বিপুল জামানের স্মৃতিগদ্য ‘মিঞা ভাই’

প্রকাশিত : জুন ২২, ২০২০

বড় কাকার কথার উপরে কেউ কথা বলে না আমাদের বাড়িতে। দাদাজানও কোনো কাজ করার আগে বড় কাকার সাথে পরামর্শ করেন। কারণ বড়কাকা হলেন আমাদের বংশের বাবা-কাকাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। মিঞা ভাই। অন্যদের ক্ষেত্রে দেখেছি, জ্যাঠার ছেলেই মিঞা ভাই হয়। কিন্তু আমাদের বংশে আমার আব্বা মেজ, তবু আমি মিঞা ভাই। দাদাজান যখন ঋণে পড়লেন তখন বড়কাকা দাদারে রাজি করাইয়া মালয়েশিয়া গেলেন। দাদাজান বড়ছেলেরে হাতছাড়া করতে চান নাই। বড়কাকা তারে রাজি করান। বড়কাকা আব্বারেও রাজি করান। আব্বা সারা জীবন বড়কাকার পাশে পাশে ছিলেন। আব্বা বড়কাকার অনুপস্থিতিতে কিভাবে সামলাবেন তা ভেবে দিশেহারা বোধ করতেছিলেন। বড়কাকা আব্বারে বুঝান যে, অবস্থা ফেরানোর জন্য আর এতগুলো ভাইবোন মানুষ করার জন্য কাউরে না কাউরে বিদেশ যাওয়াই লাগবে। আর আব্বা পড়াশোনায় ভালো।  কয়েক বছর পরেই পাস করবেন। চাকরি বাকরি করলে সেটাও সংসারের জন্য ভালো হবে। সব বুঝায়ে বড় কাকা বিদেশ যান। জানপ্রাণ দিয়ে খেটে দশ বছর ধরে টাকা পাঠাইছেন। দাদার অবস্থা আস্তে আস্তে ফিরেছে। আব্বার চাকরির পর বড়ঘর থেকে মানে আমার নানার বাড়ি থেকে প্রস্তাব আসে। দাদাজান না করে দিছিলেন। বড়কাকা ট্রাংক কল করেন। দাদারে আবার বুঝান।

এই প্রস্তাব ফেরানো ভালো হবে না। আব্বার চাকরিতে পদোন্নতিও তাড়াতাড়ি হবে এই বিয়েতে। তাছাড়া সিরিয়াল অনুযায়ী বিয়ে শাদি করার তাড়ায় কাকার এখন দেশে ফিরে বিয়ে করে টাকা নষ্ট করাও ঠিক হবে না। সুতরাং দাদাজান যেন তার মেজ ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দেন। বড় কাকা আব্বাকেও ফোন করে বুঝান। আব্বার বিয়ে হলো। কিছুদিন পর হই আমি। এই বাড়ি বড় ছেলে। বড় কাকা যখন দেশে ফেরেন তখন আমি দুই বছর পার করছি। সেদিন আমি সারা গায়ে ধুলো মেখে বাড়িতে খেলা করতেছিলাম। বড় কাকা আমারে ধরে অনেক কান্না করছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে। এমনকি দাদাও নাকি এত কান্না দেখে বলছিলেন, ছোট বাপ পেয়ে বুড়ো বাপরে ভুলে গেলি? কাকা দাদারে সালাম করে আমারে দেখাই দিয়া বলছিলেন, এইটা তো বড় বাপ। দাদা এই কথা শুইনা বড় কাকার কপালে চুমা খাইছিলেন। কান্নাকাটি শেষ হইলে মা টুক করে এসে সালাম করছিলেন বড় কাকার পায়ে হাত দিয়ে। বড়কাকা বলছিলেন, তোমার বিয়েতে থাকতে পারি নাই, মাফ কইরো বউমা.... তারপর হাত টেনে সোনার চেন দিয়ে বলছিলেন, লক্ষীর হাতে লক্ষ্মী দিলাম গো বউমা, যত্নে রাইখো।

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত দাদা, বড় কাকা, আব্বা, সেঝ কাকা আর ছোট কাকা একসঙ্গে বসে আলাপ করছিলেন। সেঝ কাকা, ছোট কাকা আর দাদা কিছুই বলেন নাই বলতে গেলে। বড় কাকা আব্বার হাত ধরে তার কান্না সামলাইতে কিছু কিছু বলছিলেন। আব্বা সব জানাইলেন। এই দশ বছরে কি কি হইলো সব। সব কথা বলা হয়ে গেলে বড় কাকা আব্বার হাত ধরে বলছিলেন, ফিরোজ, তুই খুব ভালো করছিস রে। তুই সবার দোয়া সারাজীবন পাবি। আব্বা বলছিলেন, আমি আর সামলাইতে পারতেছি না, ভাইজান। এখন আপনি সামলান। বড় কাকা বলছিলেন, আমি একা কিছু পারবো নারে। একা কিছু হয় না।

সেদিন আব্বা ফুরফুরে মনে ঘুমাইতে গেছিলেন। তারপর আস্তে আস্তে বড় কাকা আর দাদা আর আব্বা আর আরো দুইকাকা মিলে আমাদের বাড়ি ঘর, আমাদের এলাকা সব গুছাইতে লাগলেন। বড়কাকা বিয়ে শাদি করছেন। আমার ছোট ছোট ভাইবোন হইছে। আর আমি তাদের মিঞা ভাই। ওরা সবাই আমার কথা খুব শোনে। কিন্তু আমি একটা ভুল করে ফেলি। স্কুলের স্যার আব্বার কাছে ফোন দেয়। আব্বা রাগ করে আসতে গেলে আব্বারে আসতে মানা করে বড়কাকা। তিনি আসে আমারে স্কুল থেকে নিতে। স্যারদের বলে আর এমন ভুল নাকি আমি করবো না।

বড়কাকা আমারে আমতলায় নিয়ে যায়। বলেন, তার দোষে নাকি ভুল করছি। কারন তিনি আমারে বলেন নাই আমি আসলে কী। কাল সকালে জানাবেন বলে  জানান। আমার কপালে প্রথম দিনের মতো চুমা খেয়ে বলেন, এইটা আমার বড় বাপ!

কেউ আমারে স্কুলের ঘটনা নিয়ে কিছু বলে নাই সেদিন। কেউ জানতো কি না তাও জানি না। পরদিন সকালে বড়কাকা কান্ধে নিয়ে আমারে আমাদের মাঠে পৌছালেন। মাঠে তখন গরু চাষ দিচ্ছিলো। সার সার গরু মাঠটা জুড়ে আছে। আমি অনেকক্ষন সেই গরুদের ঘোরা, চাষ দেয়া দেখলাম। তারপর আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, কাকা আপনি আমারে কি না বলবেন বলছিলেন? কাকা বললেন, আমি তোমারে বলতে চাই যে তুমি কী। ওই গরুগুলো দেখতিছ? সামনে গরু যেদিকে যায় পিছনের গরুগুলোও সেই দিকে যায়। তুমি হচ্ছো ওই সামনের গরু। তুমি যেমনি চলবা তোমার ভাইবোনও সেরাম চলবে। তুমি হইলা মিঞা ভাই। তুমি এখন ভাবো তুমি কিভাবে চলবা।

তারপর থেকে কোন স্যার বা অন্য কেউ আমার নামে নালিশ দেয় নাই আব্বা বা কাকাদের কাছে। মরার সময়  দাদাজান আমার মুখে চুমা দিয়া বলছিলেন, আমার ভাইডা তোমাদের দেইখা রাখবো, তোমরা দেইখো!