মারুফ ইসলামের গদ্য ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির কুয়াশায় বাবার মুখ’
প্রকাশিত : জুন ২১, ২০২০
সম্ভবত ক্লাস থ্রিতে পড়ি। স্কুল থেকে মহাসমারোহে শিক্ষাসফরে যাওয়া হলো। কোথায়? তখন দিনাজপুরে ‘স্বপ্নপুরী’ নামে দেখার মতো এক জায়গা গজিয়ে উঠেছে, সেখানে। বাস ভাড়া করে হই হই করে গেলাম। দেখা হলো অনেক কিছুই, তবে স্বপ্নপুরীর স্বপ্নময় নানা দৃশ্যকে ছাপিয়ে একটি দৃশ্য আমার মনে ডাকটিকেটের মতো গেঁথে গেল। সেটি হলো, মাটি দিয়ে উঁচু করে তৈরি করা একটা বাংলাদেশের মানচিত্র। তার বুকে হরেক রকমের পুষ্পবৃক্ষ।
আমার তখন বাগান করার শখ ছিল। বাড়ির উঠোনে ছোট্ট একটা ফুলবাগান ছিল। স্বপ্নপুরী থেকে ফিরে সেই ফুলবাগানে আরও মনোযোগী হলাম। এরমধ্যে আমাদের বাড়ির পাশের কাদামাটির রাস্তাটা পাকা হতে শুরু করল এলজিইডি মন্ত্রণালয়ের আশির্বাদে। প্রতিদিন ট্রাক ভর্তি করে ইট আসে। বালু আসে। রাস্তার পাশে স্তুপ করে ফেলে রেখে চলে যায়। সে এক এলাহী কাণ্ড।
আমার ছোট মাথায় বড় একটা বুদ্ধি এলো। ছোট চোখে বড় একটা স্বপ্ন উঁকি দিলো। আমি স্বপ্ন পূরণ করার উদ্দেশ্যে একদিন সক্কালবেলা ছোট বালতিটা হাতে নিলাম। বলে রাখি, এই ছোট্ট বালতি দিয়েই আমি আমার ফুল গাছগুলোতে পানি দিতাম। বালতিটা নিয়ে সোজা চলে গেলাম রাস্তার পাশে। পাহাড়ের মতো স্তুপ করে রাখা বালুর মধ্যে বালতিটা সেঁধিয়ে দিয়ে বালুভর্তি করে ফেললাম কেউ দেখার আগেই। তারপর অতিগোপনে নিয়ে এলাম বাগানে।
উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, ওই যে স্বপ্নপুরীতে একটা বাংলাদেশের ম্যাপ দেখেছিলাম, সেরকম একটা ম্যাপ তৈরি করা। ভেবেছিলাম, এই বালুর সঙ্গে কিছু মাটি মিশিয়ে উঁচু করে ছোট্ট একটা মানচিত্র বানাব—বাংলাদেশের মানচিত্র। তারপর সেখানে পুঁতে দেব টাইমফুলের ডাঁটা।
আব্বা তখন ইশকুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। হঠাৎ তার চোখ গেল বাগানের দিকে। আমার কাছে এসে বললেন, ‘বালু কোথায় পেলি?’
‘ওই যে রাস্তা থেকে আনছি।’
‘এক্ষুণি রেখে আয় ওখানে।’ হুংকার দিলেন আব্বা। ‘বালু কি তোর? অন্যের জিনিস নিতে হয় না, জানিস না?’
আব্বার হুংকারে সারা গ্রাম কাঁপত। তার ধমকের বিশেষ খ্যাতি ছিল। আমি কাঁদতে কাঁদতে বালতিভর্তি বালু আবার রেখে এলাম আগের জায়গায়। গ্রামের কতজনে ইট-বালু-খোয়া চুরি করে কল-পায়খানা বানিয়ে ফেলল, কিছু হলো না। আর আমি মাত্র এক বালতি বালু এনেছি তাই আব্বা এরকম ধমক দিলেন! ভীষণ অভিমান হলো আব্বার উপর।
২.
