
বাংলা সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব
রফিকুল পাশাপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯
ভাষা-আন্দোলন বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। মাতৃভাষায় কথা বলার দাবিতে এই আন্দোলনের মূল সূত্রপাত হয়েছিল। এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছিল বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মুখের ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের আন্দোলন। এজন্য ক্ষয় হয় অনেক তাজা প্রাণ আর ঝরে রক্ত। মাতৃভাষার মুক্তির জন্য রক্ত দেয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে আর একটিও নেই। বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়ে এক কালজয়ী ইতিহাস গড়েছে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির অল্পকাল পর থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের একটি অংশের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টম্বর ‘তমুদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংগঠনের লক্ষ্য ছিল, বাংলা ভাষার মাধ্যমে সংস্কৃতি চর্চা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষার পক্ষে এ সংগঠনের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলেন।
এ ঘোষণার পর ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়ে এক বিরাট সভার আয়োজন করে। এ সভায় একুশে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। অবস্থা বুঝতে পেরে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। তবুও ক্ষুব্ধ জনতা মিছিল ও গণশ্লোগান দিতে দিতে রাজপথে বেরিয়ে আসে।
পুলিশ তাদের ওপর গুলি বর্ষণ করে। শহিদ হন সালাম, জব্বার, রফিক ও বরকতসহ নাম না-জানা আরো অনেকে। ১৯৪৭ সালে যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে তারই চূড়ান্ত পরিণতি আসে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে। এ তারিখটিকে স্মরণ করে সৃষ্টি হয়েছে অনেক সাহিত্য আর ইতিহাস। রচিত হয়েছে কবিতা, গান, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস ও ছড়া।
কবিতা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা। কবিতা দিয়েই বাংলা সাহিত্যের জন্ম হয়। তেমনিভাবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরী রচনা করেন একুশের প্রথম কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’।
এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়
সেখানে দাঁড়িয়ে আমি কাঁদতে আসিনি
আজ আমি শোকবিহ্বল নই
আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল
আমি আজ তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে নির্বিচারে হত্যা করেছে।
এরপর স্মরণযোগ্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক একুশের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার পর কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতার প্রতিবাদ স্বরূপ সোচ্চার বাণী:
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমারা এখনো
চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। যে ভিত কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটিকা ধূলায় চূর্ণ যে পদপ্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য।
ইটের মিনার
ভেঙেছে, ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চারকোটি পরিবার।
হাসান হাফিজুর রহমান ভাষা আন্দোলনকে সামনে নিয়ে লিখেছেন ‘মিছিলের একমুখ,’ ‘ফেব্রুয়ারির ঢাকা আমার,’ ও ‘অমর একুশে’। এসব কবিতায় শিল্পিত হয়েছে বাঙালির আত্মজাগরণের ইতিহাস। যেমন তাঁর ‘অমর একুশে’ কবিতা থেকে দৃষ্টান্ত টানলে তার বাস্তব প্রমাণ মেলে,
আবুল বরকত নেই; সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো
আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুচকে উঠবে
যে তাঁকে ডাকো না;
সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার, কি বিষন্ন থোকা থোকা নাম।
বাংলাদেশের সমস্ত প্রান্তকে উন্মাতাল করে দেওয়া একুশের ভিন্নতার এক অব্যক্ত ব্যঞ্জনা প্রস্ফুটিত হয়েছে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘কোনো এক মাকে’ কবিতায়। খোকা, যে শহিদ হয়েছে ভাষা-আন্দোলনে, আর যে কখনো উড়কি ধানের মুড়কি হাতে অপেক্ষামান মায়ের কাছে ফিরে আসবে না, সে -কথা মা কিছুতেই বুঝতে চায় না। এ কবিতায় দেহাবরণে বর্ণিত হয়েছে শহিদের রক্ত-নিঙ্ড়ানো পঞ্জীভূত আবেগ,
কুমড়ো ফুল
শুকিয়ে গেছে,
ঝরে পড়েছে ডাঁটা,
পুঁইলতাটা নেতানো
খোকা এলি?
ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠোনে, উঠোনে
যেখানে খোকার শব
শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।
এখন,
মার চোখে চৈত্রের রোদ
পুড়িয়ে দেয় শুকুনিদের।
তারপর,
দাওয়ায় বসে
মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খই ভাজে,
খোকা তার কখন আসে!
