
প্রেম ও কামনার ভাষায়ন হিমেল বরকতের কবিতা
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : জুলাই ২৭, ২০২১
কবি হিমেল বরকত ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় আমার এক বছরের সিনিয়র। হিমেল ভাই ছিলেন খুব চুপচাপ, নিরবিলি অন্তর্মুখী আশ্চর্য মানুষ। জলদগম্ভীর কণ্ঠ, চেহারাতেও প্রাজ্ঞতা আর স্থৈর্যের ছোঁয়া। আমাদের কালে ক্যাম্পাসে কবি হিসেবেই সবাই চিনত তাকে। আর রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর আপন ছোট ভাই হিসেবেও। পরবর্তীকালে যারা তার শিক্ষার্থী ও সহকর্মী হয়েছিলেন, তারা তাকে চিনেছেন আরো নিবিড় ও অন্তরঙ্গভাবে, নানা মাত্রায়, নানা পরিচয়ে।
অজস্র দিন তার রুমে আড্ডা হয়েছে ক্যাম্পাস জীবনে। সোহেল হাসান গালিব, মাদল হাসান, খালিদ সাইফ, লুতফর রহমান ভাইদের সাথে। তাদের যে ব্যাচ ছিল, জাহাঙ্গীরনগরের হিসেবে সেটাকে ২৬তম ব্যাচ বলে। কোনো একটা ব্যাচে এমন একঝাঁক তুমুল প্রতিভাবান কবি, আর কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কবি হিসেবে সোহেল হাসান গালিব, মাদল হাসান, রাশেদুজ্জামান প্রমুখ বেশ সুপরিচিত এখন। গালিব ভাইয়ের সম্ভবত ক্লাস নাইন-টেনে থাকতেই কবিতার বই বেরিয়েছিল। সেই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন ড.আনিসুজ্জামান।
গালিব ভাই রবীন্দ্রনাথের উপর মোটামুটি হাফেজ ছিলেন তখন থেকেই । তার কবিতার ভেতরেও রবীন্দ্রনাথের ভাব-মূর্ছনা ও মগ্নতা আছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মননশীলতাও তার কবিতার ভেতরে খেয়াল করতাম তখন। একটা চাপা উইটও। লক্ষ্য করা যেত একটা আনত আধ্যাত্মিকতার ভাবও। এক ইন্টেরিওর মনোলগও মনে হতো তার কবিতা। অবশ্য, কবিমাত্ররই স্বগত উক্তি থেকে মুক্তি প্রায় অসম্ভব। ভাষার মোচড়ে সব কিছুকেই কবিতা বা কবিতার মতো বানিয়ে ফেলতে পারতেন তিনি। এক রকম স্বভাব কবিত্বও ছিল তার ভেতরে। ছন্দের উপর তার অসামান্য দক্ষতার কথা না বললেও চলে।
তখন, ২০ বছর আগের কথা বলছি, তার প্রায় সব কবিতাই ছিল ছন্দে, সমিল বা আমিল। ২০/২১ বছর আগে তার বৌদ্ধিক শার্পনেস বুঝেছিলাম, আমার গদ্যে তখন থাকা আবু সয়ীদ আইয়ুবের প্রভাবের কথা তুলে ধরায়। গ্রামসির কী একটা লেখার থিম নিয়ে আমি পেন্সিল দিয়ে ডায়েরিতে একটি নাতিদীর্ঘ গদ্য লিখেছিলাম। সেটা পড়ে তিনি আবু সয়ীদ আয়ুবের গদ্যের সাথে আমার মিল দেখেছিলেন। সত্যিই তখন প্রায় সকলের অলক্ষ্যে আবু সয়ীদ আইয়ুব-আক্রান্ত ছিলাম আমি। গালিব ভাই আমাকে ও খালিদ সাইফ ভাইকে উৎসর্গ করেছিলেন তার ‘কাব্য অষ্টাদশী’ বইটি।
মাদল হাসানের কবিতায় পেতাম বিনয় মজুমদারের ভঙ্গি কিছুটা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরও। তার কবিতা ছিল মানুষ, জীবজগৎ, প্রকৃতি ও সম্পর্কের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে ও কথোপকথনের ভাষা-নির্যাসে ঋদ্ধ। আপাদমস্তক কবিতাআক্রান্ত মানুষ তিনি। কবিতার মধ্যে এমন আমুণ্ডুপদনখ নিমগ্ন থাকা মানুষ আর দেখিনি। কবিতা না লিখতে পারলে ছটফট করতেন। কিছু কারণে মানসিক যন্ত্রণায়ও ছিলেন। একবার আমাকে এক চিরকুটে লিখেছিলেন, ‘তুমি আমাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছ।’ পুরো ঘটনা মনে নাই আর এখন।
