
সুফিনৃত্য
মহাকালে রেখাপাত
পর্ব ৬
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৭, ২০২০
বয়াতি শরিয়ত সরকারকে গ্রেফতারের পক্ষে কবি ব্রাত্য রাইসুর অবস্থানের নিন্দা জানিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। তিনি সেই পোস্টের নিচে মন্তব্য করলেন, তিনি ব্লাসফেমি আইনের পক্ষে। তিনি লিখেছেন, ‘যে কোনো ধর্মগ্রন্থরে সামাজিকভাবে বা জনসভায় চ্যালেঞ্জ করা কি ব্লাসফেমি আইনের মধ্যে পড়ে কিনা? আমি মনে করি, পড়ে। এখন আমার এই মনে করার কারণে আমি জামাতি, বিজেপি, আওয়ামী, হেফাজতি, বিএনপি, আরএসএস বা শিবসেনা হবো কিনা? আমি মনে করি, হবো না। আমি ধর্মীয় দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানির বিরুদ্ধে। যারা এই ধরনের উস্কানি দিবে তাদের গ্রেফতারের পক্ষে।
ব্রাত্য রাইসুর দাবি অনুযায়ী একাধারে তিনি কবি, কথাসাহিত্যিক, আর্টিস্ট, বুদ্ধিজীবী বা ভাঁড়। উদ্যোক্তা, পরামর্শদাতা, অনলাইন বিক্রেতা ও প্রকাশক। এত গুণে গুণান্বিত, এত পরিচয়ে পরিচিত একজন মানুষ কেমন করে ব্লাসফেমি আইনের মতো একটি ভয়ংকর আইনের পক্ষে অবস্থান নেন, আমার ঠিক বুঝে আসে না। তাঁর মতে, তিনি ধর্মীয় দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানির বিরুদ্ধে। ধর্মীয় দাঙ্গা আর সাম্প্রদায়িক উস্কানি বলতে তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন, টাঙ্গাইলের শরিয়ত বয়াতি প্রকাশ্য জনসভায় ধর্মগ্রন্থকে চ্যালেঞ্জ করে ধর্মীয় দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছেন। রাইসুর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাংলার লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে, বাঙালি মুসলমানের ধর্ম সম্পর্কে তাঁর জানাশোনার একটা ধারণা পাওয়া গেল। রাইসুর ধারণা, বাংলাদেশে এই প্রথম শরিয়ত বয়াতি এরকম চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। আমার ধারণা, রাইসু কখনো কবিগানের আসরে বসেননি, ধৈর্য নিয়ে কখনো পালাগান শোনেননি। পালাগান শুনলে তিনি বুঝতে পারতেন, এই ধরনের ‘উস্কানি’ এই বাংলায় শত শত বছর ধরে গায়েন, কবিয়াল, বাউল, বয়াতিরা আসরে আসরে দিয়ে আসছেন।
শরিয়ত বয়াতি যে আসরে গানের পক্ষে ‘বয়ান’ বা ‘পালা’ গেয়েছেন, তেমনই একটি আসরের বর্ণনা দিচ্ছি, শুনুন। প্রায় পাঁচ বছর আগে, এক রোজার ঈদের পরদিন গাজীপুরের হোতাপাড়াবাসী আয়োজন করল কবিগানের আসরের। কবি শাহান সাহাবুদ্দিনের আমন্ত্রণে আমিও উপস্থিত ছিলাম সেই আসরে। বিভিন্ন উৎসব-আনন্দে কবিগানের আয়োজন করেন তারা। স্থানীয়রা বলে ‘বাউল গানের আসর’ বা ‘পালা গানের আসর’। দূর-দূরান্ত থেকে বাউল বা বয়াতিদের আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। বাউলদের দুটি দল। একটির দলনেতা শাহীন সরকার, অন্যটির রীনা সরকার। সন্ধার পরপরই আসর শুরু হলো। দর্শকসংখ্যা প্রায় দুশো। মঞ্চে