ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বন্ধুত্বের নাকি হ্যাংলামির!

প্রকাশিত : এপ্রিল ০১, ২০২১

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের র‌্যাডিক্যাল বাম আন্দোলনের কর্মী এবং পিপলস রিভিউয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৌম্য মণ্ডল। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কার্টুনিস্ট ও সংবাদকর্মী রিফাত বিন সালাম। সাক্ষাৎকারে উঠে এসছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের একাধিক বিষয়। ছাড়পত্রের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো।  

 


রিফাত: একজন ভারতীয় নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ককে কিভাবে মূল্যায়ন করেন, বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে। আরও পরিস্কার করে বললে, দুই দেশের বানিজ্যিক বিষয়কে আপনি কিভাবে দেখছেন? 

সৌম্য: বাংলাদেশ সরকার তার নিজের নাগরিকদের গুলি করে মারছে, কারণ তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। এই ঘটনা থেকেই কী ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কটা গণতান্ত্রিক বন্ধুত্বের নাকি হ্যাংলামি পূর্ণ অধিনতার, সেটা  কি আন্দাজ করা যায় না? 

 

ভারতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরের সময় তাকে খুশি করতে খোদ রাজধানী দিল্লিতে পরিকল্পিত দাঙ্গা করা হয়। দাঙ্গা না বলে অবশ্য এটাকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একতরফা হিংসা বলাই যুক্তিযুক্ত। 

 

এর আগে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি  ক্লিন্টনের ভারত সফর কালে পশ্চিম বঙ্গের একজন সাংসদ ক্লিন্টনের সাথে হ্যান্ডশেক করার পরে অনেক দিন সাবান দিয়ে হাত ধোননি বলে দাবি করেছিলেন। সাংসদ এই নির্লজ্জ হ্যাংলামি প্রদর্শন করতে একটুও সংকোচ বোধ করেননি। উপনিবেশিক শিক্ষা এবং শাসনই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক এলিটদের ভিতর থেকে আত্মমর্যাদা বোধটুকু হাপিশ করে দিতে সক্ষম হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। এই ভাবে অধিনতার একটা ক্রমপর্যায় তৈরি হয়েছে। আমেরিকার সাথে ভারতের অসম বানিজ্য চুক্তি, ভারতের সাথে বাংলাদেশের অসম বানিজ্য যুক্তি, আন্তর্জাতিক নদী আইন ভঙ্গ করে অবলিলায় প্রতিবেশী দেশের (কিছুটা নিজের দেশেরও) প্রকৃতি, জীবন, জীবিকা ধংস করা, এই সবই পুঁজিবাদি বিশ্ব ব্যবস্থারই প্রতিফলন। যদিও বাংলাদেশের বাজারে চীনের বাড়তে থাকা প্রভাব বাংলাদেশের শাসকদের ভারতের সাথে  দরকষাকষির কিছুটা  ক্ষমতা দিতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এবং ক্রমশ রাজনীতিতে চীন আরো প্রভাবশালী হয়ে উঠলে বাংলাদেশের অধিনতার হয়তো নতুন সমীকরণ গড়ে উঠতে পারে। 

 

চীন এখন অনেক শক্তিশালী পুঁজিবাদী শক্তি এবং আমেরিকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। ভারত চীনের থেকে অনেক দূর্বল। এটা বাংলাদেশে আধিপত্য বজায় রাখতে ভারতের অসুবিধার দিক হলেও একটা সুবধার দিকও আছে । আর সেটা হল ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতের যতটা কাছাকাছি, চীন ততটাই দূরের। 

 

মনে রাখতে হবে আমেরিকা মুন্না ভাই হলে, ভারত হল দক্ষিণ এশিয়ার সার্কিট। ফলে আমেরিকার সক্রিয় সহযোগিতা এবং উস্কানিতে বাংলাদেশের মাটিতে ভারত চীনের সাথে সঙ্ঘাতে জড়াবে। চীন- আমেরিকার আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বযে ভারতীয় উপমহাদেশের শাসক দের পকেট ভরাবে এবং জনসাধারণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই।

 


রিফাত: সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রধানতম নরেন্দ্র মোদি। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে মোদির বাংলাদেশ সফর কি আলাদা কোনো অর্থ বহন করে?

