
বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ
পর্ব ৫
মলয় রায়চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯
বিনয় যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন তখন সত্যব্রত চৌধুরী নামে তার এক সহপাঠী ছিল। সত্যব্রতর বাবা ছিলেন ময়মনসিংহের জমিদার। সত্যব্রতর দাদা শ্রীপতি চৌধুরী ছিলেন সিনেমার হিরো। কবি বিমল চন্দ্র ঘোষ তখন সিনেমার গান লিখতেন। সত্যব্রত চৌধুরী বিনয়কে বিমলচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দ্যান। বিমলচন্দ্র ঘোষ, বিনয় জানিয়েছেন, থাকতেন যদু ভট্টাচার্য লেনে এবং শীত গ্রীষ্ম যাই হোক, লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকতেন। পাশে একটা বিরাট আকারের অ্যাশট্রে। তাতে অজস্র ক্যাপস্ট্যান সিগারেটের টুকরো। উনি বিনয়কে বলেছিলেন, তোমার কবিতা আমাকে দেখাবে তো। তখন প্রত্যেক রবিবার বিনয় যেতেন বিমলচন্দ্র ঘোষের বাড়ি। বিমলচন্দ্র ঘোষ কয়েকটা কবিতা প্রকাশ করেছিলেন ‘বারোমাস’ পত্রিকায়। বিমলচন্দ্র ঘোষের আগে রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন বিনয়। কবিতার খাতা দিয়ে এসেছিলেন। রমাপদ চৌধুরী তখন ‘ইদানীং’ নামের একটা পত্রিকা বার করতেন। রমাপদ চৌধুরী কয়েকদিন খাতাটা রেখে বিনয়কে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, তুমি লিখে যাও, লিখে যাও।
বন্ধু মনোজ বিশ্বাসকে বিনয় মজুমদার একবার বলেছিলেন, ‘জানিস, মজুমদার পদবিটা নবাব-বাদশার কাছ থেকে পাওয়া যেত। আমার মনে হয়, ওরা যদি বুদ্ধি করে মজুমদার না দিয়ে, মজুতদার দিতো, তাহলে খুব মানানসই হতো— বিনয় মজুতদার। কি রে, মজুতদার দিলে ভালো হতো না? দেখ না, কত যন্ত্রণা, কষ্ট, নিঃসঙ্গতা, ব্যথা সব একটা খাঁচার মধ্যে মজুত করে বসে আছি!’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানিরা মিয়ানমার আক্রমণ করলে আরও বহু বাঙালি পরিবারের সঙ্গে বিনয় মজুমদারের বাবা বিপিনবিহারি মজুমদার (বিনয়ের মায়ের নাম বিনোদিনী, ঠাকুরনগরের শিমুলপুর গ্রামে তাদের বাড়িটির নাম ‘বিনোদিনী কুঠি’) ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে ফিরে এসে বর্তমান বাংলাদেশে ঢাকা ডিভিশনের গোপালগঞ্জ উপজেলার (সে সময়ের ফরিদপুর জেলা) বৌলতলিতে তাদের আদি নিবাসে বসবাস আরম্ভ করেন। বিনয়ের ঠাকুর্দার নাম নিমচাঁদ। বিনয়ের বাবা মারা গেছেন ৯৩ বছর বয়সে, ১৯৮৪ সালের ৪ জুলাই। তার ছয় মাস আগে মা মারা যান।
বেশির ভাগ বাঙালি যুদ্ধের সময়ে মিয়ানমার থেকে পায়ে হেঁটে বর্তমান বাংলাদেশে ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছে ছিলেন। বিপিনবিহারি মজুমদারও ছেলেমেয়েদের নিয়ে পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামে পৌঁছেছিলেন। বাংলাদেশের উপরোক্ত পত্রিকায় সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের বিনয় বলেছিলেন যে, ‘পাহাড় দিয়ে আমি হেঁটেছি যুদ্ধের সময়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে আমি নাগা খাসিয়া পাহাড়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে ফিরেছি।’ অত দীর্ঘ পথ সাড়ে সাত বছরের বালকের পক্ষে পায়ে হেঁটে অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না। একজন নাগা শ্রমিকের পিঠের ঝুড়িতে বসে বিনয়কে অনেকটা পথ পেরোতে হয়েছিল। তার স্মৃতিতে তিনি এই কবিতাটি লিখেছিলেন:
একটি নাগার কথা
একটি নাগার কথা মনে এল কেন যে হঠাৎ।
চা বাগানে মহিলারা যেমন ঝুড়িটি পরে, ফিতে
কপালে ঝুলিয়ে নিয়ে, তেমনি একটি ঝুড়ি পরে
সেই ঝুড়িটির ‘পরে আমাকে বসিয়ে সেই নাগা
হেঁটে হেঁটে আসছিল উনিশ’শ বিয়াল্লিশ সালে।
তার মানে নাগাটির পিঠে ঝুড়ি, ঝুড়ির উপরে আমি বসা,
ঝুড়িটি তো ঝুলছিল নাগার
কপাল থেকে ফিতের সাহায্যে তাই মনে পড়ে গেল।
এভাবে আমাকে বয়ে আনছিল উনিশ’শ বিয়াল্লিশ সালে।