ঢোল-তবলা-হারমোনিয়াম-জুড়ি নিয়ে দোহররা বসে। সামনের মাঠে তেরপল বিছানো। ছোটরা বসেছে তেরপলের উপর এবং বড়রা প্লাস্টিকের চেয়ারে। রাত আটটা নাগাদ স্থানীয় মোড়ল আবু তাহের মঞ্চে উঠে পালাকাররা কী পালা গাইবেন তা নির্ধারণ করে দিলেন, ‘আদম ও শয়তানের পালা’। অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক আদম সৃষ্টি ও শয়তান কর্তৃক আদমকে সেজদা না করা প্রসঙ্গের পালা।
‘শয়তানের পালা’ গাওয়ার জন্য শয়তানের পক্ষে মঞ্চে উঠলেন শাহীন সরকার। আটত্রিশ বা চল্লিশের মতো বয়স তাঁর। ক্লিনসেভ মুখ, কুচকালো গোঁফ, মাথার ঝাঁকড়া চুল পেছনে মুঠো করে বাঁধা। মঞ্চে বসা দোহারদের প্রত্যেকেরই চুল প্রায় এরকম। শয়তানের পক্ষাবলম্বনকারী শাহীন সরকার বেহালা হাতে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। ঢোল তবলা বাঁশি হারমোনিয়াম জুড়ির সমবেত বাজনা শুরু হলো। সে কী সুর বাঁশির! মনপ্রাণ উতালা করা সুর। শুধুই বাজনা চলল মিনিট পাঁচেক। তারপর শুরু হলো গান, মানে পালা। পালার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য এই যে, আদমসৃষ্টির শুরু প্রসঙ্গে গায়েন বলতে শুরু করলেন, আল্লাহ আদম সৃষ্টির জন্য তিনবার ফেরেশতাদের পাঠালেন পৃথিবী থেকে মাটি নেওয়ার জন্য। কিন্তু মাটি প্রতিবাদ করল। পৃথিবী মাটি দিতে নারাজ। তৃতীয় বারের সময় আল্লাহ খোদ আজরাইল ফেরেশতাকে পাঠালেন মাটি নেওয়ার জন্য। আজরাইল তার সর্বগ্রাসী শক্তি দিয়ে মাটির তীব্র প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে মাটি নিয়ে হাজির হলো আরশে আজিম বা ঊর্ধ্বাকাশে। এখানে এসে গায়েন প্রশ্ন করলেন, ‘আল্লাহ তো সর্বশক্তিমান। তার শক্তির কাছে মাটি কোন ছাড়! তিনি যদি সর্বশক্তিমান হয়েই থাকেন, পৃথিবীর সব কিছু যদি তারই নির্দেশ মেনে চলে, তবে মাটির এত বড় দুঃসাহস হলো কী করে যে, সে মাটি দিতে প্রতিবাদ করল?’
গায়েন বয়ান করে চলেন, মানব জাতি সৃষ্টির আগে আল্লাহ প্রথমে পৃথিবীতে জিন জাতি সৃষ্টি করলেন। কিন্তু তারা পাপাচারে এত বেশি লিপ্ত হয়ে পড়ল, আল্লাহ তাঁর গজবের ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন পৃথিবীর সকল জিনকে ধ্বংস করে দিতে। ফেরেশতারা তাঁর নির্দেশ মোতাবেক ধ্বংসলীলায় মেতে উঠল। পৃথিবীর সব জিন ধ্বংস হলো। কিন্তু ফেরেশতাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু জিন পাহাড়ে, জঙ্গলে, গুহায় আশ্রয় নিয়ে ফেরেশতাদের রোষানল থেকে রেহাই পেল। গায়েন প্রশ্ন করলেন, ‘আল্লাহ তো সর্বদ্রষ্টা। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা তাঁর অগোচরে। তাই যদি হয় তবে কিছু জিন যে পাহাড়ে, গুহায়, জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে জানে বেঁচে গেল, তিনি তা দেখলেন না কেন? দেখেছেন, নাকি দেখেও না দেখার ভান করেছেন।’ গায়েনের প্রশ্ন, ‘এটা কি ন্যায় বিচার হলো আল্লাহর?’
