
হুমায়ূন কবির
বাঙালির আত্মদর্শনের রূপকার হুমায়ূন কবির
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : আগস্ট ১৮, ২০২৫
হুমায়ূন কবিরের সহোদর আকবর কবির তার ‘নানা বিষয়’ বইতে লিখেছেন, আমাদের ফরিদপুর অঞ্চলে যারা বয়স্ক তাদের একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, ব্রিটিশ সরকার আম্মাকে রত্নগর্ভা উপাধি দিয়েছে। অনেকের মতে, তিনি একটা মাসোহারাও নাকি পেতেন। রত্ন অবশ্য তিনি একটা প্রসব করেছিলেন, হুমায়ূন কবির, তবে এই উপাধি বা ভাতা কিছুই ব্রিটিশ সরকার দেয়নি। এগুলো দেশবাসীর হৃদয়ের দান।
এক.
হুমায়ূন কবির ছিলেন বাঙালির আত্মদর্শনের সার্থক রূপকার। তিনি কবি, সমকাল মেধাবী এবং শিল্পের যুগনিষ্ঠ সাধক। জ্ঞানবিমুখ আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যখন ফিরে তাকাই বিগত শতাব্দীর প্রারম্ভিক অধ্যায়পর্বে, বিস্ময়ে দেখি, কী রকম উদার আকাশ তিনি মেলে দিয়ে গেলেন আমাদের আবহমান বাংলা কবিতায়, চিন্তা ও মনীষায়। তার সাহিত্যসম্ভার আমাদেরকে দেয় চিন্তার প্রসারতা।
বাংলা সাহিত্যের মহৎ লেখক হুমায়ূন কবির জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি, ফরিদপুর শহরের অদূরবর্তী কমরপুর গ্রামে। তার প্রকৃত নাম হুমায়ূন জহির উদ্দিন আমির-ই-কবির। পিতা কবির উদ্দিন আহমদ ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। হুমায়ূন কবিরের পিতা ও পিতামহ দুজনই ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি লাভ করেছিলেন। মাতা সাজেদা কবির ছিলেন মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত ডাশার গামের খোন্দকার সুলতান হোসেনের কন্যা।
পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কবি সুভাস মুখোপাধ্যায় ‘ঢোল গোবিন্দর আত্মদর্শন’ বইতে লিখেছেন, “সন্ধে হতেই লণ্ঠন হাতে লোক পাঠিয়ে হুমায়ূনদার মা আমাকে আর দাদাকে ডেকে নিয়ে যেতেন, আর থাকতো ফিরোজ। আমাদের নিয়ে বসতো ওঁর গল্পের আসর। কিসের গল্প বলতেন সে আর এখন মনে নেই।
হুমায়ূন কবির যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তার পিতামহ আমিরউদ্দিন আহমদ খান বাহাদুর বেঁচে ছিলেন। কবিরউদ্দিনের মা ছিলেন প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক ও ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তউল্লাহর পুত্র পীর মোহসিনউদ্দিন আহমেদ দুদু মিয়ার কন্যা। স্বভাবতই বাবা ও মা, উভয় কুল থেকেই হুমায়ূন কবির দেশপ্রেম, সাধারণ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ও জ্ঞানচর্চার প্রতি প্রেরণা লাভ করেছিলেন।
হুমায়ূন কবিরের রক্তে ছিল বনেদি ঐতিহ্য। সে সময় ফরিদপুরে যে কয়টি নামকরা পরিবার ছিল তার ভেতর কবির পরিবার ছিল সুবিখ্যাত। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের উদ্দেশ্যে আবারও বলা যেতে পারে, হুমায়ূনের পূর্বপুরুষ জিয়ানউদ্দিন খান কোনো এক সময়ে আফগানিস্তানের ফরগনা থেকে প্রাসা-ষড়যন্ত্রের মুহূর্তে কয়েকজন অনুগামীসহ বঙ্গদেশের ফরিদপুরে এসে পৌঁছান। এখানকার মানুষ ও প্রকৃতি তাকে আকৃষ্ট করে এবং তিনি টেপাখোলায় ডেরা স্থাপন করেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন কমরপুরে এসে উপস্থিত হন। বিশেষ একটি ঘটনায় তার সততা দেখে স্থানীয় জোয়ারদার নিজ কন্যাসহ কিছু জমি তাকে প্রদান করেন বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে।
ছাত্রজীবনে হুমায়ূন কবির ছিলেন কিংবদন্তির নায়ক। ছেলেবেলা থেকেই তিনি অনন্য সাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। ছাত্র অবস্থায় বহুক্ষেত্রে প্রথম হওয়ার গৌরব তিনি অর্জন করেন। তিনি নওগাঁর কে.ডি স্কুল থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মেট্রিক এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকারী প্রথম মুসলমান তিনি।
