
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ২৩
প্রকাশিত : জুলাই ২৬, ২০২৫
আজ আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, অন্যান্য দিনের মতো আম্মা নাশতা বানাতে ব্যাস্ত নন। চুপচাপ বসে আছেন, যেন স্থির একটি প্রস্তরখণ্ড। তার দু’চোখ থেকে মেঘনা-যমুনা গড়িয়ে পড়ছে। আব্বা না খেয়ে বেরিয়ে গেলেন। অন্য ভাইবোনেরা আস্তে আস্তে জেগে উঠছে।
আমি জিগেশ করি, আম্মা কী হয়েছে?
আম্মা বলেন, সর্বনাশ হয়েছে। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।
আম্মা আমাকে কাছে বসিয়ে সব খুলে বলেন। আব্বার অনেক টাকা ঋণ। সেই ঋণ শোধ করার জন্য বাড়িটা বিক্রি করে দেবার ঘোষণা দিয়েছেন।
আমি বলি, এখনো তো দেয় নাই। আমরা আব্বাকে বুঝিয়ে বলবো। ঋণ শোধ করার অন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখবো। মামাদের বলবো, নানাকে বলবো।
আম্মা বলেন, তোমার আব্বা বলেছেন বিক্রি করবেন। আমার ধারণা বিক্রি অলরেডি হয়ে গেছে।
আম্মার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। আব্বা এরই মধ্যে বাড়িটা বিক্রি করে ঋণ শোধ করেছেন। তিনটি উৎস থেকে তিনি ঋণ করেছেন। একটি তার ব্যবসায়িক সহকর্মী, একটি পুরনো ঢাকার এক বন্ধু, অন্যটি শাহজাদপুরের এক ব্যবসায়ী। বাড়ি বিক্রি করে তিনি ব্যবসায়িক সহকর্মীর ঋণ শোধ করেছেন কিন্তু অন্য দুটি এখনো বাকি।
আম্মা আগেও আমাকে বলেছেন, সেদিন আবারও শপথ করান, আমি যেন জীবনে কখনোই ব্যবসা না করি। যদি খুব ছোটো চাকরি করতে হয় তবুও যেন চাকরিই করি।
আমরা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি কথাটা কয়েকদিনের মধ্যেই পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। হয়তো আম্মা প্রতিবেশী সোমার আম্মাকে কষ্ট লাঘবের জন্য বলে থাকবেন। তিনি হয়তো পাড়ার সব মহিলাকে `কাউকে বলবেন না কিন্তু` বলে কানে কানে বলে দিয়েছেন। এখন আমাদের ভাইবোনকে যে-ই যেখানে দেখে, তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায়।
কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, কী মিয়া তোমার আব্বা নাকি বাড়ি বিক্রি কইরা ফালাইছে। অহন থাকবা কই? দেশে যাইবা গা?
কেউ কেউ আবার সরাসরি বলে না, আমাদের শুনিয়ে অন্যদের সঙ্গে বলে, আহারে বাড়িটা বিক্রি কইরা দিলো!
আগে এলাকার যে কোনো বিষয়ে কথা বলার একটা ভয়েজ ছিল আমাদের, এখন আর সেটা নেই। কথা বলতে গেলে এমনভাবে সবাই তাকায়, যেন আমরা কেউ না, অন্য কোনো পাড়ার মানুষ, এই পাড়ার কোনো বিষয়ে কথা বলার কোনো অধিকার নেই আমাদের। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নানানভাবে অপমানিত হচ্ছি।
ভাওয়ালিয়া বাড়ির আব্দুর রাজ্জাকের বড় ছেলের নাম আব্দুল মজিদ। তিনি গুলশানে কোথাও চাকরি করেন। কী চাকরি করেন আমরা কেউ জানি না। ভোরবেলা মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে অফিসে যান। তার ছোটো ভাই কাইয়ুম আমার সমবয়সী,আমরা বন্ধু। কাইয়ুমের বড়জন তাহের ভাই, আমাদের খুবই প্রিয় একজন মানুষ।
এলাকার নানান বদ সমালোচনা ও অত্যাচার থেকে তাহের ভাই আমাদের সব সময় রক্ষা করেছেন। তিনি ছিলেন এলাকার যুবনেতা। যুবলীগ করতেন, শেষ পর্যন্ত মহানগর যুবলীগের সহ-সভাপতি বা এইরকম কিছু হয়েছিলেন। তাদের আরো এক ভাই আছে, তাহের ভাইয়ের বড়, শহীদুল্লাহ। শহীদুল্লাহ ভাই পুরোদস্তুর গৃহস্থ, গরু-ছাগল পালেন, হাল চাষ করেন।
একদিন মজিদ ভাই আমাকে রাস্তায় ধরেন। আমার বাহু ধরে টানতে টানতে রাস্তার এক পাশে নিয়ে যান। তারপর খুব নিচু স্বরে বলেন, তোমার আব্বায় কি সত্যিই বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে?