গায়েন বয়ান করে চলেন, আজরাইলের নেতৃত্বে গজবের ফেরেশতারা জিন জাতি ধ্বংস করে আসমানে ফিরে যাচ্ছিল। যাবার পথে দেখল, আড়াই হাজার বছর বয়সী এক জিনশিশু তার স্বজন-পরিজন হারিয়ে পথের ধারে একা বসে কাঁদছে। তাকে দেখে আজরাইলের মায়া হলো। আজরাইল তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল আসমানে। শিশুটির কথা সে আল্লাহর গোচরে আনলো। আল্লাহ তার অধীনস্ত অন্যতম ফেরেশতা আজরাইলের ইচ্ছাকে অবজ্ঞা করলেন না। কিন্তু আসমানে এই জিনশিশু খাবে কী? না খেলে তো সে বাঁচবে না! তাই আল্লাহর হুকুমে তার জন্য এক বিশেষ ব্যবস্থা করা হলো। শিশু তার তর্জনী চুষলে দুধ বের হবে আর মধ্যমা আঙুল চুষলে মধু বের হবে। এভাবে অলৌকিক দুধ আর মধু খেয়ে খেয়ে ‘মকরম’ বা আজাজিল বড় হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। আল্লাহর রহমত পাওয়ার আশায় সে এবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকল। সাত আসমানের এমন কোনো জায়গা বাকি থাকল না যেখানে আজাজিলের সেজদা পড়ল না। তার এবাদত-বন্দেগিতে খুশি হয়ে আল্লা জাতিভেদ প্রথা বিলুপ্ত করে আগুনের তৈরি আজাজিলকে নূরের তৈরি ফেরেশতাদের সর্দার বানিয়ে দিলেন। যাকে বলে ‘মুয়াল্লিমুল মালায়েকাহ’। আযাযিল যথারীতি ফেরেশতাদের নেতার পদ অলঙ্কৃত করে তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে লাগল।
তার উপর আল্লাহর হুকুম এলো, সে যেন ফেরেশতাদের বলে দেয় যে, সে এবং ফেরেশতারা আল্লাহ ছাড়া কোনো কিছুকে যেন সেজদা না করে। আল্লার ফরমান যথারীতি পালন করতে লাগল আযাযিল ও তার অধীন ফেরেশতারা। তারপর আল্লাহ আদম সৃষ্টি করলেন। আদমের ভেতর যখন আল্লা রুহ দিলেন তখন ফেরেশতাদের নির্দেশ দেওয়া হলো তাকে সেজদা করতে। সব ফেরেশতা সেজদা করল, কিন্তু আযাযিল দাঁড়িয়ে রইল। হুকুম অমান্য করার কৈফিয়ত তলব করলেন আল্লাহ। গায়েন বলে চলেন, আযাযিল বলল, হে আল্লা, আপনিই তো নিষেধ করেছেন আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে যেন সেজদা না করি। আমি আপনার কথার অবাধ্য হইনি কখনো। আপনাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে সেজদা করি কিভাবে? এখন আপনি আবার বলছেন মাটির আদমকে সেজদা করতে। শুনেছি হাকিম নড়ে কিন্তু তার হুকুম নড়ে না। আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি সর্বশক্তিমান। আপনি যখন-তখন পূর্বনির্দেশ বাতিল করে নতুন নির্দেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু তার আগে তো আপনার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সদস্যদের সঙ্গে একটু আলাপ আলোচনার দরকার ছিল, যেভাবে আলাপ-আলোচনা করেছিলেন আদম সৃষ্টির আগে। কিন্তু এখন কারো সঙ্গে আলাপ না করে আপনি যে মনগড়া নির্দেশ দিয়ে দিলেন, এটা কি গণতন্ত্র হলো? তাছাড়া আপনি আগে বলেছেন কী, আর এখন বলছেন কী? আপনি তো আল্লাহ। আপনার হবে এক জবান। আপনি এক জবানে দুই কথা বলেন কীভাবে? শয়তান আমি না আপনি?