এখন,
মার চোখে শিশির ভোর,
স্নেহের রোদে
ভিটে ভরেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনাই বাঙালিকে স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে এবং এর মাধ্যমে বাঙালি আত্মসচেতন হয়ে নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। যা কবি শামসুর রাহমানের ‘শহীদ মিনারে কবিতা পাঠ’ কবিতায় জাগ্রত হয়েছে,
আমরা ক’জন
শহীদ মিনারের পাদপীঠে এসে দাঁড়ালাম
ফেব্রুয়ারির শীত বিকেলে।
আমাদের কবিতা পাঠের সময় মনে হয়
তারা এলেন শহীদ মিনারে, নিঃশব্দে কিছুক্ষণ
আসা যাওয়া করে চত্বরে ক’জন
শহীদ দাঁড়ান পাদপীঠে।
এমনিভাবে মহাদেব সাহার ‘একুশের গান’ খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘ফেব্রুয়ারিতে জনৈক বাগান মালিক’ ফজলে লোহানীর ‘একুশের কবিতায়’ একুশের চেতনার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে একটি শোকার্ত সঙ্গীত আমাদের কাছে আজ ব্যাপক পরিচিতি। এ প্রসঙ্গে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সেই বিখ্যাত গানটি প্রণিধানযোগ্য,
আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুগড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
আবদুল লতিফের ‘একুশের গানে’ ভাষা-আন্দোলনের প্রভাব জেগে উঠেছে,
যে শুনাইছে আমার দেশের গাঁও গেরামের গান
নানান রঙের নানান রসে ভইরাছে তার প্রাণ।
ঢপ কীর্তন ভাসান জারি
গাজির গীত আর কবি সারি
তার ভাটিয়ালি গানের সুরে
মনের দুক্ষু যায় রে দূরে
বাজায় বাঁশি সেই না সুরে
রাখাল বনের ছায়।
ঘুম পারাই না গাইতো যে গান
মোর দুঃখিনী মায়।
ভাষা-আন্দোলনের অনুষঙ্গে অনেক ছোট গল্পকার শিল্পসফল অসংখ্য ছোটগল্প রচনা করেছেন। ভাষা-আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী পালন উপলক্ষে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ (১৯৫৩) সংকলন গ্রন্থেই আমরা ভাষা-আন্দোলনের ছোটগল্পগুলো পেয়েছি। এখনও আমাদের ছোট গল্পকাররা ছোট গল্পরচনার ধারা অব্যাহত রেখেছেন। সে সব ছোটগল্পের জমিনে আলোকিত হয়েছে ভাষা-আন্দোলনের তাৎপর্য। এ প্রসঙ্গে আমরা প্রবীণ ও নবীনদের ছোটগল্পগুলো উপস্থাপন করতে পারি। শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়,’ সাইয়ীদ আতীকুল্লাহর ‘হাসি’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি,’ মিন্নাত আলীর ‘রুম বদলের ইতিকথা,’ সরদার জয়েন উদদীনের ‘খরস্রোত,’ নূরউল আলমের ‘একালের রূপকথা,’ রাবেয়া খাতুনের ‘প্রথম বধ্যভূমি,’ মঈদ-উর-রহমানের ‘সিঁড়ি’ সেলিনা হোসেনের ‘দীপান্বিতা’ শহীদুল্লা কায়সারের ‘এমনি করেই গড়ে উঠবে,’ সৈয়দ শামসুল হকের ‘সম্রাট,’ মুর্তজা বশীরের ‘কয়েকটি রজনীগন্ধা,’ বশীর আল্ হেলালের ‘বরকত যখন জানত না সে শহীদ হবে’, শওকত আলীর ‘অবেলায় পুনর্বার’ রাজিয়া খানের ‘শহীদ মিনার,’ রিজিয়া রহমানের ‘জোৎস্নার পোস্টার’, মাহমুদুল হকের ‘ছেঁড়া তার’, মঈনুল আহসান সাবেরের ‘মরে যাওয়ার সময় হয়েছে’, রশীদ হায়দারের ‘সুদূরের শহীদ,’ এবং জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প,’ ‘সূর্যগ্রহণ’, কয়েকটিসংলাপ’ ইত্যাদি ছোটগল্পে ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট মানুষের জীবনের এক একটি খণ্ড খণ্ড ছবি প্রতিভাসিত হয়েছে।