হিমেল ভাইয়ের সাথে তেমন মেশা হয়নি, কিন্তু দেখা হলে বেশ একটা স্নেহময় অভিব্যক্তি লাভ করতাম তার থেকে। বাংলা বিভাগের বড় ভাইদের সাথেই আমার সবচেয়ে বেশি খাতির ও মেলামেশা ছিল। জাহাঙ্গীরনগর এক আশ্চর্য জায়গা, শিল্প-সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার জন্যে খুব ফলবান জায়গা মনে হয়েছিল একে। প্রেম করবার জন্যেও! হিমেল ভাই খুব যত্ন করে প্রেম করতেন বলে পপি আপা (পরে তার স্ত্রী) ছাড়া আর কোনো ছেলে বা মেয়ের সাথেই তেমন মিশতে দেখিনি তাকে। খুব আবেগী মনে হতো উনাকে। কেমন যেন একটা বেদনা-মথিত অভিব্যক্তি ছিল তার ভেতরে, তার কবিতার মতোই।
প্রেম ও কামনার ভাষায়নে তিনি অনবদ্য। তীব্র আবেগসিক্ত কামনাকে শব্দের ইকনোমিতে তিনি প্রকাশে পারঙ্গম। সঙ্গমের বাঁধভাঙা আকুলতাতেও ভাষার সংযম তিনি হারান না। তার কবিতায় কোনো কোলাহল নেই, হলাহলও নেই। দীর্ঘকবিতা তিনি লেখেন না বললেই চলে। ছন্দের বন্ধনে, ফর্মের আনুগত্যে থেকেই তার বিরহী প্রাণ স্ফুর্তি পায়। এক বিষাদ, ইন্টেন্স মেলানকলি, লক্ষ্য করা যাবে তার প্রায় প্রতিটি কবিতায়। এই বিষাদ এমন, যার প্রকাশ যেন হৃদয়ের শুশ্রুষা দেয়, ভেঙেচুরে হতোদ্যম ও নিরাশ করে না। বিষাদই তার আনন্দের ঘর।
অনার্দ্র জিহবা নিয়ে তিনি যেন এক আকুল চুমুকের প্রতীক্ষায়! প্রেয়সী যেন তার কাছে এক দিগন্তের মতো, যাকে পেয়ে পেয়েও তিনি পান না; তার প্রেয়সী যেন এক ঘুমন্ত নারী, যার ভোরে জেগে উঠবার প্রত্যাশায় তিনি বিনিদ্র থাকেন থরো থোরো কম্পন আর বিন্দু বিন্দু কান্নায়। স্বপ্নের মগ্নতায় তিনি চিত্রিত করেন অসমাপ্ত শূন্যতা। মেঘ, জল, নদী, বৃষ্টি সবাইকে নিয়ে কবি একা। যুক্ত হবার, যুক্ত থাকবার এক ব্যাকুল ইচ্ছে তার কবিতায় অভিব্যক্ত দেখি। জগতের গল্পরা হারিয়ে যায়, না-পাওয়া চাওয়ার তীব্রতাকে চিরস্থায়ী করে। হারিয়ে ফেলে ফিরে পাবার যে আনন্দ, সেই আনন্দের অন্বেষণ করেন হিমেল।
দেহ ও মনের ধ্রুপদী দ্বন্দ্ব মাঝে মাঝেই মুখ তুলে তাকাবে তার কবিতায়। প্রেয়সীর নৈকট্যে কবি যতটা কায়া পান তারও চেয়ে যেন পান ‘ছায়া’। এই ছায়া যতটা শ্যাডো, তারও চেয়ে বেশি যেন শেল্টার। তার কবিতার যৌনানুভব প্রেয়সীর প্রত্যঙ্গ-অভিমুখী নয় তেমন, পুরো সত্তা-অভিমুখী। প্রেয়সীর সত্তায় নিজেকে লীন করে একাকার হয়ে যেতে না পারার দীর্ঘশ্বাস তার কবিতায় বেজে ওঠে বারবার। মাঝে মাঝে অভিপ্সীতের ওষ্ঠই হয়ে ওঠে পুরো দেহাবয়ব, তারপরও করপুটে উঠে আসে না সবটুকু। হাহাকার রয়ে যায়। আলা বাদিয়্যু বলেছিলেন, যৌন ক্রিয়া আসলে বিযুক্ত করে, এটি দুজনের আলাদা অস্তিত্বের ঘোষণা। যৌন ক্রিয়ার মাধ্যমে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তা পুরণ করার জন্য কল্পনা যা নিয়োগ করে তাই হলো প্রেম।
কিন্তু হিমেলের কাছে প্রাকমিলন আকুলতা, মিলনকালীন সুখ আর মিলোনোত্তর শূন্যতা সবটা মিলিয়েই প্রেম। প্রেমে কে কর্তা, কে গ্রহীতা—এই কূট প্রশ্নের নীতিনিষ্ঠ সমাধানের চিহ্ন দিয়ে কবিতাকে প্রেমের মতাদর্শিক বয়ান বানাতে চান না হিমেল। তার কাছে ‘সোনা বউ’ শব্দটা হয়ে ওঠে দুজনার পারস্পরিক আকুলতার ও আত্মলীনতার সিগনিফায়ার। আমার স্মৃতিতে তার কবিতা নিয়ে এসব ভাবনাই ভেসে উঠল আজকে তার জন্ম দিবসে। অন্যান্য বিষয়াদি অন্যরা তুলে আনবেন হয়তো। আজ তিনি বেঁচে থাকলে বয়স তেমন বেশি হতো না। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক