বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ৭

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯

বিনয় মজুমদারের নিজের কলমেই পড়া যাক কবিতার বিশ্বে তাঁর প্রবেশের কথা: কৈশোর থেকেই আমি কবিতা লিখতে শুরু করি। প্রথম কবিতা যখন লিখি তখন আমার বয়স তেরো বছর। নানা কারণে সেই ঘটনাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। কবিতাটির বিষয়বস্তু ছিল এই, এক পালোয়ান বাজি ধরে একটি চলন্ত মটরগাড়িকে টেনে পেছিয়ে নিয়ে এলো। এরপরেও আমি মাঝে-মাঝে কবিতা লিখতাম। কিন্তু ষোলো-সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত কী লিখেছিলাম, কবিতাগুলির দশা কী হয়েছিল, কিছুই এখন আর মনে নেই। তখন কলকাতার স্কুলে পড়ি। মাস্টারমশাইরা ঘোষণা করলেন যে, স্কুলের একটা ম্যাগাজিন বেরোবে। ছাত্রদের কাছে লেখা চাইলেন। আমি একটা কবিতা লিখে ফেললাম। তার একটা পঙ্‌ক্তি এখনও মনে আছে— ‘ভিজে ভারি হলো বেপথু যুথীর পুষ্পসার’। মাস্টারমশাইয়ের হাতে নিয়ে দিলাম। তিনি পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। কিন্তু কী জানি কেন, শেষ পর্যন্ত সে ম্যাগাজিন আর বেরোলো না। এর পরবর্তী সময়কার কবিতা লেখার ব্যাপার একটু বিশদ ভাবেই আমার মনে আছে। স্কুল ছেড়ে কলেজে এসে ভর্তি হলাম এবং আমার কবিতা লেখার পরিমাণও কিছু বাড়লো। আমার একটি খাতা ছিল। ডবল ক্রাউন সাইজের চামড়ায় বাঁধানো, কাগজের রঙ ইটের রঙের মতো। খাতাটি খুব মোটা। আমার সব লেখাই এই খাতায় লিখতাম। স্কুলে কবিতা লিখতাম কচিৎ-কদাচিৎ। কিন্তু কলেজে উঠে নিয়মিত লিখতে শুরু করি। লিখতাম বেশ গোপনে-গোপনে, যাতে কেউ টের না পায়। কারণ আমি কবিতা লিখি, একথা কেউ বললে খুব লজ্জা হতো আমার। কলেজের হোস্টেলে থাকতাম। ফলে অন্যান্য আবাসিকরা শীঘ্রই জেনে ফেললো যে, আমি কবিতা লিখি। আমার ঘরে দুটি সিট ছিল। আমার রুমমেটই বোধহয় ফাঁস করে দিয়েছিল খবরটা। আমাদের রান্নাঘরের দেয়ালে একটা নোটিসবোর্ড টাঙানো ছিল। হোস্টেল কর্তৃপক্ষের নোটিসগুলি ওই বোর্ডে আঁঠা দিয়ে সেঁটে লাগানো হতো। কিছু দিনের ভেতরেই ওই নোটিশবোর্ডে আমার লেখা কবিতাও সেঁটে দিতে লাগলাম— সবগুলিরই বিষয়বস্তু হোস্টেলের খাবারদাবার সম্বন্ধে ছাত্রদের অভিযোগ। সবই হোস্টেলের সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট সম্পর্কে লেখা ব্যঙ্গ কবিতা। পড়ে ছাত্ররা কিংবা সুপারিনটেনডেন্ট যে প্রশংসা করতো, তা নয়। ডালে কেন ডাল প্রায় থাকেই না, কেবল জল, মাংস কেন ঘন ঘন খেতে দেয়া হয় না— এ সবই ছিল নোটিশবোর্ডে সাঁটা কবিতার বিষয়বস্তু।

কলেজে একটা দেয়াল পত্রিকাও ছিল । খুব সুন্দর হাতের লেখায় শোভিত হয়ে পত্রিকাটি নিয়মিত বেরোতো। আমার লেখা কবিতা কিন্তু কখনও এ-দেয়াল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। সেই সময় আমার সব কবিতায় মিল থাকতো। মিলগুলি অনায়াসে মন থেকে বেরিয়ে আসতো। তার জন্য একটুও ভাবতে হতো না। কবিতা যখন লিখতাম তখন মনে হতো আগে থাকতে মুখস্থ করা কবিতা লিখে যাচ্ছি, এত দ্রুত গতিতে লিখতে পারতাম। এক পয়ার ভিন্ন অন্য সব ছন্দেই লিখতাম। কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু ছিল বিচিত্র, প্রায় সবই কাল্পনিক। দু’একটা বিষয়বস্তু অবশ্য আমার এখনও মনে আছে— চিল্কা হ্রদের ধারে এক সঙ্গিনীসহ বসে বসে চারপাশে নিসর্গকে দেখছি বা এক সঙ্গিনীসহ মোটরগাড়িতে করে খুব দ্রুত বেগে চলেছি, মনে হচ্ছে গাড়িটা পৃথিবীর এক উপগ্রহ বিশেষ বা ট্রেনে করে দৈনিক লক্ষ লক্ষ কেরানি কীভাবে চাকরি করতে কলকাতায় আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই সময়ে লেখা কবিতাগুলো খুব দীর্ঘ হতো। ছোটো কবিতা আমি প্রায় লিখতে পারতাম না। এবার একটু আগের কথা লিখে নিই। আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি, মনে হচ্ছে, তখনই সিগনেট বুক শপ নামক দোকানটি সবে খুললো। তখন দোকানের মালিক দিলীপবাবু নিজেই দোকানে বসে বই বিক্রি করতেন। কী করে যে তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো ঠিক মনে নেই। আমি তখন দৈনিকই ঐ দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতাম। বোধ হয় বই কিনতে গিয়েই আলাপটা হয়ে থাকবে। আমি প্রায় দৈনিক একখানা করে কবিতার বই তাঁর কাছ থেকে কিনতাম। রবীন্দ্রোত্তর যুগের বাছা বাছা কবিদের বই অনেক কিনে ফেললাম, পড়েও ফেললাম সব। অথচ কোনো কারণে সেই বইগুলি মনে বিশেষ সাড়া জাগাতো না। বয়স কম বলেই হয়তো অমন হতো। যাই হোক, ইংরেজি ক্লাসিকাল কবিদের বই আমি প্রায়শই লাইব্রেরি থেকে এনে পড়তাম। সেই বয়সে তাদের কবিতা আমার ততো ভালো লাগতো না। আবার মনে হচ্ছে বয়স কম বলে অমন হতো— একথা বোধহয় ঠিক লিখিনি। কারণ তখন রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুলির মধ্যে আমার ভালো লেগেছিল ‘প্রান্তিক’ নামক ছোটো বইখানি। এখনও আমার ঐ বইখানি সবচেয়ে ভালো লাগে। বয়স বাড়ার ফলে আমার সে অল্প বয়সের ভালো লাগা পাল্টায়নি। যা হোক, আমি নিজে কী লিখতাম সেইটেই এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু। বিষয়বস্তু লিখেই মনে পড়লো, কবিতা লেখার অন্যতম প্রধান ব্যাপার হচ্ছে, একটি ভালো বিষয়বস্তু মনে আসা। তখনকার বিষয়বস্তু ছিল অধিকাংশ কাল্পনিক, একথা আগেই লিখেছি। শহরের দৃশ্যাবলি— পথ ঘাট মাঠ বাড়ি— এসকল আমার কবিতার বিষয়বস্তুতে আসতো না।

মাঝে-মাঝে গ্রামে আসতাম। গ্রামের দৃশ্যাবলিও আমার বিষয়বস্তু হতো না। অর্থাৎ কেবল বর্ণনামূলক কবিতা আমি সেই বয়সেই লিখতে পারতাম না। এতদিন পরে এখন কিছু কিছু লিখতে পারি। এ প্রসঙ্গে পরে আবার আসবো। ইতিমধ্যে কলেজ পালটে অন্য এক কলেজে চলে যেতে হলো। সেখানে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা করতে হতো। সেখানে কলেজের পড়াশুনায় এত বেশি সময় দিতে হতো যে, অন্য কোনো বিষয়ে মনোনিবেশ করার সময় পাওয়া যেত না। ফলে বছর দুয়েক আমার কবিতা লেখা বন্ধ থাকলো। গঙ্গার ধারে কলেজ, পাশেই বোটানিক গার্ডেন। নদীর পাড়ে বিরাট কাঠগোলা। আন্দামান থেকে জলপথে নিয়ে আসা বিশাল বিশাল সব কাঠের গুঁড়িতে নদীর পাড় ঢাকা। সেখান থেকে গঙ্গার দৃশ্য অপূর্ব। কেবল বর্ণনামূলক কবিতা আমি তখনও লিখতে শিখিনি। ফলে সেই কলেজে থাকাটা আমার কাব্যচর্চার ভিতরে বিশেষ স্থান পায়নি। সেই কলেজে ছিলাম চার বছর ছাত্রাবাসে। তার প্রথম দু’বছর কবিতা লেখার সময়ই