কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ২৮

প্রকাশিত : আগস্ট ০৪, ২০২৫

শুধু যে আব্বার কাছে অনেকে টাকা পান তাই নয়, আব্বাও বহু মানুষের কাছে টাকা পান। শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে গুঁড়া চা সরবরাহ করেন তিনি। হাজার হাজার টাকা বাকি পড়ে।

কখনো কখনো রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যায়, বাকি পড়া টাকা আর পাওয়া যায় না। সেইরকম একটা রেস্টুরেন্ট বন্ধ হওয়ার খবর আম্মার কানে চলে আসে। আব্বাকে জেরা করে আম্মা জানতে পারেন, সেখানে আড়াই হাজার টাকা পাওনা ছিল। ঘটনাচক্রে সেই রেস্টুরেন্টের মালিক আমাদের এক আত্মীয়, তার নাম কাজী আবিদুর রেজা, ডাক নাম জাহাঙ্গীর, তিনি ঢাকাস্থ ইউএনডিপি অফিসের প্রশাসন বিভাগে কাজ করেন। শখের বসে রেস্টুরেন্ট দিয়ে ফেইল করেছেন।

আম্মা বলেন, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ফেইল করলেও জাহাঙ্গীর মামা ইউএনডিপিতে চাকরি করেন, ভালো বেতন পান, আমাদের এমন দুর্দিন, তিনি কি এই টাকাটা দিতে পারবেন না?

আব্বা বলেন, উনি আত্মীয় বলে চিনি জানি, ধরতে পারব, কত হোটেইল্যা টাকা মেরে দিয়ে চলে গেছে তাদের তো খোঁজও জানি না। ব্যবসায়ে এটা হয়ই, বাদ দেও।

কিন্তু আম্মা বাদ দেন না। তিনি আমাকে বলেন, তোমার আব্বার কথা বাদ দেও। তুমি তোমার জাহাঙ্গীর নানার অফিসে যাও। গিয়া আমাদের কষ্টের কথা বলো। আমার বিশ্বাস তিনি টাকাটা দিবেন।

আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। সারাদিন ঘোরাঘুরি করি, কবিতা লিখি আর টিউশনি করি। হাতে অফুরন্ত সময়। এখন গুলশান লেইকের ওপারে, রামপুরা ব্রিজের ওপারে, শহরের ব্যস্ত এলাকাগুলোতে ঘোরাঘুরি করতে বেশ ভালোই লাগে।

একদিন সকালে খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে পড়ি। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ধানমণ্ডির ইউএনডিপি অফিসে পৌঁছে যাই। অন্যান্য অফিসের মতো ইউএনডিপি অফিসে কেউ চাইলেই ঢুকে যেতে পারে না। যার কাছে যাবো রিসেপশনে তার নাম বলতে হয়। তিনি এসে ভিজিটরকে ভেতরে নিয়ে গেলে তবেই যেতে পারে।

আমার পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেছে। রিসেপশনে নাম বলতেই চৌকষ রিসেপশনিস্ট তাকে ফোন করেন। প্রায় ত্রিশ মিনিট বসে থাকার পর তিনি আসেন। আমি তাকে আগে কখনো দেখিনি, তিনিও আমাকে দেখেননি। একজন পাওনাদার অফিসে এসেছে টাকা চাইতে এটা জানার পর তার কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটা ভেবে আমি খুব বিচলিত আছি।

তিনি এসে তার ভিজিটরকে খুঁজছেন।
বাদল কে?
আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াই, আমি বাদল। কাজী মঙ্গল মিয়ার ছেলে।

ভেবেছিলাম এই পরিচয় শুনে তার মুখ কালো হয়ে যাবে কিন্তু না, তার মুখ আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি তার গ্রামের, তাদের অঞ্চলের মানুষদের খুব ভালোবাসতেন। পরবর্তীতে তিনি ও তার ছোটো ভাই কাজী আলী রেজা, জাতিসংঘেরই একজন কর্মকর্তা, মিলে গ্রামে  স্কুল, মসজিদ ইত্যাদি করেছেন।

টাকা না পাওয়ার দোষটা তার নয়, আব্বারই। আব্বা কখনোই তার পাওনা টাকা কারো কাছে চাইতে পারতেন না।

আমি বলি, নানা, আমার কিছু কথা আছে, আপনি যদি আমাকে দশ মিনিট সময় দেন তাহলে খুব ভালো হয়।

তিনি বলেন, তুমি বাড্ডা থেকে আসছ?
হ্যাঁ।
নিশ্চয়ই খিদা লাগছে। আসো আমার সাথে।

তিনি আমাকে ইউএনডিপির ক্যান্টিনে নিয়ে যান। পাশে বসিয়ে আমাকে পেট ভরে ভাত খাওয়ান।

আমি বলি, আপনি খাবেন না?
আমার খিদা লেগে যায় ১২টা বাজলেই। আমি খেয়ে নিয়েছি। তুমি খাও।