শাহীন সরকার প্রশ্ন রেখে মঞ্চ থেকে নামলেন। এরপর আল্লাহর পক্ষে যুক্তি দেওয়ার জন্য উঠলেন রীনা সরকার। তিনি শাহীন সরকারের সব প্রশ্নের উত্তর খণ্ডাতে লাগলেন। আল্লাহকে মহান বানাতে লাগলেন। এভাবে প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে গায়েন বা বয়াতিরা গানে গানে রঙ্গরসিকতায় গ্রামবাংলায় যে বিদ্যা প্রচার করছেন, তা যুক্তিবিদ্যা। ইসলামের প্রাথমকি যুগে এই বিদ্যা প্রচার করেছিলেন কাদরিয়া সম্প্রদায়, মুতাযিলা সম্প্রদায়, ইসমাইলী সম্প্রদায়। এই যুক্তিবিদ্যার চর্চা করেছিলেন দার্শনিক আল কিন্দি, আল ফারাবি, আল রাজি, ইবনুল আরাবি প্রমুখ। মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা ছিল বলেই সেই কালকে বলা হতো ইসলামের ‘স্বর্ণযুগ’। রক্ষণশীল চিন্তক আল গাজালি সেই মুক্তচিন্তকদের কাফের ফতোয়া দিয়েছিলেন, মুক্তচিন্তাকে কফিনবদ্ধ করে তিনি পেরেক ঠুকে দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই শুরু হয় ইসলামি মুক্তচিন্তার অবনতি। ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুক্তচিন্তকরা যে মুক্তচিন্তা করতেন সেই মুক্তচিন্তা এখন করে যাচ্ছেন বাংলার বাউল-ফকির-গায়েন-কবিয়াল-বয়াতিরা। ধর্মের রক্ষণশীলতার কানাগলি থেকে মানুষকে মুক্ত করে একটা যুক্তিপূর্ণ জায়গায়, চিন্তার জায়গায় নিয়ে আসার জন্য তাঁরা যৌক্তিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। গান-বাজনা ও যুক্তিপূর্ণ কবিগানের মধ্য দিয়ে তাঁরা যে ধর্ম চর্চা করছেন তা বাঙালি মুসলমানের ধর্ম। ধর্মের নামে কঠোরতাকে, বাড়াবাড়িকে তাঁরা অপছন্দ করেন। কবিগানে তাঁরা যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেন, যেসব চ্যালেঞ্জ ছোঁড়েন, শ্রোতারা সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। কারণ তারা জানে, এগুলোই পালাগানের কথা, এসব যুক্তি-পাল্টা যুক্তিই পালাগানের প্রাণ। প্রশ্ন উত্থাপন আর চ্যালেঞ্জ ছোঁড়াই পালাগানের রীতি-নীতি।
একইভাবে এই বাংলায় চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন লালন সাঁই। তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন প্রচলিত ধর্মীয় আচারকে, চ্যালেঞ্জ করেছিলেন ধর্মশাস্ত্রকে। ভারতবর্ষে একটা সময় সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল। স্বামীর লাশের সঙ্গে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো স্ত্রীদের। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ধর্মগ্রন্থ অনুসারেই এই কাজটি। রাজা রামমোহন এই প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করলেন। তাঁর নেতৃত্ব আরো আরো পণ্ডিত-বিপ্লবীদের তৎপরতায় ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হলো। একটা সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বলিদান প্রথা প্রচলিত ছিল। নির্বিচারে গরু বলিদান করা হতো। রবীন্দ্রনাথ এই প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, লিখলেন ‘রাজর্ষি’। আর কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে তাঁর কত কবিতায় ‘ধর্মীয় উস্কানি’ (রাইসুর ভাষায়) দিয়েছেন, তার তো হিসাব নেই। নজরুল যদি এখন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখতেন, তাহলে তাঁকেও হয়ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেলে যেতে হতো। যদি ব্লাসফেমি আইন থাকত, তবে লালনকে জেলে যেত হতো, রামমোহনকে জেলে যেতে হতো, রবীন্দ্রনাথকে জেলে হতো। প্রশ্ন, এঁরা কি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছিলেন? রাইসুর ভাষ্য অনুযায়ী এঁরা সবাই ধর্মীয় দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা। কী হাস্যকর!
