সে-ই জানে, মৃত্যু কি। আমরা তো শুধু বাইরে দাঁড়িয়ে তার মৃত্যুটাকে দেখছি। যেদিন মৃত্যু মিথ্যা হয়ে যায় সেদিন জীবনও মিথ্যা হয়ে যায়। কারণ জীবন আর মৃত্যু আমাদের একই বিভ্রান্তের দুই ভাগ। যা মৃত্যু আর জীবনের অতীত, সেটাই পরমাত্মা। যদি তুমি জীবনের মোমবাতিটার দুই দিকটাকে দুই হাতে জ্বালতে পারো, তাহলে তুমি একথা বলতে পারো, ‘আমি জীবনকে জানি, এবার মৃত্যুকে জানব।’