পাইনি। শেষ দু’বছর কিছু কিছু সময় পেতাম এবং মাঝে মাঝে লিখতাম। কাপড়ে বাঁধানো রয়াল সাইজের একটা প্রকাণ্ড ডায়েরি আমি যোগাড় করেছিলাম। মিল দিতে বিশেষ বেগ পেতে হতো না। মিল যেন আপনিই এসে যেত। এই কলেজে আসার পর আমি পয়ারে লেখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় নির্ভুল পয়ার আমি একবারও লিখতে পারতাম না। কোথায় ভুল হচ্ছে সেটি স্পষ্ট টের পেতাম। কিন্তু সে ভুল শোধরাবার উপায় খুঁজে পেতাম না। তখন থেকে শুরু করে চার বছর লেগেছিল আমার পয়ার লেখা শিখতে। এবং ১৯৬০ সালের শুরুতে আমি পয়ার লেখার নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কার করি। তারপর পয়ার ভিন্ন অন্য কোনো ছন্দে লিখিইনি। এখন পয়ারই আমার প্রিয়তম ছন্দ। শুধু পয়ারেই লিখি। নানা কারণে এখন আমার মনে হয়, কেউ নিখুঁত পয়ার লিখতে পারলেই তাকে কবি বলে স্বীকার করা যায়, স্বীকার করা উচিত।

যাই হোক, সেই বয়সের কথায় ফিরে যাই। আমাদের কলেজ থেকে ছাত্রদের সম্পাদনায় একটা বার্ষিক সাহিত্য সংকলন বেরোতো। তাতে আমার লেখা কবিতা চেয়ে নিতো। গোটা কয়েক কবিতা ছেপেছিল। এই কলেজে পাঠকালে লেখা কবিতায় কাটাকুটি আবির্ভূত হয়। আগে কাটাকুটি করার বিশেষ দরকার হতো না। এবার দরকার হতে লাগলো। কবিতায় অলঙ্কার বলতে আগে দিতাম শুধু উপমা। এবার কবিতায় উপমার সঙ্গে সঙ্গে প্রতীকও ব্যবহার করতে লাগলাম। সে সময়কার কবিতার খাতাগুলি আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। আমার যত দূর মনে পড়ে, ঐ কলেজে চার বছরব্যাপী পড়ার সময়ে আমি গোটা পঞ্চাশ কবিতা লিখেছিলাম। শুধু যে সময়াভাব এর জন্য দায়ী, তা নয়। কাব্যিক বিষয়বস্তুর অভাবও এর জন্য দায়ী। অনেক পরে আমি যে কোনো বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার করি। অনেক পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার বইয়ের এক সমালোচনায় লিখেছিল, আমি যে কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে পারি, এমনকি ‘গু-গোবর’ নিয়েও আমি সার্থক কবিতা লিখতে পারি। কিন্তু তখনও অবস্থা অমন হয়নি। সেই কলেজে পাঠকালে ভাবলাম কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক, আর কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক নয়। এখন আমার মনে হয়, ব্যাপারটা তেমন নয়। সব বিষয়বস্তুই কাব্যিক এবং যার দৃষ্টিতে এই কাব্যিকতা ধরা পড়ে, তিনিই কবি। এমনকি চিন্তা করার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, যে পদ্ধতিতে ভাবলে কাব্যিকতা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়। বিষয়বস্তুর মধ্যে কাব্যিকতা লুকিয়ে থাকে, তাকে বের করার জন্য চিন্তার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। এসব কথা আমি টের পাই, বুঝতে পারি, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের গোড়া থেকে। তার আগে জানতাম না।