অধ্যায়ন শেষে শিক্ষাকতার মানসে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ট যান। সেখানে একসেটার কলেজে দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে বি.এ (অনার্স) পরীক্ষাতেও তিনি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন। অধ্যায়নের পাশাপাশি তিনি নিজেকে একজন তুখোড় ছাত্রনেতা ও বাগ্মীরুপে গড়ে তোলেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের আমন্ত্রণে তিনি অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের প্রভাসক হিসেবে যোগদান করেন। এক বছর পর চলে আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে অবস্থানকালে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চা ও ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। তৎকালীন দেশের সামগ্রিক অবস্থাই মূলত তাকে রাজনীতির অঙ্গনে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
উপমহাদেশে হুমায়ূন কবির প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইমানুয়েলের কান্টের অপ্রকাশিত মূল জার্মান গ্রন্থ Ueber philosophic ueber hault ইংরেজি অনুবাদ করেন। বর্হিদেশে অনুষ্ঠিত ভারতীয় দর্শন-কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার একমাত্র গৌরব তিনি অর্জন করেন। প্রথম ভারতীয় সাহিত্য সম্মেলন ও প্রথম এশীয় সাহিত্য কনভেনশনের সভাপতি ছিলেন হুমায়ূন কবির। তিনিই প্রথম ভারতীয় যাকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় শিক্ষা কনফারেন্স উদ্বোধন করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রথম এশিয়া ইতিহাস কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন তিনি এবং তিনিই একমাত্র সাহিত্য ও দর্শন সেবক, যিনি ভারতীয় বিজ্ঞান সংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। হুমায়ূন কবির প্রথম এশীয়, যাকে অক্সফোর্ডে হার্বাট স্পেনসারের ওপর বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এক্ষেত্রে তার পূর্বসূরীদের ভেতর ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন ও বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো মনীষীরা।
রাজনীতি সচেতন হুমায়ূন কবিরের মানবিক মূল্যবোধ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। তিনি যখন স্কুলের ছাত্র তখন থেকেই নৈশ বিদ্যালয় ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। অক্সফোর্ডে থাকার সময় তিনি সহপাঠীদেরকে কিভাবে অনুপ্রাণিত করতেন সেই বিষয়ে জানা যায় বিখ্যাত সাংবাদিক ডি.এফ কারাকারের I go west বইতে: But the power behind us all was Humayun Kabir… one of the greatest products of modern oxford.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যখন কালুখালী ভাটিয়াপাড়া রেললাইন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক চলাচলের জন্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সময় হুমায়ূন কবির এক প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই আন্দোলনের ঢেউ এতই তীব্র ছিল যে, ব্রিটিশ সরকার ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। তিনি ছিলেন শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির সদস্য। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি মওলানা আবুল কালাম আযাদের রাজনৈতিক সহকারী ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক জীবনের বৈচিত্র্যের কারণে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে প্রথমে রাজ্যসভায়, পরে লোকসভায় নির্বাচিত হন। প্রায় দেড় দশক হুমায়ূন কবির পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু ও শাস্ত্রী মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
