
মারুফ ইসলামের আত্মগদ্য ‘দহনদিনের লিপি’
পর্ব ৫
প্রকাশিত : এপ্রিল ২০, ২০২১
১৯ এপ্রিল ২০২১ সোমবার
সরকার জানাচ্ছে, আজ রেকর্ড সংখ্যক মানুষ করোনায় মারা গেছে। সংখ্যাটা ১১২! মানুষের মৃত্যু এখন শুধুই সংখ্যা। তবে আমরা যারা এখনো জীবিত আছি, তাদের ধারণা, সরকার প্রকৃত সংখ্যা এখনও লুকোচ্ছে। এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে আমাদের? না, নেই। থাকা উচিতও নয়। প্রকৃত সংখ্যা জানলেই বা আমরা কী করতে পারতাম। বস্তুত আমাদের কিছু কী করার আছে? নেই। আমরা তো পুতুল বৈ অন্য কিছু নই ডাক্তার বাবু। উপরে বসে কেউ একজন খেলাচ্ছেন।
উপরওয়ালাই শুধু উপরে বসে খেলান, তা কিন্তু নয়। আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সরকার, আমাদের ক্ষমতাবানরাও এক অর্থে উপরওয়ালাই। তারাও নানাভাবে আমাদের নিয়ে খেলেন। তা খেলুন। কি আর করা!
সকালে হাসপাতাল থেকে যখন অফিসে যাচ্ছিলাম, দেখলাম সেই ধারাবাহিক খেলা। আজও রাস্তার পাশে চার পাঁচটি রিকশা উল্টানো। এই লকডাউনে রিকশাওয়ালাদেরকে নিয়ে পুলিশ একটু বেশিই খেলছে বলে মনে হচ্ছে। লকডাউনের শুরু থেকে প্রায় প্রতিদিনই একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে, এবং এমন একটি দিন নেই যেদিন উল্টানো রিকশা আমার চোখে পড়েনি। চোখের সামনে দিয়ে দেদারছে বহু প্রাইভেট কার চলে যাচ্ছে, কিন্তু তাদেরকে কখনো আটকাতে দেখলাম না।
আমরা জানি, যেকোনো প্রতিষ্ঠানই নিপীড়ক। সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবার; সেও টিকে থাকে পরিবারের ছোট এবং ক্ষমতাহীন সদস্যদের নিপীড়ন করে। আর সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানের নাম রাষ্ট্র। তার নিপীড়নের কথা না-ই বা বললাম। বললে বিপদ আছে। বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং!
উল্টানো রিকশার দৃশ্য পেরিয়ে হাঁটছিলাম। একটা গান আছে না, শিশু না কাল গেল ধুলা আর বালিতে/যৌবনও কাল গেল রঙে/ বৃদ্ধ না কাল গেল ভাবিতে চিন্তিতে/গুরু ভজিবি কোন কালে গো সাঁইজি/কার আশায় বান্ধিয়াছ ঘর... আমার মনে হয়, পৃথিবীতে আসার আগে আমি সম্ভবত স্রষ্ঠার কাছে এই প্রতিজ্ঞা করে এসেছি যে, শিশুকাল যৌবনকাল বৃদ্ধকাল— সব কালই আমি কাটাব হাঁটিতে হাঁটিতে।
হেঁটে হেঁটে দারুস সালাম পেরিয়ে এসে দেখি, এক গাছের ছায়ায় রিকশা দাঁড় করিয়ে আরামে ঘুমুচ্ছে এক চালক। নিরপরাধ ঘুম। আমার মনে হলো, লোকটাকে ঘুম থেকে ডেকে বলি, আপনি কি রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা পড়েন নাই? ফ্রস্ট বলেছেন, ঘুমিয়ে পড়ার আগে যেতে হবে বহুদূর। ঘুমাচ্ছেন কেন ভাই? ওঠেন ওঠেন। আমার সঙ্গে হাঁটেন।
হেঁটে হেঁটেই অফিসে গেলাম। মাথার উপর ঠাডা পড়া রোদ, বৈশাখের সূর্য, সে কি তেজ, মগজ গলে পড়ার উপক্রম! ঘামতে ঘামতে, হাঁপাতে হাঁপাতে কত কিলোমিটার পাড়ি দিলাম জানি না। মোবাইল বের করে দেখলাম ১ ঘণ্টা ৫২ মিনিট হেঁটেছি। ব্যাপার না!
অফিসে বসে কাজকর্ম কিছু করলাম। তারপর বিকেল নাগাদ বেরুলাম। মোহাম্মদপুরে গিয়ে ভাবলাম, হালকা বাজার করা দরকার। দুই একটা সবজি নেওয়া যেতে পারে। বাজারে ঢুকে কচুর লতি কিনতে চাইলাম। দোকানদার ভদ্রলোক বললেন, ৬০ টাকা কেজি। ঠিক আছে, তাই সই। বললাম, দেন আধা কেজি।
না, আধা কেজি দেওন যাইব না। এক কেজির কমে বেচি না।
মানে কী? এক কেজি নিতে হবে? হতভম্ভ হয়ে প্রশ্ন করলাম।
হ। কমপক্ষে এক কেজি লইতে হইব।
এর কমে আপনি দেবেন না?
না। কইলাম তো। কচুর লতি মানুষ এক কেজি কইরাই লয়।
এ আবার কেমন আইন? আইনটা কি আপনি বানিয়েছেন?
তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলেন।
মেজাজ খারাপ করে বাজার ত্যাগ করলাম। এমন এক অসভ্য ইতরদের দেশে থাকি, এখানে প্রত্যেকেই আইন প্রণেতা। যার যার ইচ্ছামতো আইন তৈরি করে। যত্তসব!
ইফতারের আগে পর্যন্ত মেজাজ আর ঠিক হলো না। চলবে