সৌম্য: বিধানসভা ভোট না থাকলেও হয়তো মুক্তি যুদ্ধের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করতেন। ভারতের রাষ্ট্র নায়কেরা নিজেদের উগ্রজাতীয়তাবাদী দম্ভ প্রকাশ করতে এবং বাংলাদেশের মাটিতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সিরাজ সিকদাররা মেহনতী মানুষের যে লাল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তাকে ঢেকে দিতে, মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে অবজ্ঞা করতে, সব সময়েই এটা প্রচার করে থাকেন যে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছে। ভারতের উগ্রজাতীয়তাবাদের কাছে কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার থেকেও পাকিস্তানের অঙ্গ ছেদন বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ফলে মুক্তিযুদ্ধের বর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানটা ব্যবহার করতেই হয়। 

 

এ ছাড়া বাংলাদেশে ব্যাপক মোদি বিরোধী বিক্ষোভকে ইসলামিক বিক্ষোভ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে ভারতীয় মিডিয়া। এই ভাবে হিন্দু মুসলিম বাইনারি তৈরি করে হয়তো সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো কে ফায়দা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বাংলাদেশের বামপন্থী প্রগতিশীল ছাত্র যুবদের মোদি বিরোধী ক্ষোভকে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এই বামপন্থী ছাত্র জোট কি দারুন সংঘর্ষে জড়ালো পুলিশ এবং শাসক দলের গুন্ডাদের সাথে। বিক্ষোভের কারণ হিসেবে শুধুমাত্র প্রায় ২০ বছর আগের গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গ টেনে এনে নদী সমস্যা, অর্থনৈতিক শোষণ, সিমান্ত হত্যার মতো ইস্যু গুলোকে চাপা দেওয়া হচ্ছে। টাইম মেশিনের চেপে গুজরাট দাঙ্গা ঠেকানো সম্ভব নয়। কিন্তু অসম বানিজ্য, নদী সমস্যা বা সিমান্ত হত্যা নিয়ে কিছু করা যেতে পারে। কারণ এগুলো বর্তমান এবং বাস্তব। মানুষের রুটি রুজির সমস্যাকে ডিকোর্স থেকে সরিয়ে হিন্দু মুসলিম বাইনারি তৈরি করা নিশ্চিত ভাবে উগ্রদক্ষিণপন্থী শক্তিকে ভোটের আগে সহায়তা করবে।



রিফাত: পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে কি হতে চলেছে বলে আপনি মনে করছেন?

সৌম্য: প্রথমত আমি জ্যোতিষী নই। দ্বিতীয়ত এইবারের বিধানসভা নির্বাচন অত্যন্ত জটিল এবং কালারফুল হয়ে উঠেছে। আজ থেকে ১০ বছর আগে পশ্চিম বঙ্গে BJP কোনো গুরুত্বপূর্ণ শক্তি  হতে পারে, এ কথা কল্পনা করা যেত না। এই বারে BJPকে ক্ষমতায় আসা থেকে কিভাবে ঠেকানো যায় সেটা অ-বিজেপি মহলের মূল চর্চা হয়ে উঠেছে। তৃনমূলের দূর্নীতি এবং দাদাগিরির বিরুদ্ধে BJP নিজেকে বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। যদিও তৃনমূলের দূর্নীতিগ্রস্ত সন্ত্রাসী নেতাদের জেলে ঢোকাবার ভয় দেখিয়ে বা কিনে নিয়ে BJP দল ভাড়ি করেছে। BJP ক্ষমতায় যদি চলেও আসে তবে পাড়া স্তর থেকে রাজ্যস্তরে ক্ষমতায় থাকা মুখ গুলো বদলাবে না।

 