যাই হোক, ১৯৫৭-ও শেষ হলো, আমার কলেজে পড়াও শেষ হলো। পাঠদশা শেষ হয়ে গেল। কলেজের ছাত্রাবাস ত্যাগ করে আমি শেষ অবধি কলকাতায় চলে এলাম। এই সময় কুশল মিত্র নামে এক কবির সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তার কবিতার বই তখন সবে বেরিয়েছে। যেদিন বেরোলো সেদিন তিনি বললেন, চলুন মিষ্টির দোকানে, আপনাকে মিষ্টি খাওয়াই। এই বইয়ের প্রকাশক দেবকুমার বসুর সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দিলেন। অধুনালুপ্ত ‘গ্রন্থজগৎ’ দোকানটি ছিল দেবকুমার বসুর। আমি মাঝে মাঝে দেবকুমার বসুর দোকানে গিয়ে বসে থাকতাম। আমি স্থির করলাম, আমারও একখানি বই প্রকাশ করা দরকার। কলকাতায় তখন নিজেকে একেবারে নবাগতর মতন মনে হতে লাগলো। কফির আসরে, আড্ডাখানাগুলিতে, আমি যেতাম আমার অফিস ছুটি হলে পর। দেখতাম, আলোচনার বিষয় সর্বত্রই সাহিত্য এবং রাজনীতি। অথচ বাংলা সাহিত্যের খবর আমি তখন রাখতাম না। রাখার সুযোগই হয়নি ইতিপূর্বে। ফলে আলোচনায় যোগদান করা আমার হতো না। চুপচাপ বসে শুনতাম কে কী বলে। তারপর ভাবলাম, আর কিছু না হোক, লোকজনের সঙ্গে মেশার জন্যই তখনকার কাব্যসাহিত্য কিছু পড়া ভালো। ফলে কিছু পড়াশুনা শুরু করলাম। এই সময় ‘দিগদর্শন’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে আমার জানাশোনা হয়। তিনি আমার কাছ থেকে কিছু অনুবাদ চেয়ে নিয়ে তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করলেন। অনুবাদগুলি কবিতার নয়, গদ্যের। এই সময়ে মোহিত চট্টোপাধ্যায় ও অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। ওঁরা তখন কবিরূপে অল্পপরিচিত। মোহিতবাবু তখন এমএ পড়তেন। আমি তখন সাহিত্য বিষয়ে আলোচনায় মোটামুটি যোগদান করতে শিখছি। আমার কোনো কবিতা আমি কোনো পত্রিকায় পাঠাতাম না। আপন মনে লিখে খাতাতেই রেখে দিতাম। দেবকুমার বসু আমার কবিতার বই প্রকাশ করতে রাজি হলেন। আমি তখন আমার পুরোনো কবিতার খাতা ফের পড়তে লাগলাম। পড়ে মনে হলো, গোটা পঞ্চাশ কবিতার মধ্যে কবিতাপদবাচ্য বলা যায় গোটা পাঁচেককে। মনটা খুব দমে গেল। তখন নতুন কিছু কবিতা লিখতে গেলাম। সব পয়ারে। বাছাই ইত্যাদি করে অত ছোটো একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করা যায় বলে দেখা গেল। দেবকুমারবাবু অতি সজ্জন। তিনি বললেন, চলুন দেবুদার কাছে, মলাট আঁকিয়ে নিয়ে আসি। চললাম তাঁর সাথে দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, বেলেঘাটায়। কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মুড়ি খেতে খেতে তিনি একটা ছবি এঁকে দিলেন। অতি সুন্দর হলো দেখতে। বই ছাপা হয়ে বেরোলো। মোট ষাট পাউন্ড অ্যান্টিক কাগজে ছাপা। জানাশোনা লোকেদের কয়েকজনকে দিলাম পড়তে। কিন্তু কেউ আমার কবিতা সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য শুরু করলো না, প্রশংসাও করলো না।

দেবকুমারবাবু নিশ্চয়ই সাময়িক পত্রিকায় দিয়েছিলেন। কেউ ভালো করে রিভিউ করলো না। সব চুপচাপ, যেন আমার বই প্রকাশিত হয়নি। এ-বইয়ের নাম ‘নক্ষত্রের আলোয়’। দেবকুমার বাবুর মাধ্যমে আমার বহু তরুণ কবির সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরাও আমার বই সম্পর্কে কোনো আলোচনা করতেন না। তবে এটা ঠিক যে, লক্ষ্য করে পড়ে দেখতাম অন্যান্য তরুণ কবির লেখা থেকে আমার কবিতা ভিন্ন প্রকারের, একই রকম নয়। আমার কবিতা বেশ পুরোনো ধাঁচের, সেগুলিকে ঠিক