শিমুলপুরে লেখা কবিতা– ২০০৫
বিনয়ের ভাইবোনদের সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। তার এক প্রয়াত অগ্রজ অনিল মজুমদারের তথ্য ছাড়া, যিনি মধ্যমগ্রামের হৃদয়পুরে বসবাস করতেন, এবং সম্ভবত মধ্যবয়সে অপ্রকৃতিস্থতায়, অর্থাৎ স্কিৎসোফ্রেনিয়ায়, আক্রান্ত হন। মেজো ভাই সুনীল কোথায় থাকতেন জানি না। দূর সম্পর্কের অথবা পরিচিত এক দিদি হাবড়ায় থাকতেন, এবং বিনয় মজুমদারের মৃত্যুর পর দিদির ছেলে উত্তম বিশ্বাস বিনয় মজুমদারের রচনাগুলো প্রকাশের দিকে খেয়াল রেখেছেন। পারিবারিক তথ্য প্রয়োজন এজন্য যে, মধ্যবয়সে তাদের পরিবারে অন্যান্য সদস্য ও আগের প্রজন্মের সদস্যরা অপ্রকৃতিস্থতায় ভুগেছিলেন কিনা। কেননা আমার এক কাকা এবং মেজ জ্যাঠা মধ্যবয়সে অপ্রকৃতিস্থতায় আক্রান্ত হন, আমার ঠাকুর্দার ছোটো ভাইও মধ্যবয়সে অপ্রকৃতিস্থতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
অপ্রকৃতিস্থ বলতে আমি পাগল বলছি না, অসংলগ্ন কথাবার্তা বা আচরণের কথা বলছি, স্কিৎসোফ্রেনিয়ার কথা বলছি। মস্তিষ্কের রোগ আর জিনগত রোগের মধ্যে পার্থক্য আছে। জিনগত রোগ সারাবার জন্য জিন এডিটিং অথবা জিন থেরাপি করতে হয়, যা আমাদের দেশে এখনও এসে পৌঁছোয়নি। তা সম্ভব না হলে পরিবারের সদস্যদের মাঝে বসবাস থেরাপির কাজ করে। স্কিৎসোফ্রেনিয়া মূলত একটি জিনগত রোগ, এই জিনগত রোগ হোমো স্যাপিয়েনদের দেহে প্রবেশ করেছিল বহুকাল আগে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে, যখন তাদের সঙ্গে নেয়ানডারথালদের সম্পর্ক ঘটে। বাংলাভাষায়, আমাদের দুর্ভাগ্য যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখলেই তাকে পাগল বা ক্ষ্যাপা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। ‘পাগল’ ছাড়া আর কোনো শব্দই নেই।
স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত বিদেশি কবি ও শিল্পীদের কথা আমরা জানি, যেমন আঁতোয়াঁ আর্তো, কনস্ট্যানটিন বাতিয়ুশনভ, রিচার্ড ব্রটিগান, ভিক্টর হিউগোর মেয়ে আদেলে হিউগো, ফিনল্যাণ্ডের কবি ইউনো কাইলাস, রাশিয়ার ব্যালে নর্তক ভাসলাভ নিজিন্সকি, লর্ড বায়রন, ডিলান টমাস, পাবলো পিকাসো, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গণিতজ্ঞ জন ন্যাশ যাঁর জীবনকাহিনি নিয়ে ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ নামের একটি ফিল্ম হয়েছিল। আর বলা বাহুল্য ভ্যান গগ। মধ্যবয়স থেকে এই বিকলনের কারণে পিকাসো অতিযৌনতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। পশ্চিমবাংলায় ঋত্বিক ঘটক, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, রামকিঙ্কর বেইজ মানসিক বিকলনে আক্রান্ত হয়েছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও চিকিৎসা করিয়েছেন লুম্বিনি পার্ক মানসিক চিকিৎসালয়ে।
তারা স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন না। তারাপীঠের বামাক্ষ্যাপার আচরণকে আমরা মনে করি সাধকের স্বাভাবিক দিনানুদৈনিক ব্যাপার, দাহরত শবের মাংসভক্ষণকে কেউই মস্তিষ্কবিকৃতি বলে মনে করেননি। রামপ্রসাদ সেন গঙ্গায় গলা পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন, হিসেবের খাতায় শ্যামাসঙ্গীত লিখতেন, আমরা কখনও ভাবিনি যে তাকে ইলেকট্রিক শক দিতে হবে। তার কারণ প্রাগাধুনিক কালখণ্ডে সাধকদের সেই কাজগুলোকে আমরা স্বাভাবিক মনে করতুম। অঘোরী এবং তান্ত্রিকদেরও বঙ্গসমাজে পাগল বলা হতো না। বিনয় মজুমদারকে বারবার পাগল বলা হয়েছে বলে তিনি অপমানিত, আহত ও বিরক্ত বোধ করতেন। বিনয় মজুমদারদের পারিবারিক পদবি ছিল মৃধা, এবং বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় তাদের গ্রামের বাড়িকে গ্রামবাসীরা মৃধাবাড়ি নামে চিনতো। ব্রিটিশ পি ডাবলিউ ডিতে চাকরি পাবার সময়ে বিনয়ের বাবা মৃধা পদবি ত্যাগ করে নবাবি আমলে পাওয়া মজুমদার পদবি নিয়েছিলেন।