সিপিআইএম, বিজেপি বা অন্য যেকোনো রাজনৈতিক দল সংসদের ভিতরে বা রাস্তার লড়াইয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে ব্যার্থ হয়েছে। পশ্চিম বঙ্গে উগ্র হিন্দুত্ববাদী মানসিকতার ব্যাপক বিস্তার হলেও, বাস্তব পরিস্থিতি হল তৃনমূলের ধারের কাছে BJPর সংগঠন নেই। এমনকী সাংগঠনিকভাবে Cpim এর থেকেও অনেক পেছনে BJP।  কিন্তু BJPর যা আছে, সেটা হল হাওয়া। কুখ্যাত IT cell এবং কর্পোরেট মিডিয়ার জোড়ে BJP নিজেকে বিশাল শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। পশ্চাৎপদ সমাজে মানুষ সাধারণত জেতা দল, ক্ষমতাবান দলের সাথে থাকতে চান। BJPক্ষমতায় আসছে, এই প্রচারে বিশ্বাস করে অনেকে সত্যি সত্যি বিজেপি হয়ে গেছেন। বিরোধী বাম শক্তিদের এক অংশের সরকার বিরাধী ভোটকে BJPতে যেতে বাধ্য করছে। কিন্ত ভোটের আগে CPIM  তার সাংগঠনিক দক্ষতা প্রদর্শন করতে পেরেছে এবং তৃণমূল - BJPর বাইনারির বাইরে CPIm নেতৃত্বাধীন জোট নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক থেকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পেরেছে।

 

ফলে ধরে নেওয়া যায় যে CPIM নেতৃত্বাধীন জোট তৃনমুল বিরোধী BJPর ভোট ব্যাঙ্কে কিছুটা থাবা বসাতে চলেছে। অন্যদিকে মুসলিম যুবকদের হৃদয়ের কথা সাহসের সাথে সোচ্চার হয়ে বলার জন্য উল্কা বেগে হঠাৎ উত্থান হয়েছে আব্বাস সিদ্দিকীর। আব্বাসের দল তৃণমূলের নিশ্চিত মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসাবে কিছুটা হলেও। যদিও মুসলিম ভোটার বিশেষত অবাঙালি মুসলিম ভোটারদের অনেকে BJPকে ঠেকাতে তৃণমূলের উপরই আস্থা রাখছেন।  যদিও প্রতিদিন গুরুত্বপূর্ণ তৃণমূল নেতাদের BJPতে যোগদানের খবরে মানুষ ভাবতে বাধ্যে হচ্ছে, যাকে ভোট দেব সে আসলেই তৃণমূল নাকি BJP! ফলে এইবারের নির্বাচন খেলা হিসেবে খুবই রোমাঞ্চকর। জোর দিয়ে কোনো কিছুই বলা সম্ভব নয়। যদিও ২৭ তারিখ প্রথম দফা নির্বাচন থেকেই EVM এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এই সমস্ত অভিযোগ সত্যি হলে আমরা বুঝতেই পারছি যে কী হতে চলেছে। খেলা হিসেবে যতই উত্তেজনাপূর্ন নির্বাচন হোকনা কেন, যেই ক্ষমতায় আসুক মানুষের রুটি রুজির সমস্যা যে বাড়বে বই কমবেনা সেই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

 

 
রিফাত: আমরা জানি পশ্চিমবঙ্গে কমপক্ষে দেড় কোটি মতুয়া ভোটার আছেন। মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ একটি গুরুত্ব যায়গা এবং মোদি সেখানে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া ভোটারদের মধ্যে বিজেপি কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে বলে মনে করেন?

সৌম্য: মোদির গোপালগঞ্জে যাওয়া এদিকের মতুয়াদের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয়না। ভারতের মতুয়াদের এই সময়ে প্রধান দাবি হচ্ছে নাগরিকত্ব। আগে নাগরিকত্ব তার পর বাকি সব কিছু। নাগরিকত্ব প্রশ্নে মতুয়ারা মনে করেছে BJPতাদের সাথে প্রতারণা করেছে। `দলিত আদিবাসী মাইনরিটি আন্দোলন লীগ` বা দামাল লাগাতার প্রচার চালিয়েছে নাগরিকত্ব প্রশ্নে BJPর প্রতারণা নিয়ে। 2003 সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন তৈরি করে BJP মতুয়া/ উদ্বাস্তুদের বিপদে ফেলেছে এই বিষয়ে তারা সচেতন। কিন্তু তারা ভেবেছিলো ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন তৈরি আদের ২০০৩ এর আইন এর বিপদ থেকে মুক্তি দেবে, তারা নাগরিকত্ব পাবে। কিন্তু আমার ভবিষ্যৎবানী মত BJP ভোটের আগে

 