আধুনিক কবিতা বলা চলে না। এই সময় কবি বিষ্ণু দের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। কী করে হয়েছিল এখন আর তা মনে নেই। মোট কথা মাঝে মাঝে সন্ধ্যার সময়ে তাঁর বাড়িতে যেতাম। কোনো কোনো দিন কবিতার খাতা নিয়ে যেতাম। তিনি খাতা পড়ার জন্য রেখে দিতেন। তৎকালে ‘সাহিত্যপত্র’ নামে একটি পত্রিকা বেরোতো বিষ্ণুবাবুর তত্ত্বাবধানে। ঐ ‘সাহিত্যপত্রে’ আমার একটি কি দুটি কবিতা তিনি ছেপে দিয়েছিলেন। ‘নক্ষত্রের আলোয়’ বইখানা পাঠক-সমালোচক মহলে সমাদৃত না হওয়ায় আমি খুব ভাবিত হয়ে পড়লাম। অন্যান্য তরুণ কবির ঢঙে লেখা তো আর চাইলেই হয়ে ওঠে না। ফলে এরূপ চিন্তা আমি করতাম না। কলকাতার কোনো লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যোগাযোগ তো দূরের কথা, জানাশোনাই ছিল না। আমার বয়স তখন তেইশ-চব্বিশ। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ। এসময়ে লেখা আমার কবিতা বর্জন করে মন খুব বিষময়। এই ভেবে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ চলে গেল। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দটি চাকরি না করে শুয়ে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম। এই সময় প্রচুর বিদেশি সাহিত্য পাঠ করি। ধীরে ধীরে আমার মনে কবিতা রচনার একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আবির্ভূত হয়। এই ১৯৫৯ সালে আমায় বেশ কিছু অনুবাদ করতে হয়। পাইকপাড়া থেকে ‘বক্তব্য’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সম্পাদক ছিলেন বিমান সিংহ। আমি থাকতাম গ্রামে, আমার গ্রামের ঠিকানায় তিনি প্রায়ই চিঠি দিতেন অনুবাদ কবিতা প্রার্থনা করে। আমি অনুবাদ করে পাঠাতাম এটা ঠিক। কিন্তু তিনি আমার নিজের লেখা কবিতা কেন চান না— এ ক্ষোভ আমার মনে মনে থাকতো। কিছু বিরক্তও বোধ করতাম। আমি যে কবিতা লিখি সে কথা সম্পাদক জানতেন, ‘নক্ষত্রের আলোয়’ তিনি পড়েছিলেন। তবু কখনো আমার নিজের লেখা কবিতা চাইতেন না। এরপর ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের একেবারে গোড়ার দিকে আমি স্থির করলাম, সর্বান্তঃকরণে কবিতাই লিখি। চাকরি আপাতত থাক। গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে এলাম। সকালে জাগরণ থেকে শয়ন পর্যন্ত সারাক্ষণ কবিতাই ভাবতাম। আশপাশে শহরের যে দৃশ্যাবলি দেখতাম তার কোনো কিছু কাব্যিক মনে হলে তখনি নোটবুকে টুকে রাখতাম। ছোটো আকারের কবিতার নোটবই সর্বদাই প্যাণ্টের পকেটে রাখতাম। সৃষ্টির মূল যে সূত্রগুলি তা জড়ের মধ্যে প্রকাশিত, উদ্ভিদের মধ্যে প্রকাশিত, মানুষের মধ্যেও প্রকাশিত। এদের ভেতরে সূত্রগুলি পৃথক নয়, একই সূত্র তিনের ভেতর বিদ্যমান। এই সার সত্য সম্বল করে ভেবে দেখলাম, জড়ের জীবনে যা সত্য, মানুষের জীবনেও তা-ই সত্য। উদ্ভিদের জীবনে যা সত্য মানুষের জীবনেও তা-ই সত্য। অতএব জড় ও উদ্ভিদের জীবন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমি। এবং তাদের জীবনের ঘটনাকে মানুষের জীবনের ঘটনা বলেই চালাতে লাগলাম। এইভাবে শুরু হলো কবিতার জগতে আমার পথযাত্রা, আমার নিজস্বতা। এইভাবে সৃষ্টি হলো ‘গায়ত্রীকে’, ‘ফিরে এসো, চাকা’। চলবে