ভাষা-আন্দোলন ছিলো জাতির অস্তিত্বের লড়াই। আর এই অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ সাহিত্য রচিত হয়েছে। এ পর্যায়ে আব্দুল হকের ‘ভাষা আন্দোলনের আদি পর্ব’, বদরুদ্দিন উমরের তিন খণ্ডে ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি,’ ‘ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলামের ‘আমাদের মাতৃভাষা চেতনা ও ভাষা আন্দোলন’, সৈকত আসগরের ‘ভাষা আন্দোলন ও শহীদ রফিক’, ড. সাঈদ-উর-রহমানের ‘পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন’, ইত্যাদি ভাষা-আন্দোলন নির্ভর সমৃদ্ধ প্রবন্ধ সাহিত্য সম্ভার।
ভাষা-আন্দোলনের ঘটনাপুঞ্জ নিয়ে শিল্পসফল রচিত নাটকের সংখ্যা খুব কম । এতদ্প্রসঙ্গে মুনীর চৌধুরী বাংলাদেশে ‘কবর’ (১৯৫৩) নাটক লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। সংক্ষিপ্ত আয়োজনে এই একাঙ্কিকায় মুনীর চৌধুরী ধারণ করেছেন বাঙালি জাতিসত্তার সম্মিলিত জাগরণের গৌরবোজ্জ্বল চেতনা। মমতাজউদ্দীন আহমদের ‘বিবাহ’ নাটকেও ভাষা-আন্দোলনের বীজ জাগ্রত হয়েছে অবিনাশী শব্দ-সম্ভারে। সখিনা নামের এক নারীর বর শহিদ হয়েছে ভাষা-আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে। এই ঘটনা সখিনা এবং সখিনার পিতাকে উদ্বুদ্ধ করেছে বৃহত্তর উজ্জীনের পথে, তাদের সংলাপে ব্যক্তিক বেদনা ছাপিয়ে সামষ্টিক চিন্তা-চেতনা প্রস্ফুটিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি প্রতিভাসিত হবে।
ক. কোথায়, আমার মা জননী কোথায়। কই? আজ আমার গৌরব করার দিন রে মা। একি কম কথা। আমার মেয়ের জামাই জালেমের গুলিতে শহীদ হয়েছে। বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। এত একটা ঘটনা না। এতো ইতিহাস, এতো একটা অগ্নিগিরি। আমি বলছি, আমার ছেলে বলছে, ঐ ছেলেকে আমরা মাটির নিচে রাখব না। আমার ছেলেকে হরগিজ করবে যেতে দেবে না । আমার ঐ ছেলের গোরাজাব নাই, আমার জামাই এর জন্য বেহেস্তর সব দরজা খোলা।
খ. আমার তো সেই কবে বিয়ে হয়ে গেছে ছোট মামা। এক মধু মাসে ফাল্গুনের ঝরা পাতা ছিল। কোকিলের গান, বসন্তের ফুলের গন্ধ, শানাই-এর সুর বেজেছিল। আমার বিয়েটা হয়েছিল মহাসমারোহে। ছোট মামা বিয়ের প্রথম কথাটা শুনেছিলাম তোমার কাছে। আজ বলে যাও ছোট মামা, আমি ওকে চিরকাল ধরে রাখব কেমন করে। এক এক করে বায়ান্ন থেকে সাতান্ন বছর বেঁচে আছি। যতদিন বাঁচব ওকে নিয়ে বেঁচে থাকব।
পিতা এবং সখিনার এই উক্তিতে ভাষা-আন্দোলনের মূল চেতনা টগবগ করে ফুটে উঠেছে। উপন্যাসেও ভাষা-আন্দোলনের বীজ জাগ্রত হয়েছে। সমাজসচেতন প্রগতিশীল ঔপন্যাসিক জহির রায়হানের(১৯৩৩-৭২) রচিত ভাষা-আন্দোলন ভিত্তিক প্রথম উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ (১৯৬৯) । এটি একটি খ্যাতনামা উপন্যাস। সমালোচকদের মতে, বিষয় ভাবনার গৌরবোজ্জ্বল ‘আরেক ফাল্গুন’ জহির রায়হানের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বায়ান্নর রক্ত স্নাত ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছে এ উপন্যাস। সামরিক শাসনের নিগ্রহের মধ্যে বাস করেও, একুশের মর্মকথা-উৎসারিত আরেক ফাল্গুন’ পাঠ করে আমরা হয়ে উঠি সাহসী প্রত্যয় পুরুষ। এ উপন্যাসের জমিনে লক্ষ করি, আসাদ, মুনিব, রসুল, সালমা প্রভৃতি চরিত্র অঙ্কনে শিল্পী নির্ভীক চিত্তের পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। জহির রায়হানের এ উপন্যাসের ভাষা আবেগ প্রবণ, চিত্রাত্মক চিত্র নাট্যধর্মী এবং কবিতাস্পর্শী। দৃষ্টান্তে বিষয়টি অনুধাবনীয়:
