
এরশাদ
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ২২
প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০২৫
মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন বাবুল ভাইয়েরা গড়ে তুলেছিলেন, তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্ররা এই নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হতে ক্রমশ এরশাদ বিরোধী একটি আন্দোলন গড়ে তোলে।
এরশাদ কিন্তু এতে ভীত হয়ে চুপচাপ বসে নেই। তিনি কবিদের, সুন্দরী নারীদের নিয়ে আমোদ-প্রমোদ করার পাশাপাশি ১৯৮৬ সালের প্রথম প্রহরেই একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে ফেলেন। হয়তো ভেবে থাকবেন বন্দুকের নল দিয়ে নয় রাজনীতিকে তিনি মোকাবেলা করবেন রাজনীতি দিয়ে।
`কুনঠে বাহে, জাগো সবায়` বলে রংপুরের ছেলে এরশাদ দেশবাসীকে ডাক দেন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে। পরে তিনি নিজেই এই বিষয়ে একটি গান লেখেন, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা/ নতুন করে আজ শপথ নিলাম/ নব জীবনের ফুল ফোটাব/ প্রাণে প্রাণে আজ দীক্ষা নিলাম।’
গানের প্রথম দুটি লাইন অসাধারণ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত। অমর সুরস্রষ্টা আজাদ রহমান গানটিতে দারুণ সুরারোপ করেন। তখনকার একমাত্র টেলিভিশন বিটিভিতে সংবাদের আগে এই গানটি সচিত্র প্রচার করা হতো। আমার মতো লক্ষ-কোটি তরুণ এই সঙ্গীত ভিডিওটি দেখে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।
এরশাদ তার নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি গঠন করে দেশের অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পদ-পদবী ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে দলে ভেড়ান। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান চৌধুরী ও বিএনপির মওদুদ আহমদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দুজনকেই এরশাদ পালাক্রমে তার প্রধানমন্ত্রী করেন। এছাড়া শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কাজী জাফর আহমদ প্রমুখ রাজনীতিককে তিনি দলে ভেড়ান।
১৯৮২ সালে এরশাদ যদি বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে তার পদ থেকে সরিয়ে না দিতেন তাহলে হয়তো বাংলাদেশে এই ভয়াবহ পরিবারতন্ত্রের উত্থান ঘটত না। শেখ মুজিব যেভাবে নেপোটিজম করে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিজের পরিবারের মালিকানাধীন করতে চেয়েছিলেন সেখান থেকে জিয়াউর রহমান বেশ সফলতার সঙ্গেই দেশকে বের করে এনেছিলেন।
তিনি তার পরিবারের কাউকেই ক্ষমতার উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তোলেননি, শুধু তাই নয়, ক্ষমতার আশে-পাশেই পরিবারের সদস্যদের ভিড়তে দেননি। যার ফলে জিয়ার নির্মম মৃত্যুর পরে পরিবারের কেউ নয়, দলের বর্ষিয়ান ব্যক্তি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দলীয় মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় হয়তো এর পরে বদরুদ্দোজা চৌধুরী আসতেন, এরপরে দলের অন্য যোগ্য, মেধাবী ও জ্যেষ্ঠ নেতারা সুযোগ পেতেন। এভাবেই দলের এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদটি উন্মুক্ত থাকত সারা দেশের মানুষের জন্য।
দল গঠন করে এরশাদ আর কালক্ষেপণ করতে চাইলেন না, আসলে যাদেরকে দলে ভিড়িয়েছিলেন সেই দুধের মাছিরা ক্ষমতার স্বাদ নেবার জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯৮৬ সালের মে মাসে সংসদ নির্বাচন দেন। সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিল না। কিছুতেই খালেদা জিয়াকে এরশাদ রাজি করাতে পারেননি। কারণ খালেদা জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছিলেন এরশাদের অধীনে কোনো ভালো নির্বাচন হবে না।
নির্বাচনে প্রার্থী যে-ই হোক, রাষ্ট্রপতি এরশাদই থাকবেন এবং সংসদেও তার জাতীয় পার্টিরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। এই প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি কিছুতেই রাজি হলো না। কিন্তু লোভি ও বালখিল্য হাসিনাকে এরশাদ পটিয়ে ফেলেন। একটা কথা খুব ছড়িয়ে পড়েছিল, নারীলোভি এরশাদ হাসিনাকে নিয়ে একটা লং ড্রাইভে গিয়েছিলেন এবং সেই লং ড্রাইভেই তাকে পটিয়ে ফেলেন।
