
মারুফ ইসলামের আত্মগদ্য ‘দহনদিনের লিপি’
পর্ব ৪
প্রকাশিত : এপ্রিল ১৯, ২০২১
১৮ এপ্রিল ২০২১ রোববার
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করব, নাকি যা হয় হোক আমার কী বলে চলে যাব, বুঝে উঠতে না পেরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর চিরকালীন মধ্যবিত্ত, ভীরু, পলায়নপর, গা বাঁচিয়ে চলা সত্তাটাই জয়ী হলো। আমি কিছু বোঝার চেষ্টা না করেই ঘটনাস্থল দ্রুত ত্যাগ করলাম।
তখন দুপুর মাত্র গড়াতে শুরু করেছে। আমি অফিস থেকে বাসার দিকে যাচ্ছি। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে একটু সামনে হাতের ডানে বিশাল এক মাদ্রাসা। কী যেন নাম... জামিয়া রাহমানিয়া এরকম কিছু একটা। এই মাদ্রাসার নাম বহুবার মুখস্ত করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মনে থাকে না। এখন অবশ্য ইচ্ছে করলেই গুগলে সার্চ দিয়ে নামটা বের করা যায়। দেব কি? সব ইচ্ছেকে পাত্তা দিতে নেই। জীবনের কত গুরুত্বপূর্ণ ইচ্ছেকেই তো পাত্তা দিলাম না! থাক গে।
দেখলাম, মাদ্রাসাটির সামনের রাস্তায় শত শত কিশোর-তরুণ-যুবক ছেলে। পুলিশও রয়েছে সমানুপাতিক হারে। মাদ্রাসার ছেলেগুলো চিৎকার করে কী যেন শ্লোগান দিচ্ছে। জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে বুঝলাম, বাকিটা বুঝলাম না। খুবই অস্পষ্ট। হট্টগোল, চিৎকার, চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। পুলিশ ঘিরে রেখেছে তাদেরকে। সামনে এগোতে দিচ্ছে না।
কী হচ্ছে, কিছুই বুঝলাম না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছি। ভিড়ের মধ্যে যাব কি যাব না এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে শেষে ভীরু মন নিয়ে পালালাম। বাসায় এসে ফেসবুকে ঢুকে দেখি, মামুনুল হক গ্রেফতার। এবং ওই মাদ্রাসা থেকেই। এতক্ষণে অরিন্দম বুঝিলাম বিষাদে। এই ছিল ভিড়ের কারণ!
এর বাইরে আরও এক ঘটনা ঘটে গেছে। সেটাও জানলাম ফেসবুক মারফতে। ঘটনাস্থল পান্থপথ। এক ডাক্তারের গাড়ি আটকিয়েছে এক পুলিশ। এই নিয়ে পুলিশ-ডাক্তার ঝগড়া। মাঝখানে রেফারির ভূমিকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। একই ঘটনার দুটি ভিডিও দেখলাম। আমার ফ্রেন্ড লিস্টের পুলিশ বন্ধুরা শেয়ার করেছেন সেই অংশ, যে অংশে পুলিশের ভূমিকা নিরাপদ এবং নির্দোষ। আবার ডাক্তার বন্ধুরা শেয়ার করেছেন সেই অংশ, যেই অংশে ডাক্তার ভদ্রমহিলার ভূমিকা নিরাপদ ও নির্দোষ। বুঝলাম, শেয়ারকৃত ঘটনার আগেও ঘটনা আছে, সেটুকু কোনো পক্ষই শেয়ার করছেন না। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, এ জাতি বহু আগেই ভিডিও কাটপিস করতে শিখেছে। এ ভিডিওও কাটপিস করবে, নিজেদের পছন্দের অংশটুকু কেটে কেটে শেয়ার করবে, তাতে অবাক হওয়ার কি?
মনটা বিষাদে ভরে গেল অন্য কারণে। বিবদমান দু’পক্ষই উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজের সবচেয়ে এলিট শ্রেণির। একজন বিসিএস ক্যাডার ম্যাজিস্ট্রেট, আরেকজন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। অথচ রাস্তায় তারা কি পরিচয় দিলেন! সভ্যতা, ভব্যতার সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘন করলেন তারা। দু’পক্ষই প্রাণপণে যা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন তার নাম `আমারে চিনস?` মনোভাব। এই মনোভাব মানুষ নামের প্রাণির মধ্যে থাকা উচিত নয়।
কিন্তু আমরা তো বহু আগেই এই উচিত-অনুচিতের ঊর্ধ্বে উঠে গেছি। আমাদের চারপাশ ভরে ফেলেছি আমিই সেরা, আমিই শ্রেষ্ঠ, আমারে চিনস মনোভাবের সুপারফিশিয়াল মানুষ দিয়ে। প্রত্যেকেই মনে করছি আমার চেয়ে ও বেশি খারাপ। ওর খারাপির তুলনায় আমার খারাপি গৌণ। পুলিশ ভাবছে হারামজাদা ডাক্তার, ও তো কসাই। অন্যায়ভাবে মানুষকে টেস্ট করায়, আইসিইউতে রাখে, ভুল চিকিৎসা দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলে। ওর তুলনায় আমি অনেক ভালো মানুষ। ডাক্তার ভাবছে, পুলিশ কি মানুষের মধ্যে পড়ে? ও তো অসভ্য ইতর ছোটলোক। অযথা মানুষকে হয়রানি করে, মামলা দেয়, জিম্মি করে, ভয় দেখিয়ে টাকা নেয়, পাঁচ টাকার লোভও সামলাতে পারে না, রিকশাওয়ালার মতো গরিবের কাছ থেকেও ঘুষ খায়, সেকি মানুষ?
একইভাবে রিকশাওলা ভাবছে সিনজিওলা বেশি খারাপ, সিএনজিওলা ভাবছে প্রাইভেট কারওয়ালা বেশি খারাপ, সবগুলো গাড়ি ঘুষের টাকায় কেনা ইত্যাদি। নিজের চেয়ে অন্যকে বেশি অপরাধী ভাবা এবং অন্যের চেয়ে নিজেকে নিষ্পাপ মাসুম শিশু মনে করা মানুষে থইথই করছে জগৎ সংসার। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? উপায় খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, এক নিঃসঙ্গ করোনা রোগী উঁচু হাসপাতাল থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে!
মনটা বিষাদে ভরে গেল। এত বিষাদ নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। আমি সন্ধ্যার দিকে বাজারে গেলাম। ঢেঁড়স কিনলাম, এলাচ-দরুচিনি আরো কি কি সব মশলা কিনলাম, মশার কয়েল কিনলাম। তারপর বাসায় ফিরলাম।
রাতে এই দিনপঞ্জি লিখতে লিখতে ভাবলাম, বাংলাদেশ মানে তো শুধু ঢাকা নয়। ঢাকার বাইরেও বিশাল এক বাংলা পড়ে আছে। সেখানেও কি ভালো কিছু ঘটছে না? একটু ঘাটাঘাটি করতেই কয়েকটা খবর চোখে পড়ল।
১. একজন বাবা সুন্দরবনে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে তার ছেলের জীবন বাঁচিয়েছে।
২. মায়ের মুখে মাস্ক। এক ছেলে তার নিজের পিঠের সঙ্গে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বেঁধে সেই মাকে ১৮ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে।
৩. কড়া লকডাউনে যখন গণপরিবহন বন্ধ তখন এক রিকশাচালক নয় ঘণ্টা রিকশাচালিয়ে ঠাকুরগাঁও থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরের রংপুর হাসপাতালে নিয়ে গেছে তার মরণাপন্ন সাত মাসের মেয়েশিশুকে।
গল্পের উল্টোপিঠে এইসব গল্পও তো আছে।