এইসব বিষয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি যেন কোনো উত্তর না দেই, আম্মার কড়া নির্দেশ ছিল। তিনি হয়তো ভেবে থাকবেন, এই অপমানজনক বিষয়টি নিয়ে উত্তর দিতে গিয়ে আমি কারো সঙ্গে কলহে লিপ্ত হতে পারি।
আমি মজিদ ভাইকে সত্যি কথাটাই বলি।
তিনি বলেন, তুমি এইবার আইএ পরীক্ষা দিছো না?
হ, দিছি তো।
আমার লগে একটা জায়গায় যাইবা?
কেন?
দেহি তোমারে একটা চাকরি দেওন যায় কিনা?
হ যামু, কবে?
খাড়াও, আমি আমার বসরে আগে জিগায়া লই, যদি রাজি হয় তাইলে তোমারে নিয়া যামু।
দুইদিন পর মজিদ ভাই নিজেই আমাকে খুঁজতে আসেন।
গুড নিউজ আছে। বস রাজি হইছে। কাল সকাল ৬টায় আমার লগে যাইবা। দুই, চারটা কথা কইবো, পছন্দ হইলে চাকরি পাক্কা।
কী চাকরি?
আমার স্যার বিরাট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। কত চাকরি তার কাছে, তোমারে ভালো কিছুই একটা দিব।
আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। এই সময়ে একটা চাকরি আমার খুবই দরকার। যার কাছে আব্বা বাড়িটা বিক্রি করেছেন তিনি আব্বাকে বলেছেন, আপনার বাড়ি আপনারই থাকবে। যখন টাকা জোগাড় করতে পারবেন, জানাবেন আমাকে, তখনকার বাজার দরে আবার নিয়ে নেবেন।
আমি দারুণ আশান্বিত হয়ে উঠি। হয়ত এই অপমানের হাত থেকে পরিবারটিকে উদ্ধার করতে পারবো।
পরদিন সকাল ৬টায় মজিদ ভাইয়ের সঙ্গে তার বসের কাছে যাই। গুলশান ২ নাম্বারে। ওখানে গিয়ে বুঝতে পারি মজিদ ভাই এই বাড়ির মালির কাজ করেন। তার বসের নাম শহীদুল্লাহ খান বাদল। তিনি রাশেদ খান মেননের ভাই। এই পরিচিয়টা অবশ্য অনেক পরে জেনেছি।
বাদল সাহেব তার বাড়ির মালির রেফারেন্সে আসা এক তরুণকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসান। চা নাশতা খেতে দেন এবং আমার জীবনের গল্প শোনেন।
তোমার আব্বা ব্যবসায়ে কেন সফল হয়নি তা কি বুঝতে পেরেছ?
সম্ভবত তিনি হিসাবে কাচা। আর খুব দয়ালু।
আমি যদি কিছু টাকা দেই, লোন দিব, তুমি তোমার আব্বার ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারবে না?
না, পারবো না।
কেন পারবে না। তুমি তো হিসাবে ভালো।
আমি ব্যবসা করবো না। চাকরি করবো। আপনি আমাকে একটা চাকরি দেন।
আমরা অনেকক্ষণ কথা বলি। মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম মজিদ ভাই যেভাবে আশ্বস্ত করেছেন ওখান থেকেই আমি চাকরিতে চলে যাব, বাসায় এসে আম্মাকে একটা সারপ্রাইজ দিব।
অনেক যুক্তিতর্কের পর বাদল সাহেব বলেন, আমি চাইলে এখনই তোমাকে একটা চাকরি দিতে পারি কিন্তু আমি তা করবো না। মানে আমি তোমাকে এই মুহূর্তে কোনো চাকরি দেব না। এখন চাকরি দেওয়া মানে তোমার জীবনটা নষ্ট করে দেওয়া। তুমি মাস্টার্স পাস করে আমার কাছে এসো, তখন তোমাকে চাকরি দেব।
আমি সর্বশেষ চেষ্টাটা করি, আগে তো আমাকে, আমার পরিবারকে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে হবে, তারপর পড়ালেখা।
তিনি বলেন, যত বিপদেই থাকো আমি জানি এসবের ভেতর দিয়েই তুমি এগিয়ে যাবে। চাকরিতে ঢুকলে আর তোমার পড়ালেখা হবে না।
বাদল সাহেবের বাসা থেকে ফিরে আসতে আসতে তাকে সারা রাস্তা গালমন্দ করেছি। আজ এত বছর পরে মনে হয় তিনি সেদিন ঠিক কাজটিই করেছিলেন। চলবে