প্রশ্ন উত্থাপন আর ভিন্নমত যদি ধর্মীয় দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি হয়, তাহলে তো এই কাজটিই করে যাচ্ছেন বাংলার আলেম সমাজ। আহমদ শফি, জুনায়েদ বাবুনগরী, চরমোনাই পীর প্রমুখের মতে ইসলামের নবি মুহাম্মদ মাটির তৈরি মানুষ। অপরপক্ষে গিয়াসউদ্দিন তাহেরি প্রমুখের মতে নবি মুহাম্মদ নূরের তৈরি। এই নিয়ে তাদের ঝগড়া-বিবাদের অন্ত নেই। একপক্ষ আরেকপক্ষকে কাফের বলতেও ছাড়ছে না। কোরান-হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে একপক্ষ নবিকে মাটির তৈরি বলছেন, আরেকপক্ষ নূরের তৈরি বলছেন। কোনটা সত্য? যারা নবিকে মাটির তৈরি বলছেন, তারা কি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছেন? কিংবা যারা নূরের তৈরি বলছেন, তারাও কি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছেন? এক ধাপ এগিয়ে মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী তো হযরত আলীকে মদ্যপও বলেছেন। এটাও কি সাম্প্রদায়িক উস্কানি? এগুলো যদি সাম্প্রদায়িক উস্কানি না হয়, গানের পক্ষে শরিয়ত বয়াতির চ্যালেঞ্জ কেমন করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি হয়? ব্লাসফেমি আইন চালু হলে তো প্রথমেই জেলে যেতে হবে নানা তরিকা বা ধারায় বিভক্ত আলেম সমাজকে। কারণ, রাইসুর ভাষ্যমতে, তারাই সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে যাচ্ছেন বর্তমানে।
রাইসু সম্ভবত ইসলাম বলতে সৌদি-আমেরিকা পরিচালিত ও প্রযোজিত ওয়াহাবিবাদী ইসলামকে বোঝেন। সম্ভবত তিনি জানেন না খাজা মুঈনউদ্দিন চিশতির চিশতিয়া তরিকার লক্ষ লক্ষ অনুসারী যে বাদ্যযন্ত্রসহকারে ‘সামা’ বা গান গেয়ে থাকেন। একইভাবে গান গেয়ে থাকেন কাদরিয়া তরিকার অনুসারীরাও। শুধু কি গান? মরমি কবি জালালউদ্দিন রুমির সমাধিস্থলে তো মসজিদের পাশাপাশি নৃত্যশালাও রয়েছে। মরমি-সাধকরা সেখানে নৃত্য করে থাকেন। তারা কি নৃত্য করে বা নৃত্যের পক্ষে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে ধর্মীয় উস্কানি দিচ্ছেন? ব্লাসফেমি আইন চালু হলে তো তাদেরকেও গ্রেপ্তার করতে হবে।
গতকাল রাইসুর পরিচিতি লিখেছিলাম কবি ও বুদ্ধিজীবী। এখন মনে হচ্ছে, না, তিনি কেবলই উদাসীন কবি, বুদ্ধিজীবী নন।
১৬.১.২০২০