আকাশে মেঘ নেই। তবু ঝড়ের সঙ্কেত।
বাতাসে বেগ নেই। তবু, তরঙ্গ সংঘাত।
কণ্ঠে কণ্ঠে এক আওয়াজ, শহীদদের খুন
ভুলবো না। বরকতের খুন ভুলবো না।
কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান তার ‘আর্তনাদ’ ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে উপন্যাসটি রচনা করেছেন রাজনৈতিক উপাদান প্রেক্ষাপট সহযোগে। তিনি বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের চেতনাবীজকে বাঙালি জাতিসত্তার মৌল আবেগের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বর্ণনা করেছেন। রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন লেখক লিখেছেন, “এত রক্ত জননী বাংলা ভাষা, এত রক্ত ছিল এ শরীরে”।
এ উপন্যাসে ‘কোরাস’ অংশে চলমান বাসের মধ্যে সীমাহীন নিঃশব্দতায় ভাষা-আন্দোলনে নিহত শহিদের পিতার আর্তচিৎকার সৃষ্টি করেছে গভীর বেদনাময় পরিবেশ। আর ‘একাকী’ অংশে আলী জাফরের আত্মা অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে নিহত আত্মার সর্বব্যাপ্ত আত্মা উন্মোচন এক নতুন শিল্পমাত্রায় ব্যক্ত হয়েছে এবং সেই সাথে ব্যক্তি অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিবেদনাকে দেশ-মাতৃকার মর্মমূলে সংস্থাপন করে সুচারু ভাবে উপস্থাপনা করেছেন দায়বদ্ধ কথাশিল্পী শওকত ওসমান।
ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সেলিনা হোসেন রচনা করেছেন দু’খানা উপন্যাস, ‘যাপিত জীবন’(১৯৮১) এবং ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’ (১৯৮৭) । ‘যাপিত জীবন’ উপন্যাসে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের দেশ বিভাগের পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা-আন্দোলনের যাবতীয় ঘটনাপুঞ্জকে নন্দনদৃষ্টি দিয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্র জাফরের অস্তিত্বের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আর চল্লিশের উত্তাল ইতিহাসকে ধারণ করে আছে বলে ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’ হয়ে উঠেছে ভাষা�আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের এক অমূল্য শৈল্পিক দলিল।
আমাদের ভাষা-আন্দোলনের ক্যানভাসে ছড়া সাহিত্যও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। অসংখ্য ছড়া রচিত হয়েছে ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা যায় আল মাহমুদের সেই বিখ্যাত ছড়া ‘একুশের ছড়া’। যেমন,
ফেব্রুয়ারি একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি ঝরে, বৃষ্টি কোথায়
বরকতেরই রক্ত।
মসউদ উশ শহীদ তার ‘ভাষার জন্যে’ ছড়ায় লিখেছেন,
ভাষার জন্যে লড়াই হলো
লড়াই করে আস্থা পেলাম,
ভাষার জন্যে লড়াই করে
স্বাধীনতার রাস্তা পেলাম।
বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের একুশে ফেব্রুয়ারি অমর ও অবিনশ্বর। ভাষা-আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনে যেমন এনে দিয়েছে গৌরবের তাৎপর্য, তেমনি আমাদের শিল্প-সাহিত্যকে নতুন প্রাণের স্পন্দনে প্রভাবিত করেছে। তাই ভাষা-আন্দোলন ও বাঙলা সাহিত্য সমান মর্যাদায় বাঙালি জাতির ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
লেখক: গবেষক, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়