অবিভক্ত বাংলায় ফিরে ১৯৪২ সালে বিনয় মজুমদার গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলতলির তারাইল পাঠশালায় ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হবার পর তাকে ভর্তি করা হয় ফরিদপুর হাই ইংলিশ স্কুলে। তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল স্কুলের ম্যাগাজিনে। কিন্তু বৌলতলিতে বেশিদিন বসবাস করা সম্ভব হয়নি। সুরাবর্দির ডায়রেক্ট অ্যাকশান ডের আহ্বানে হিন্দু ও মুসমান সম্প্রদায়ের মাঝে বহুকালের যে সম্পর্ক ছিল তা ভেঙে পড়া আরম্ভ হয়, ক্রমশ বৌলতলিতেও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার আরম্ভ হলে অন্যান্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে ১৯৪৮ সালে বিপিনবিহারী মজুমদারও ছেলেমেয়েদের নিয়ে হিন্দু উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতার উপকণ্ঠে ঠাকুরনগরের শিমুলতলা গ্রামে চাষের জমিজমা কিনে বসবাস আরম্ভ করেন।
ভারতে চলে এসে বিপিনবিহারী মজুমদার বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলেন। ২০১৬ সালে আমরা দেখেছি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের পরিবারদের ওপর আক্রমণ হয়েছিল, আর দুর্গাপুজো-কালীপুজোর সময়ে তাদের উৎসব ভণ্ডুল করে দিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও সেখানকার নামকরা কবি-লেখকরা সরকারি খুদকুঁড়ো পাবার আশায় মুখ খোলেননি। দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গের উচ্চবর্গের হিন্দু কমিউনিস্ট নেতারা দেশভাগ সমর্থন করেছিলেন। দেশভাগ হতেই সবচেয়ে আগে পালিয়ে আসেন তারা, সেখানকার নিম্নবর্ণ হিন্দুদের দিশেহারা করে দিয়ে, আর পশ্চিমবঙ্গে এসে সাম্যবাদের নামে গদি দখল করে বসেন। নমঃশুদ্র জনগণকে পূর্ব পাকিস্তানে ধরে রাখার জন্য জিন্নাহ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের আশ্বাসে বেশির ভাগ নিম্নবর্ণের পরিবার থেকে গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, যিনি নিজেও নমঃশুদ্র ছিলেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত করাচিতে বসবাস করে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা সহ্য করতে না পেরে ভারতে পালিয়ে আসেন, এবং লিয়াকত আলি খানকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
বিনয় মজুমদার জন্মেছিলেন মিয়ানমারের মেকটিলা অঞ্চলের তেডো শহরে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪, অর্থাৎ দেশভাগজনিত সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বৌলতলীর দাঙ্গায় ভিটা ছাড়ার সময়ে তার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর। মিয়ানমার ছাড়ার সময়ে তার বয়স ছিল সাড়ে সাত বছর। যুদ্ধ ও দাঙ্গায় আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দেশ থেকে দেশান্তর ও স্থান থেকে স্থানান্তর, এই বিপর্যস্ত জীবন কাটানোর দুঃসহ ঘটনাবলি বিনয় মজুমদারের শৈশব-কৈশোরের চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে থাকবে। স্কিৎসোফ্রেনিয়ার দুটি উৎসের কথা বলেছেন মনোবিদরা, পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির প্রভাবে স্কিৎসিফ্রেনিয়া জিনের প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা, এবং বংশপরম্পরায় পাওয়া জিন যা যৌবনে দেখা দেয়। মিয়ানমার থেকে পলায়ন, দেশভাগজনিত দাঙ্গার প্রভাব কিশোর বিনয়ের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করেছিল নিঃসন্দেহে। আমার মনে হয়, বংশের জিনগত প্রভাবও ছিল। কেননা বিনয়ের মৃত্যুর আগের দিন তার মধ্যমগ্রাম নিবাসী দাদা অনিলবরণ মজুমদারকে ‘কবিতীর্থ’ সম্পাদক উৎপল ভট্টাচার্য ফোনে মৃত্যুশয্যায় বিনয়ের শারীরিক অবস্থা জানানো সত্ত্বেও তিনি কোনো আগ্রহ দেখাননি; বরং বিরক্ত বোধ করেন তাকে জানাবার জন্য। চলবে