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের রুল প্রকাশ করতে পারেনি। আইন পাস হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে রুল প্রকাশ করার কথা। কিন্তু ১৫ মাস কেটে গেল BJPসরকার রুল বের করতে পারলো না। কারণ রুল প্রকাশ হলেই দেখা যাবে যে এতে মতুয়া/ উদ্বাস্তুরা কোনো ভাবেই উপকৃত হবেনা। এই ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আসলে ফরেনার্স অফিসে নথিভুক্ত ৩১,৩১৩ জন নথিভুক্ত শরনার্থীর জন্য, তারাই নাগরিকত্ব পাবে। ফলে NRCহলে সবার আগে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাবে বাংলাদেশ থেকে আগত মতুয়া উদ্বাস্তুরাই। ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এর যৌথ সংসদীয় কমিটির রিপোর্টে বা ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া কেন্দ্র সরকারের হলফনামা পড়লেই জানা যাবে যাবে যে ২০০৩ সাল থেকেই NRCর প্রধান টার্গেট উদবাস্তু, মতুয়ারা।

 

অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মানের ভূমি পুজোর সময় BJP ঘনিষ্ঠ মতুয়ারা ঠাকুরবাড়ির জল মাটি নিয়ে অযোধ্যা যান। কিন্তু সেখানে জল মাটি নেওয়া দূরে থাক মতুয়াদের ঢুকতেই দেওয়া হয়নি! এই নিয়ে তারা স্যোশাল মিডিয়াতে ক্ষোভ উগরে দেন। এরপর ঠাকুর বাড়ির ছেলে BJP সাংসদ শান্তনু ঠাকুর তড়িঘড়ি ফেসবুক লাইভে এসে এটাকে তৃনমূলের মিথ্যা অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দেন। যদিও আমার নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মতুয়া গবেষক জীবন সরকার শান্তনুকে পালটা চ্যালেঞ্জ করেন রামমন্দীরের ভূমি পুজোর জন্য কোনো আমন্ত্রণ পত্র ঠাকুরবাড়িকে বা অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ - পাঠানো হয়ে থাকে তবে সেটা দেখানোর জন্য। জীবন সরকার বলেন যে মাটিতে নমশূদ্ররা পায়খানা পেচ্ছাপ স্নান করে সেই মাটি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা রাম মন্দিরের ভূমি পুজোয় ব্যবহার করবে, এটা ভাবা যায় না।

 

নাগরিকত্ব না পাওয়া নিয়ে BJP সাংসদ শান্তনু ঠাকুর কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার বিক্ষোভ সংগঠিত করছিলেন। এই বিক্ষোভ থামাতে BJP নেতৃত্ব তার সাথে দরকষাকষিতে বসে। শান্তনু তার ঘনিষ্ঠদের জন্য বিধানসভা নির্বাচনে ৫০ টা সিট দাবি করেন। BJP নেতারা ৩০ টা সিটে দিতে রাজি হন। শান্তনুও মতুয়া স্বার্থ ভুলে বিক্ষোভ থামিয়ে দেন। কিন্তু প্রার্থী তালিকে প্রকাশের পর দেখা যায় একটাও সিট দেওয়া হয়নি। শান্তনুর বাবা মঞ্জুল কৃষ্ণ ঠাকুর কয়েকদিন আগে সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষনা করেন যে BJPর পক্ষে মতুয়া ভোট জড়ো করার দায়িত্ব তারা নেবেনা। এর পর BJPর বিরুদ্ধে ৪৫ টা সিটে প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্তেরও খবর আসে আমার কাছে। তারপর BJP শান্তনুর দাদা সুব্রত ঠাকুর সহ আর কয়েকজনকে প্রার্থী করে আবার ঠাকুরবাড়িকে কিনে নেয়।

 

ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সবসময় দলিতদের সাথে প্রতারণা করে এসেছে। ভোটের ঠেলায় কিছু ভরং কিছু নাটক তাদের করতে হয়। মতুয়ারা এই নিয়ে সচেতন হয়েছে। BJPর বিরুদ্ধে মতুয়াদের পরপর বিক্ষোভ তার প্রমান। যদিও এই নির্বাচনে BJP ছাড়া মতুয়াদের কাছে আর অন্য কোনো বিকল্প নেই। কারণ মতুয়ারা বুঝে গেছে যে নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে BJPতাদের মিথ্যা বলছে। কিন্তু মিথ্যা হলেও BJP কিছু অন্তত বলছে, বিরোধীরা হয় এই বিষয়ে কিছুই বলছেনা, নয়তো উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের প্রয়োজনীয়তাকেই অস্বীকার করছে। ফলত নরেন্দ্র মোদি ভরঙ না দেখালেও অনিচ্চার সত্তেও মতুয়া ভোট BJPতেই যাবে, যদি ভোটের পরে নাগরিকত্ব পাওয়া যায় সেই আশায়। মতুয়া ভোট BJPতে গেলে সেটা BJPর কৃতিত্ব নয় বরং বিরোধীদের মতুয়াদের প্রতি অ-সংবেদনশীলতা ও রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার পরিনাম। মতুয়াদের প্রতি এই অসংবেদনশীলতা অভিযোগ থেকে প্রগতিশীল বাম আন্দোলনও বাদ যায়না। তারা একাডেমিক এলিট পত্রিকার দলিত চর্চা নিয়ে আহ্লাদিত। কিন্তু বাড়ির পাসে জ্যান্ত দলিত মতুয়াদের হয়রানি নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। বাম প্রগতিশীলদের ভেতরকার ব্রাহ্মণ্যবাদী অনিহা মতুয়াদের BJPর মত দলিত বিদ্বেষী দলের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

 


রিফাত: ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারকে দুনিয়ার সবচেয়ে প্রাণঘাতী বর্ডার বললে খুব একটা ভুল হবে না, কিন্তু এই বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারে আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও বর্ডার কিলিং নিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন করে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার বা রাজনৈতিক সংগঠনগুলো তেমন একটা সরব না। পাশাপাশি দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এই বিভেদ কেন তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয়?


সৌম্য: পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সিমান্তে সাধারণ মানুষের বসবাস। এই দুই সিমান্তে গুলি চলে। কিন্তু ভারত চীন সিমান্তে মানুষ থাকেনা সাধারণত। সেখানে দুই দেশের সেনা বন্দুক রাখেনা, সংঘর্ষ মানে লাঠালাঠি, গুঁতো গুঁতি।

 

আবার পাকিস্তান বাংলাদেশ সিমান্তে যাতায়াতের জন্য পাসপোর্ট ভিসা লাগলেও নেপাল ভুটান সিমান্তে সে সব লাগেনা। যে কেউ অবলিলায় যেতে আসতে পারে। বিনা পাসপোর্ট ভিসায় যাতায়াতের জন্য কাউকে গুলি খেয়ে মরতে হয়না বা জেলে থাকতে হয়না। কি আশ্চর্য না? সিমান্তে কাঁটা তার লাগানো, গুলি করা হত্যা ইত্যাদি অসভ্যতা, বর্বরতা পৃথিবীর খুব কম দেশেই হয়।

 

সিমান্ত হত্যায় ভারতের এলিটরা আক্রান্ত নয়। তাই মিডিয়ায় প্রচার নেই। এমনকি শ্রীলঙ্কায় LTTE বিরোধী অভিযানের সময় শ্রীলঙ্কার নৌসেনা লাগাতার ভারতীয় তামিল মৎস জীবীদের সাইকো কিলারদের মত বিবিধ নারকীয় পদ্ধতিতে হত্যা করে গেছে। এটা তামিলনাড়ুতে ইস্যু হলেও ভারত সরকার এটাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। বাঙালি জনসাধারণ নিজের দেশের মৎজীবীদের উপর শ্রীলঙ্কার এই বর্বরতা নিয়েও জানেনা। তামিলরা ছাড়া অন্যকেউ কোনো প্রতিবাদ করবো বলেও শুনিনি। আসলে শ্রেনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি ভাবে ভাববো, কিসের প্রতিবাদ করবো সেটা নির্ধারন করে দিতে কর্পোরেট মিডিয়া অনেকটাই সফল বলা চলে।

 