হুমায়ূন কবিরের বইয়ের সংখ্যা ৪৭। উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে: গান (১৯২৬), স্বপ্নসাধ (১৯২৭), সাথী (১৯৩৮), অষ্টাদশী (১৯৩৮), বাঙলার কাব্য (১৯৪২) এবং নদী ও নারী (১৯৫২)। ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত ‘বারোমাসি’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। এছাড়া মৃত্যুর আগপর্যন্ত উচ্চাঙ্গের ত্রৈমাসিক ‘চতুরঙ্গ’ প্রকাশ করেছেন, যার সম্পাদকও ছিলেন তিনি।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে তিনি তার সহপাঠিনী ও প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী শান্তিদাসকে বিয়ে করেন। তাদের এক পুত্র ও এক কন্যা। হুমায়ূন কবির ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট ৫৩ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নয়াদিল্লিতে পরলোক গমন করেন। দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়ার প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুতে সুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ ২১ আগস্ট ১৯৬৯- এ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন, হুমায়ূন কবির পূর্ববাংলার সন্তান। পাক ভারতের প্রতিভা ভাণ্ডার, এটা পূর্ব বাংলারই অবদান। তার অকাল মৃত্যুতে শুধু ভারতের অপূরণীয় ক্ষতি হয় নাই, পুর্ব বাংলারও নিদারুণ ক্ষতি হইয়াছে।
দুই.
হুমায়ূন কবিরের যে সময়, তখন ভারতীয় মুসলমান সমাজ ছিল অনেক পিছিয়ে। কী শিক্ষায়, কী মনন চর্চার সামগ্রিক রূপরেখায়। তাদেরই পাশাপাশি হিন্দু সমাজ শ্রম কুশলতায় উত্তরোত্তর উৎকর্ষতার দিকে এগিয়ে গেছে। দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের কুফল হিসেবে এরই মধ্যে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় তৈরি হয়ে গেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। হুমায়ূন কবির ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। আজকে আমরা শুনে থাকি যে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা পৌঁছে দিতে না পারলে জাতির কল্যাণ সম্ভব নয়। কিন্তু বলা পর্যন্তই। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বিস্তার আমাদের চোখে তেমনভাবে পড়ে না। তবে সত্যি যে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে। বলাবাহুল্য, হুমায়ূন কবিরও তার সময়ে এ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। একই দেশের আলো, হাওয়া ও মাটিতে বেড়ে উঠে আমাদের সহোদর হিন্দুরা নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে পরিশ্রম করছে, অথচ মুসলমান সমাজ বসবাস করছে স্থবিরতার ভেতর।
হুমায়ূন কবির বিশ্বাস করতেন, এ দেশীয় মুসলমানদের পশ্চাৎমুখিতার অন্যতম কারণ শিক্ষা-বিমুখতা। তিনি বিচলিত বোধ করতেন তাদের দিকে চেয়ে। বিশেষ একটি শ্রেণি বিলাসের মৌজে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে, আর অন্যেরা জীবন বলতে কেবল বেঁচে থাকাকেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই সংখ্যায় ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত আল মোয়াজ্জিন পত্রিকায় প্রকাশিত Mussalmans and Education প্রবন্ধে হুমায়ূন কবির লেখেন, It is often said that education in india has proved a failure in support of this awazing statement it is argued that the number of educated unemployed in continually on the increase and if education cannot solve even the problem of livelihood, of what earthy use is it to anybody? Further, education in india has meant literacy and mere literacy is not in itself an end for which all this sacrifice of energy, wealth and ambition can be justified.
