
বিশ্বজয়ী হও
পর্ব ১০
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুলাই ০৫, ২০২০
পরিশ্রম সবাই করে। বেঁচে থাকতে গেলে কিছু না কিছু পরিশ্রম করতেই হয়। আবার যারা পরিশ্রম করে, সফলতার জন্য তাদের সবাই কিন্তু যথেষ্ট পরিশ্রম করলেও সফল হয় না। কারণ সুপরিকল্পিত পরিশ্রমই এনে দেয় সফলতা।
একটি গল্প আছে, দুই মাতালের একটি বাড়ি খুব পছন্দ হয়। তখন তারা চিন্তা করে বাড়িটি ঠেলে তাদের নিজেদের জমিতে নিয়ে যাবে, যাতে বাড়িটি তাদের হয়। যেই কথা সেই কাজ। মাতাল যুগল বাড়ি ঠেলতে থাকে কিন্তু সারা রাত ঠেলার পর ভোর হলে দেখে বাড়ি যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। এক ইঞ্চিও এগোইনি। মাতালের এই বাড়ি ঠেলার মতো আমরা যদি অপরিকল্পিতভাবে কাজ করি তবে কাজে পরিশ্রম হবে অসীম, কিন্তু ফল হবে শূন্য।
স্বপ্নকে বাস্তব করতে নিতে হবে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। থাকতে হবে সৎ সাহস। স্বামীজির ভাষায়, ‘সাহস অবলম্বন করো ও কাজ করে যাও। ধৈর্য ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাও, এই একমাত্র উপায়।’ যখন আমরা সুপরিকল্পিত পরিশ্রম করি, লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যাই, তখন আমাদের সফলতা করায়ত্ব হয়। আমরা সুষ্ঠু ফল পাই। তোমরা যে কাজই করতে চাও না কেন, সবার আগে তার একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা করবে। কিভাবে কাজটি করতে চাও, সেটি আগে ভাববে, দেখবে এই ভাবনার কারণেই কাজটি সুন্দরভাবে শেষ হচ্ছে।
কোনো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে আগে থেকে ঠিক করে নাও, যাদেরকে নিয়ে অনুষ্ঠান তারা কে কী করবে। সেভাবে কাগজে লিখে একটা ফরমেট দাঁড় করাও। দেখবে, তুমি উপস্থাপনা করতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছো না। কথায় আছে, শতকরা একজন প্রতিভা দ্বারা, বাকি নিরানব্বই জন কঠোর অভ্যাস দ্বারা প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে। পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর দেবে, প্রশ্ন পেয়েই পরিকল্পনা করো কোন কোন প্রশ্নের আগে উত্তর দিতে চাও। সেভাবে সবথেকে ভাল জানাগুলো দিয়ে পরীক্ষার উত্তর প্রদান শুরু করলে তোমার অত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। তুমি যেসব প্রশ্ন কঠিন মনে করতে তখন সেগুলোকেও সহজ মনে হবে। তুমি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে।
জীবনের দৌড়ে জিততে গেলেও চাই পরিকল্পনা। সুষ্ঠু কাজে পাওয়া যায় সুষ্ঠু ফল। সুষ্ঠু ফল অর্থ সফলতা, যা সুষ্ঠু পরিকল্পনাই তোমার জীবনে এনে দেবে। সর্বক্ষেত্রে! সর্বত্র! আবার আমরা অনেক পরিকল্পনা করেও যে কাজ করতে পারি না, তা করতে পারি সুন্দর ব্যবহার ও মিষ্টি বাক্যের দ্বারা। যে মিষ্টি বাক্যের দ্বারা রোগ সেরে গিয়েছিল এক রাজপুত্রের। যার রোগ অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও সারছিল না। রাজপুত্র শয্যাশায়ী। রাজবদ্যি হাল ছেড়ে দিয়েছে। রাজার মনে দুঃখ, রাজ্যজুড়ে শোক, রানির চোখে টলমল করে জল।
কী করে রাজপুত্র সুস্থ হবে, কী করলে রাজ্যে আবার সুখ-শান্তি ফিরে আসবে, এই নিয়ে সভাসদগণ ভেবে অস্থির। মন্ত্রি এ রাজ্য থেকে সে রাজ্যে ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই রাজপুত্র সুস্থ হচ্ছে না। মন্ত্রি যখন এ রোগ সারাতে পারে এমন বৈদ্যি নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়ে রাজমহলে ফিরে আসলো, তখন হঠাৎ রাজমহলে এক সাধুর আগমন ঘটল। সাধু রাজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, মহারাজ, আমি আপনার পুত্রকে সুস্থ করে দিতে পারি। তবে সেজন্য রাজকোষ থেকে আমার এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিতে হবে। আমি যে স্বর্ণমুদ্রা আপনার রাজ্যের দুস্থ প্রজাগণের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে এ রাজ্য ত্যাগ করব। আর, আমি যখন রাজপুত্রের কক্ষে প্রবেশ করব তখন কেও সেখানে থাকতে পারবে না। আপনি যদি এই দুটি শর্তে রাজি হন তবেই আমি আপনার পুত্রকে সুস্থ করে দেব।