তাছাড়া আক্রান্তইতো তার নিপিড়ন নিয়ে সচেতন এবং সোচ্চার হয়, তাইনা! ধর্মী সংখ্যা লঘুর মানসিক চাপ সংখ্যাগুরুর, দলিতের চাপ উচ্চবর্ণের, নারীর চাপ পুরুষের, কালোর চাপ সাদার উপলব্ধি করা মুসকিল। অসম্ভব সেটা বলছিনা। একই ভাবে ভারতের মানুষ সিমান্ত হত্যা বা বাংলাদেশের নদী শুকিয়ে যাওয়া নিয়ে সচেতন নয়। ভারতের মানুষের কাছে এই বিষয়ে তথ্য নেই। ভারতে শাসক শ্রেণী চায়ওনা যে কোনো তথ্য আসুক ভারতের জনসাধারণের কাছে। কারণ খেটে-খাওয়া মানুষ সাধারণত একে অন্যের প্রতি আন্তরিক এবং সহমর্মি হয়। বিশেষত আধুনিক যুগে শ্রম বেচে খাওয়া মানুষেরা নিজের পাড়ায় বসে আন্তর্জাতিক চরিত্রের হতে পারে। তাই তথ্য আটকে, বিকৃত তথ্য পরিবেশন করে উগ্রজাতীয়তাবাদী, উগ্র ধর্মীয় বিভেদকামী বিষ মানুষের ভিতর ইনজেক্ট করার একটা প্রক্রিয়া চলে। বাংলাদেশে সিমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে লাগাতার তাৎপর্য পুর্ণ প্রচার বিক্ষোভ ছাড়া ভারতে এই নিয়ে সচেতনতা গড়ে উঠতে পারেনা। সিমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 


রিফাত: বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যেভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে তার ফলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কি দূরত্ব আরও বাড়বে। স্থানীয় মানুষ এ বিষয়ে ধারণা পোষণ করেন, অর্থাৎ বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কি অবস্থান?

সৌম্য: আজ পশ্চিম বঙ্গের কোনো দৈনিক সংবাদ পত্রেই বাংলাদেশে মোদির উপস্থিতিতে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালিয়ে সরকারি খুনের কথা কিন্তু হেডলাইন হয়নি, প্রথম পাতাতেও আসেনি। এমনকি `কলম`, `দিন দর্পন` এর মতন `ইসলামিক মৌলবাদী পত্রিকা` বলে এক অংশের দ্বারা চিহ্নিত দৈনিক গুলোতেও কালকের গুলি চালাবার ঘটনা শিরোনাম হয়নি।যদিও সমস্ত দৈনিকেরই প্রথম পাতায় স্থান পেয়েছে মুক্তি যুদ্ধে মোদির অংশগ্রহণের বাচালতার কথা। এটা থেকে বোঝাই যায় যে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভারতীয় এলিটদের অবস্থান কিরকম।

 

শাসকদের মধ্যে দূরত্ব না বাড়লেও জনগণের মধ্যে দূরত্ব অবশ্যই বাড়বে। বাংলাদেশ পাকিস্তানে ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হওয়াটা ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিনত করার দাবির পক্ষে অন্যতম কু-যুক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে। দুই দেশেরই সাম্প্রদায়িক বিভেদকামী শক্তি গুলো অপর দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপিড়নকে অজুহাত হিসেবে পেশ করে নিজেদের সংখ্যালঘু নিপীড়নের কার্যকলাপের পক্ষে জনমত গঠন করতে চায়। ভারতের বাঙালিদের বাংলাদেশী তকমা লাগিয়ে হয়রানি, অপমানের ঘটনা ঘটছে। এমনকি "জয় বাংলা" স্লোগানকে ইসলামিক বাংলাদেশের স্লোগান বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ব শিবর থেকে।

 

এতো গেল শাসক এলিটরা জনমতকে কোন খাতে চালিত করতে চায় সেই কথা। কিন্তু অন্য দিকে রাস্তায় হাটতে হাটতে মাঝে মাঝেই দেখতে পাবেন সাধারণ মানুষ ফোন তুলে বা রাস্তায় দেখা হওয়ার একে অন্যকে "জয় বাংলা" বলে সম্বোধন করছে। হিন্দি - হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন বাংলায় হিন্দি বিরোধী জাতীয়তা গড়ে তুলছে, যা আবার হিন্দিভাষী শ্রমজীবী মানুষদের শত্রু বানিয়ে ফেলছে। ঐতিহাসিক ভাবে দুই বাংলার ভাষা সংস্কৃতিগত মিল আছে। আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশীরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আত্মীয়। বাংলাদেশের গান, নাটক, উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়। বাংলাদেশ বিদ্বেষী প্রচারে এপাড় বাংলার যুক্তিবাদী মানুষ অবশ্যই লজ্জিত। হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থানের আগ্রাসন শুধু নয় এর বিরোধীতা করে বাংলিদের প্রগতিশীল যুক্তিবাদী চিন্তা নেতনার জাগরণও হচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের লড়াই আন্দালন, শিল্প সাহিত্যর ভূমিকা কম নয়।