খেতে খেতে আমি তাকে আমাদের পরিবারের ঋণের বোঝা, আমার টিউশনি করে ঋণ শোধ করার গল্প, এইসব বলি। আম্মা আমাকে এভাবেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সব মন দিয়ে শোনেন। শুধু শোনেন না, স্বীকার করেন যে আব্বা তার কাছে আড়াই হাজার টাকা পাবেন। এই টাকা তিনি অবশ্যই দিয়ে দেবেন। তবে আজ তার হাতে টাকা নেই, আমি যেন আগামী মঙ্গলবারে আসি, সেদিন টাকাটা দেবেন।

আমাকে তিনি রিসেপশন পর্যন্ত এগিয়ে দেন। বাসায় ফিরে আম্মাকে সব বলি। আম্মা খুব খুশি হন। বিশ্বজয়ের আনন্দ আম্মার চোখে-মুখে। এই টাকা পাওয়ার কোনো আশাই কেউ করেনি, সেখানে আগামী মঙ্গলবারে টাকা পাওয়া যাবে, এটা তো এক বিরাট ঘটনা। টাকার মূল্যটা বলি, তখন, উত্তর বাড্ডায়, আমরা যেখানে থাকতাম, ১ কাঠা জমির দাম ছিল মাত্র ১০ হাজার টাকা, কাজেই আড়াই হাজার টাকা তখন অনেক টাকা ছিল।

পরের মঙ্গলবারে ইউএনডিপি অফিসে গিয়ে যথারীতি রিসেপশনে তার নাম বলি। সেদিনও তার আসতে অনেক সময় লাগে। আমি যখন তন্ময় হয়ে নোটিশ বোর্ডে চাকরির বিজ্ঞাপনগুলো দেখছিলাম তখন তিনি পেছনে এসে দাঁড়ান।

কী নাতি, যাইবা নাকি নিউইয়র্ক?
আমি তখন নিউইয়র্কে, জাতিসংঘ সদর দফতরে, কোনো একটি পোস্টে লোক নেবে এইরকম একটি বিজ্ঞাপন পড়ছিলাম। তার এই প্রশ্নে কটাক্ষ ছিল, তাচ্ছিল্যও ছিল, অন্তত তখন আমার তা মনে হয়েছিল এবং এই তাচ্ছিল্য আমার মধ্যে একটা সংকল্প তৈরি করে, হ্যাঁ, জাতিসংঘ সদর দফতরে, নিউইয়র্কে, আমি চাকরির জন্য আবেদন করবো এবং আমার সেখানে চাকরি হতেই হবে। ঠিক সেই দিন থেকেই এটিই আমার পেশাগত জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে যায়।

জাহাঙ্গীর ভাই তার ওয়ালেট বের করে আমাকে ৫০০ টাকা দেন। বলেন, প্রতি মাসে বেতন পেলে তিনি ৫০০ টাকা করে দেবেন, এভাবে ৫ মাসে ঋণটা শোধ করবেন।

একবারে পুরো টাকা না দিয়ে এভাবে ভেঙে ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাবে আমি বরং খুশিই হই। এতে করে আমি এই সুন্দর অফিসটিতে অনেক দিন আসতে পারবো এবং এই অফিসটি সম্পর্কে অনেক বেশি জানতে পারব। পরবর্তীতে আমি ওই অফিসে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে খবর দিতাম না। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে নোটিশ বোর্ডের সব বিজ্ঞাপন, প্রজ্ঞাপন, বিভিন্ন কর্মসূচির খবর এইসব মন দিয়ে পড়তাম। পড়া শেষ হলে তাকে খবর দিতাম।

নোটিশ বোর্ডে দেখি ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ দিবসে প্রতীষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠান। দেখে খুব ভালো লাগে। কারণ সার্টিফিকেট অনুযায়ী এটা আমারও জন্মদিন। মনে মনে ভাবি, আমার জন্মদিনে যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে তার সঙ্গে নিশ্চয়ই প্রকৃতি আমার বন্ধনও তৈরি করে রেখেছে।

মাঝে মাঝে জাহাঙ্গীর সাহেবকে পেতাম না। আমার এমনও সন্দেহ হতো হয়তো ভেতরে থেকেই `নেই` বলে দিয়েছেন, শত হলেও আমি তো পাওনাদার। ৫ মাসে নয়, টাকাটা পেতে ওই অফিসে আমাকে প্রায় দুই বছর যেতে হয়েছিল। তবে পুরো টাকাটাই তুলে আনতে পেরেছিলাম। এই সাফল্য আম্মার আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দেয়। আম্মা তখন অন্যান্য আরো যাদের কাছে আব্বা টাকা পাবেন তাদের নাম, ঠিকানাও চেয়েছেন কিন্তু আব্বা আর কারো নামই বলেননি। আমি মনে করি না বলে আব্বা ভালোই করেছেন, অচেনা লোকদের কাছে টাকা চাইতে গিয়ে আমি বিপদগ্রস্তও হতে পারতাম। চলবে