সাধুর কথায় রাজা রাজি হলেন আর সাধু রাজপুত্রের কক্ষে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই রাজপুত্র হাসতে হাসতে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে এক দৌড়ে রানিমার কোলে এসে বসলেন। রাজমহলের সবাই নির্বাক হয়ে গেলেন, এ কী করে সম্ভব! শয্যাশায়ী একজন মানুষ কি করে এত কম সময়ে এতটা সুস্থ হয়ে গেল! সবার বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই সাধু এসে উপস্থিত হলেন এবং রাজার কাছে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা চাইলেন। রাজা তখন সাধুকে প্রশ্ন করলেন, মুণিবর কী করে এত কম সময়ে আপনি আমার পুত্রকে সুস্থ করে তুললেন? সাধু তখন বললেন, কিছু কথা বলে। কয়েকটি কথায় আপনার পুত্র সুস্থ হয়ে উঠেছে মহারাজ।
সাধুর এমন কথা শুনে মন্ত্রি পাশ থেকে বলে উঠলো, সাধু মিথ্যা কথা বলছে মহারাজ। এ সুস্থতা কাকতালীয়। ঠিক যখন রাজবৈদ্যের ঔষধ ফলতে শুরু করেছে, তখনই সাধু রাজপুত্রের কক্ষে এসে উপস্থিত হয়। আপনি এই ভণ্ড সাধুকে এখনই প্রহরী দিয়ে রাজমহল থেকে বের করে দিন। মন্ত্রির কথা শুনে সাধু বললেন, প্রহরী লাগবে না মন্ত্রিমশায়। আমি এমনিতেই চলে যাচ্ছি। তবে তাড়াহুড়ো করে একটি কথা বলতে ভুলে গেছি। মন্ত্রিমশায়, আমি যখন রাজপ্রাসাদে আসছিলাম তখন আপনার বাড়ির আশপাশে প্রচুর লোক জমায়েত হয়েছিল আর আপনার বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ আসছিল। আমি কিসের কান্না শুনলে একজন বলল, এ রাজ্যের মন্ত্রির ছেলে এইমাত্র সাপের কামড়ে মারা গেছে। তাই মন্ত্রির বাড়ির লোকজন কাঁদছে।
সাধুর কথা শেষ হতে না হতেই মন্ত্রি পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে তার বাড়ির দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলতে থাকল, মিথ্যাবাদী, ভণ্ড, তুমি আমার পুত্রকে নিয়ে এমন নিষ্ঠুর মিথ্যা বলতে পারলে, তোমাকে এখনই শূলে চরাব আমি। মন্ত্রির কথা শেষ হতেই সাধু রাজার দিকে তাকিয়ে বললেন, মহারাজ, আমার একটি কথায় যদি মন্ত্রিমশায় পাগলের মতো অসুস্থ হয়ে ছুটে চলে যেতে পারে, তবে আমার আর একটি কথায় রাজপুত্র কেন সুস্থ হয়ে হাসতে হাসতে ছুটে আসতে পারে না? কথায় সব হয়। কথায় রোগ সেরে যায় আবার কথায় মানুষ শয্যাশায়ী হয়ে যায়। কথায় বন্ধু হয় আবার কথায় শত্রু হয়। কথায় যুদ্ধ বাধে আবার কথায় যুদ্ধ থেমে যায়। কথার অসীম শক্তি মহারাজ।
রাজা সাধুর কথায় নিজের ভুল বুঝতে পারল এবং সাধুকে স্বসম্মানে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা উপহার প্রদান করলেন। সাধু নিজের কথা মতো সে সব স্বর্ণমুদ্রা রাজ্যের দুস্থ প্রজাদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে রাজ্য থেকে চলে গেলেন।
বন্ধুরা, এটা নিছক গল্প নয়। এটা জীবনের এক উজ্জ্বল সত্য। তোমরা জীবনের বহুক্ষেত্রে লক্ষ্য করবে, এই কথার কারণে কত সুবিধা পাচ্ছ, কত সমস্যার সমাধান পাচ্ছ। আবার এই কথার কারণেই কত বড় বিপদের সম্মুখীন হচ্ছ। আমরা যখন ‘মা’ বলে মাকে ডাকি তখন আমরা ও আমাদের মায়েরা উভয়েই পরম তৃপ্তি অনুভব করি। একইভাবে কাউকে গালি দিলে উভয়ের মনই বিষণ্ণ হয়ে যায়, রাগে পরিপূর্ণ হয়ে যায় হৃদয়। মিষ্টি কথা, মধুর বাক্য তথা সুব্যবহার আমাদের জীবনে আনে ইতিবাচক পরিবর্তন। আমরা এগিয়ে যায় সফলতার দিকে। চলবে