উল্লেখ্য, শিক্ষার স্বরূপ কী হবে, কোন উপায়ে আমাদের মতো করে শিক্ষাকে প্রয়োগ করতে হবে, এ বিষয়েও তিনি যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করতেন। যার প্রমাণ আমরা পাই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে আল মোয়াজ্জিনে প্রকাশিত Some notes on educations প্রবন্ধে। এ প্রবন্ধে তিনি স্যার পি.জি. রায়ের ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় অসন্তোষের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। বারবার যে প্রসঙ্গে তিনি ফিরে এসেছেন সেই প্রসঙ্গ হচ্ছে, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে যদি সাধারণ মানুষের মতো করে তাদের জীবনচর্চার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উপস্থাপন করা না যায় তাহলে শিক্ষার কার্যক্রম ব্যর্থ। যে কারণে অনেকের ধারণা আছে যে, ভারতের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত না হয়ে মূর্খ থাকাই সুস্থতার জন্য সহায়ক।
এ দেশের মানুষকে খুব ভালোভাবেই বুঝতেন হুমায়ূন কবির। প্রকৃতির সাথে তার ছিল গভীর সখ্য। দেশের মানুষের ভেতরটা তিনি সহজেই উপলব্ধি করতে পারতেন। যার উদাহরণ বাঙালির ভৌগোলিক, নৃতাত্তি¡ক ও মনোজগতের পরিচয় বহনকারী অসামান্য গ্রন্থ ‘বাংলার কাব্য’। নদীর সঙ্গে বাঙালির যোগাযোগ সুপ্রাচীন। নদীকে কেন্দ্র করে বারবার ভেঙে গেছে মানুষের বসতি, আবার নদীকে কেন্দ্র করেই বারবার বসতি গড়ে তুলেছে মানুষ। হুমায়ূন কবির লিখেছেন, ‘অনিবার্চনীয়য়ের আস্বাদে অন্তর সেখানে উন্মুখ ও প্রত্যাশী, জীবনের প্রতিদিনের সংগ্রাম ও প্রচেষ্টাকে অতিক্রম করে প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণ।’
প্রকৃতি ও নৈসর্গিক রূপ-বৈচিত্র্যে, বিরোধ ও ভাঙা-গড়ার নিয়ত টানাপড়েনে এ দেশের নদীর রূপ চমৎকার এক শিল্প-মোহগ্রস্থতারই দৃশ্যপট। নদীগুলোর দিগন্ত ছুঁয়ে যাওয়া ঢেউয়ের সৌন্দর্য ও সংক্ষুব্ধতা কিংবা প্রলয়ঙ্করী রূপ এ দেশের মানুষকে ভাবুক হিসেবে গড়ে তুললেও একেবারে উদাসী করে তোলেনি। হুমায়ূন কবির দেখিয়েছেন, বাংলা কবিতা চর্চা করতে হলে অবশ্যই আমাদের বাঙালির জাতিগত ইতিহাসের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলার কাব্যলোকে যে নিসর্গপ্রীতি, প্রকৃতির প্রকাশের মধ্যে লোকাতীতের যে সন্ধান, তাকে আর্যরক্তের দান মনে করলে বোধহয় অন্যায় হবে না। ইতিহাসের শুরু থেকে মোঘল রাজত্বের প্রায় অবসান পর্যন্ত বারবার যে আর্য অভিযান, বাংলার কাব্য সৃষ্টিতে তার প্রভাব কম নয়। নানা দিক থেকে বাংলার মানুষকে সংসারমুখি ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে বাংলা সাহিত্যের অপরূপ বিকাশে তা সহায়তা করেছে।’