আমার মনে হয়, তাদের মধ্যে সমঝোতা হবার আরো একটি বড় কারণ ছিল, দুজনই ভারতের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রাজনীতি করতেন। কাজেই এই সমঝোতায় ভারতের ভূমিকা থাকলে থাকতেও পারে। এরশাদের সঙ্গে কোনো ধরনের বোঝাপড়াতেই খালেদা জিয়া রাজি না হওয়ায় তার নাম হয়ে যায় `আপোষহীন নেত্রী`।
এরশাদ তো অনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আছেনই। মে মাসে সংসদ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে জয়লাভ করে। নৌকা মার্কা নিয়ে আওয়ামী লীগ পায় ৭৬টি আসন এবং সংসদে বিরোধী দল হয়। জামায়াতে ইসলামীও সেই নির্বাচনে অংশ নেয়, তারা ১০টি আসনে জয়লাভ করে।
৩২টি আসনে যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেছিল তারা সবাই পরে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়। এরশাদের এই নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই তবে এই সময়টাতে এরশাদ উপজেলা পদ্ধতি করে, রাস্তাঘাট করে, গান-কবিতা লিখে, মাঠে-ঘাটে উন্নয়নের নামে ছোটাছুটি করে, শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন।
শতভাগ শুদ্ধ নির্বাচন হলে এবং বিএনপি অংশ নিলে হয়তো বিএনপিই সর্বোচ্চ আসন পেত। কিন্তু এককভাবে সরকার গঠন করার মতো অবস্থা হয়তো কারোরই হতো না। বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি তিন দলই কাছাকাছি আসন পেত।
এরশাদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী জাতির সঙ্গে বেঈমানি করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই নির্বাচনে যদি এই দুটি দল অংশ না নিয়ে আন্দোলনে যোগ দিত তাহলে ৯০-এর অভ্যুত্থান ১৯৮৬ সালেই হয়ে যেত।
দেশে এখন একটি নির্বাচিত সংসদ আছে, তিনি কী করে আর অনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি থাকেন? অক্টোবর মাসের ১৫ তারিখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ। আওয়ামী লীগ কেন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী দেয়নি? আমার বিবেচনায় এটিও হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেই এরশাদ করেছেন।
সংসদ নির্বাচনে কিছুটা ছাড় দিলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তো কিছুতেই ছাড় দেবেন না, কারণ রাষ্ট্রপতি তাকে হতেই হবে। কোনো কারণে সংসদে তার দলের কর্তৃত্ব না থাকলে, ঝামেলা হলে, তিনি সংসদ ভেঙে দিতে পারবেন, সেই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার আছে কিন্তু রাষ্ট্রপতির পদ তো কিছুতেই হারানো যাবে না। হাসিনাও জানত এরশাদের প্রস্তাবে রাজী হওয়াই ভালো কারণ রাষ্ট্রপতি তো তিনিই হবেন, নির্বাচন যেমনই হোক। কাজেই তাকে বৈধতা দেবার জন্য প্রার্থী না দিয়ে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেই বরং তার কাছ থেকে অধিক ফায়দা আদায় করা যাবে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিনে ৫৪.৯ শতাংশ মানুষ ভোট দেয় এবং প্রাপ্ত ভোটের ৮৪.১ শতাংশ ভোট পেয়ে এরশাদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এবার আর তাকে পায় কে। তিনি এখন দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। কাজেই আগের চেয়ে তার এখনকার ভাষণে তার কণ্ঠের জোর অনেক বেড়ে যায়। যখন তখন যাকে খুশি মন্ত্রী বানান, যাকে খুশি বাদ দেন। যাকে খুশি প্রধানমন্ত্রী বানান।
১৯৮২ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে শুধু সাত্তারকেই সরিয়ে দেননি, সরিয়ে দিয়েছিলেন উপরাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মোহাম্মদুল্লাহকেও। ৪ বছর তিনি আর কাউকে উপরাষ্ট্রপতি হিশেবে নিয়োগ দেননি। এবার নিজে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রথমেই একজন উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। উপরাষ্ট্রপতি হন একেএম নুরুল ইসলাম। নুরুল ইসলামের স্ত্রী জাহানারা আরজু লেখালেখি করতেন। তার সঙ্গে আমাদের একটা লেখক-সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং জসীম উদদীন পরিষদের জন্য আমরা কিছুটা সরকারি আনুকুল্যও পাই। চলবে