ফ‌কিন্নিরাই দু‌নিয়ার প্রকৃত দার্শ‌নিক

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জুন ১৫, ২০১৯

জর্জ অরও‌য়ে‌লের `অ্যা‌নিম্যাল ফার্ম` এর মা‌নের ও ভা‌বের বাংলা ভাষায় শুধু সত্যজিতের `‌হীরক রাজার দে‌শে` আছে। `রক্ত করবী` অনেক বে‌শি দার্শ‌নিক ও উচ্চ মা‌নের এদু‌টো থে‌কে। একটা উপন্যাস, আরেকটা সি‌নেমা ও বা‌কিটা নাটক। প্রতিটা ফর্ম আলাদা হ‌লেও শি‌ল্পে উদ্দেশ্য মোটা দা‌গে এক হ‌তে পা‌রে, এখা‌নে একই। এই তি‌ন‌টি ভিন্ন ফ‌র্মের উদ্দেশ্য টোলেটা‌রিয়ান রা‌ষ্ট্রের সমা‌লোচনা, সমাধানধর্মী কিছু নয়।

দু‌নিয়ার বে‌শির ভাগ শিল্প-সা‌হিত্য আস‌লে সমস্যা‌কে অ‌্যা‌ড্রেস ক‌রে। সমাধা‌নের ব্যাপারটা রাজনৈ‌তিক ও দার্শ‌নিক বিষয়। শিল্প থে‌কে আ‌রও বে‌শি সো‌ফি‌স্টেকে‌টেড ব্যাপার সমাধান কেননা বিষয়টা ব্যবহা‌রিক। লেখক, ক‌বি, ফিল্মওয়ালা, নাট্যকারের সমাধার না দি‌লেও চ‌লে। যেমন ধ‌রেন অরও‌য়েল `অ্যা‌নিম্যাল ফ‌র্মে`, সত্যজিৎ `হীরক রাজার দে‌শে` যে সমস্যাগু‌লো তু‌লে এনে‌ছেন তা বাস্তব জগতের সমস্যার মোটাফ‌রিক্যাল রূপ। ফ‌লে মেটা‌ফোর জি‌নিসটাও সে‌কেন্ডা‌রি। মা‌নে দু‌নিয়ার এইরূপ সমস্যা না থাক‌লে প্লেইন টেক্সট হিসা‌বে এগু‌লোর কোনো মূল্য নাই।

চিন্তার পদ্ধ‌তি ও আমা‌দের আচর‌ণের কার‌ণেই আমরা শিল্প গ‌ড়ি। কোনো মোটাফর যখন বাস্তবতার সা‌থে রি‌লেট কর‌তে পা‌রে না তখন তা আরব্য রজনীর রূপকথা/ফ্যান্টা‌সি হ‌য়ে ওঠে। ফ‌লে, মোটাফ‌র সু‌ডো‌রিয়া‌লি‌টি হ‌য়ে ওঠার পার্থক্য শুধু রিয়া‌লি‌টির সা‌থে সংযুক্ত হওয়া আর না হওয়া। ধ‌রেন, দু‌নিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী সমস্যা না থাক‌লে অ্যা‌নিম্যাল ফার্ম, হীরক রাজার দে‌শে বা রক্তকরবী রূপকথা হ‌য়ে উঠ‌তো না। বাস্তবতাই মেটাফর তৈ‌রি ক‌রে। সমস্যা‌কে চি‌হ্নিত করা রাজ‌নৈ‌তিক রিফ‌র্মেশন না ম‌নে হয়। প‌লি‌টিক্যাল কা‌রেক্ট‌নে‌সের চর্চা কী এইগু‌লো না? রাজনী‌তি‌কে মান‌বিক ভা‌বে গ‌ড়ে তোলার, দেখার ও প্রত্যাশামূলক একটা ব্যাপার আছে অ্যা‌নিম্যাল ফার্ম, হীরক রাজার দে‌শে ও রক্তকরবী‌তে। এধর‌নের শিল্প‌কে কী আমরা প্রপাগান্ডা শিল্প বল‌তে পার‌ি কিনা? তিনটা শি‌ল্পের পার্থক্য কর‌তে হ‌লে লেখক‌দের ব্য‌ক্তিগত রাজ‌নৈ‌তিক বিষয়গু‌লো মাথায় নি‌লে বোঝা যায় সা‌হিত্য অ‌নেক সময় প্রডাগান্ডা হ‌য়ে ওঠে।