আজকের সময়ে বাংলা কবিতায় নানা মাত্রিক পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালানো হচ্ছে। কবিতার বাঁক বদলের উপযুক্ততা খুঁজে অনেক নিষ্ঠাবান তরুণ কবিতার নতুন উৎপ্রেক্ষা, আঙ্গিকের পরিবর্তন ও ভাষার সাবলীল আর্তিকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে। মোট কথা, এ সময়ের বাংলা কবিতায় তরুণ প্রতিভারা বাংলা কবিতা নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা-নীরিক্ষায় মগ্ন হয়েছেন। অথচ আমরা কি কখনো খুঁজে দেখেছি, আমাদেরই একজন পূর্বপুরুষ হুমায়ূন কবির বাংলা কবিতার নীরিক্ষায় জায়গাটি তৈরি করে দিয়ে গেছেন অনেক আগেই? ‘বাংলার কাব্য’ এর ভূমিকায় হুমায়ূন কবির লিখেছেন, ‘সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার কাব্যধারার বিস্ময়কর বিকাশের পরিপূর্ণ পরিচয় দেওয়ার দিন আজও বোধহয় আসেনি। তার জন্য ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও সামগ্রিক যে তথ্য সঞ্চয়ের প্রয়োজন তাও আজ পর্যন্ত অসমাপ্ত। সে বিষয়ে অভাববোধও বেশি দিনের কথা নয়। অথচ সেই পশ্চাৎপর্বের অভাবে বাংলার কাব্যে বাঙালির মানসের বিকাশ পুরোপুরিভাবে বোঝা যায় না। কারণ, ব্যক্তির মধ্যে সমাজ মনের প্রকাশেই কাব্যের জন্ম।’
হুমায়ূন কবিরের উপন্যাসের সংখ্যা মাত্র একটি। সংখ্যার বিচারে নয়, শিল্পের মানগত উৎকর্ষতায় যদি সেটার শিল্পমূল্য নিরূপণ করা হয়, নিঃসন্দেহে ‘নদী ও নারী’ বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাসগুলোর মধ্যে নিজেকে স্থান করে নেবে। মানুষের জীবনযাপনের সামগ্রিক রূপরেখা কিংবা কোনো একটি বিশিষ্ট দিককে ধরে পূর্ণাঙ্গ আলোচনাই হচ্ছে উপন্যাসের ভিত্তি। ‘নদী ও নারী’ও এই আঙ্গিতেই এগিয়ে গেছে। পদ্মাপাড়ের কৃষক জীবনের সহজ সরল ঘটনার ভেতর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে পাঠকঘনিষ্ঠ কয়েকটি চরিত্র। নজু মিয়া, আসগর মিয়া, মালেক ও নূরুর জীবনযাপনের চালচিত্র যেন আবহমান বাংলারই প্রতিচ্ছবি। একজন সার্থক ঔপন্যাসিকের মূল্যায়ন হলো ভাষার জাদু। কিংবা বলা যেতে পারে, কোনো একটি ঘটনাকে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য রূপে উপস্থাপন করা। ‘নদী ও নারী’র লেখক সে বিষয়ে পারঙ্গম।
একটু পড়া যাক তার ভাষার সরলীকরণ, ‘আয়েষা একধারে দাঁড়িয়ে ছিল, নজু মিয়াকে ডেকে পাঠালো। বলল, তোমার কি ভিমরতি হয়েছে? খামখা বাহাদুরি করে বিপদ ডেকে এনো না। মালেক এখনো কচি বাচ্চা। খোদা না করে, তোমার একটা কিছু বিপদ-আপদ হলে তাকে দেখবে কে? বুড়ো মায়ের কথা না ভাবো, অন্তত নিজের ছেলের কথা মনে রেখো।’
ভাষার উৎকর্ষতা, চরিত্র চিত্রণ ইত্যাদি দিক থেকে হুমায়ূন কবির প্রথম সারির ঔপন্যাসিক, সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যা পারেননি তা হচ্ছে, কাহিনির সঙ্গে সেই বিশেষ অঞ্চলের জীবনসমগ্রকে যুক্ত করতে। মনে করা যেতে পারে, সাধারণ মানুষের যাপিতজীবনের সাথে খুব বেশি বাস্তব অভিজ্ঞতা তার ছিল না। সারা জীবন পড়াশোনা আর নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ কাজেই তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটে গেছে। বৃহত্তর জনস্রোতে মিশে যাওয়ার সুযোগ সেভাবে হয়তো তার জীবনে তৈরি হয়নি। এই অনভিজ্ঞতাই হয়তো কারণ। তবে এও সত্যি, কাহিনি বুনতে গিয়ে চরিত্রের যে বাস্তবতার যে প্রতিবেশ তিনি নির্মাণ করেছেন সেই বাস্তবতা জীবনের বাস্তবতা না হলেও শিল্পের বাস্তবতা। কথাসাহিত্য তো আর জীবনের বাস্তবতা নয়, শিল্পেরই বাস্তবতা।