অরও‌য়েল ডে‌মো‌ক্রে‌টিক সোসা‌লিজ‌মে বিশ্বাসী। অ্যা‌নিম্যাল ফার্ম লেখা ন‌ভেম্বর ৪৩ থে‌কে ফেব্রুয়া‌রি ৪৪ এর ম‌ধ্যে। এই সম‌য়ে ইংল্যান্ড রা‌শিয়া‌কে সা‌থে ন‌ি‌য়ে দ্বিতীয় বিশ্ব যু‌দ্ধে জার্মা‌নির বিরু‌দ্ধে প্রতিরোধ গ‌ড়ে তু‌লে‌ছে। মহান স্ট্যা‌লিনের নেতৃত্বকে ইংল্যা‌ন্ডে‌র ইন্টে‌লেকচুয়ালরা বেশ ভা‌লোভা‌বেই ‌নিয়ে‌ছে। য‌দিও তারা সোস্যা‌লিস্ট না। ফলে বইটি যখন ইউ‌কে উইএসএর প্রকাশক‌দের কা‌ছে যায় তখন তারা এটা প্রকাশ কর‌তে তেমন একটা আগ্রহ দেখায়‌নি। মা‌নে সা‌হিত্যের সেন্সর‌িশিপ একটা পাবলিক ব্যাপার। মা‌নে, প্রাতিষ্ঠা‌নিক সেন্সর‌সিপ কোনো ব্যক্তিবর্গ না জনগ‌ণের আশা, প্রত্যাশা দি‌য়ে নিয়‌ন্ত্রিত। তা না হ‌লে, প্রকাশ কর‌তে না চাওয়া বইটাই শীতল যু‌দ্ধের সময় বইটা খু্বই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যারা একে প্রকাশ কর‌তে চান নাই, তারাই এটা গ্রহণ কর‌ছেন। মাজার! ফিলস‌ফি, বিশ্বাস থে‌কে মানু‌ষের সর্টটার্ম লাভ লোকসান দি‌য়ে মানুষ প‌রিচা‌লিত। এলিটরা মূলত জনগ‌ণের প্রত্যাশাই সার্ভ ক‌রে। ফ‌কিন্নিদের প্রকৃত বন্ধু হ‌লো এলিট শ্রেণি। আপ‌নি তা‌দের যতই গা‌লিগালাজ ক‌রেন না কেন। ছোট‌লোক‌দের ছোট‌লো‌কিটা এলিটরা ভ্যা‌লিড ক‌রে। ফ‌লে, বিশ্ব রাজনী‌তি প‌রিবর্ত‌নের সা‌থে সা‌থে অ্যা‌নিমাল ফ‌া‌র্মের ভ্যা‌লি‌ডি‌টি কীভা‌বে প‌রিবর্তন হয় তা বোঝার জন্য এটা মনে রাখা দরকার।

ই‌ন্টে‌লেকচ্যুয়াল এলিটরা মূলত সমা‌জের ছোট‌লোক‌দের প্রতি‌নি‌ধি। ফ‌লে, জনরু‌চি দ্বারা এলিট‌কে ম্যা‌নিপু‌লেট করা যত সহজ, ততটা সহজ না ফ‌কিন্নিদের নিয়ন্ত্রণ করা। ফ‌কিন্নিরাই দু‌নিয়ার প্রকৃত চিন্তক, বৃ‌দ্ধিজীবী, তা‌ত্ত্বিক, দার্শ‌নিক।

লেখক: কবি

একুশে বইমেলা ২০১৮