আব্বার মুখে দাঁড়ি-গোফ ছিল না। তিনি ক্লিন সেভড থাকতে পছন্দ করতেন। বাড়িতেই নিজে নিজে ক্ষৌরকার্য সারতেন। সেলুনে যেতেন না। এমনকি মাথার চুল কাটাবার জন্যও না। মা সবসময় আব্বার চুল ছেঁটে দিতেন। বাড়ির আঙিনায় কাঠের টুলের উপর আব্বা বসে আছেন হাতে আয়না নিয়ে। মা তার ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকে কাঁচি দিয়ে চুল ছেঁটে দিচ্ছেন। আব্বা আয়নায় তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন ঠিকঠাক চুল ছাঁটা হচ্ছে কি না। একটু ভুল হলেই ‘উমহুহ’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করছেন। পরক্ষণেই প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশা দিচ্ছেন। এটি ছিল ছোটবেলায় দেখা আমার স্মৃতিতে অন্যতম মধুর একটি দৃশ্য।
৩.
আব্বা প্রায় রোগবিরল মানুষ ছিলেন। খুব একটা অসুস্থ হতেন না। শিক্ষকতা, কৃষিকাজ আর কয়েকটা গরু নিয়ে সারাদিনমান ব্যস্ত থাকতেন। নিজের কাজ নিজে করতে চাইতেন। পারতপক্ষে কারও শরনাপন্ন হতেন না। মাঝে মাঝে বলতেন, ‘চল, আলুর জমিতে একটু পানি দিয়ে আসি।’ রাজ্যের বিরক্তি আর এক পৃথিবী অনিচ্ছা নিয়ে তখন আব্বার পিছু পিছু হাঁটতাম। সামনে আব্বা, তার এক হাতে শিনি (পানি সেচের বিশেষ পাত্র) আর কাঁধে কোদাল। তিনি ধীর পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
শিনি দিয়ে পানি সেচা কষ্ঠসাধ্য কাজ। অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠতাম। কারণ আমি ছিলাম আজন্ম রোগী। ভীষণ দুর্বল আর লিকলিকে। আমার দিকে তাকিয়ে আব্বার চোখেমুখে অদ্ভূত এক অসহায়ত্ব ফুটে উঠত। তিনি শিনি রেখে বলতেন, ‘একটু দম নে, বাবা।’ সেদিনের সেই দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার সামনে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় এক পিতার মুখ।
৩.
তখন মাঝে মাঝে বন্যা হতো। আব্বা জাল হাতে নিয়ে বলতেন, ‘চল, মাছ ধরে আনি।’ আবারও রাজ্যের বিরক্তি আর অনিচ্ছা নিয়ে আব্বার পেছন পেছন যেতাম। আমার হাতে থাকত মাছ রাখার খলুই।
একবার ভীষণ বন্যা হলো। সম্ভবত আটানব্বই সাল। আব্বার সঙ্গে মাছ ধরতে গেলাম নদীতে। নদী না বলে নালা বলাই ভালো। ছোট্ট, সরু, সাপের মতো। আমরা বলি ‘ডাঁরা’। ডাঁরা উছলে উঠল পানিতে। নানা জায়গা থেকে ভেসে এলো মাছ। সেসব মাছ শিকার করতে জাল নিয়ে গেলেন আব্বা। সঙ্গে আমি। একটা সময় ডাঁরা পার হয়ে অপর পাড়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। কিন্তু আমি তো তখনও সাঁতার জানি না। কী আর করা! আব্বা আমাকে তার কাঁধে তুলে নিলেন। তার এক হাতে জাল, এক হাতে আমাকে ধরে সাঁতরে পার হয়ে গেলেন জলে উচ্ছ্বল ডাঁরা।
৪.
এসব স্মৃতির বহুবছর পরের ঘটনা। আমি ততদিনে আব্বার কাঁধ থেকে নেমে জীবনের নদীতে ঝাঁপ দিয়েছি। এই ডুবি, এই ভাসি—সাঁতারভোলা কেউ। ঢাকায় থাকি। ঢাকা থেকে দুই ঈদে বাড়ি যাই।
একবার বাড়ি গিয়ে আব্বার দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আব্বার ক্লিন শেভড মুখজুড়ে শুভ্র কাশফুলের মতো একরাশ সফেদ দাঁড়ি। আব্বাকে চেনা যায় না। আশৈশব যে আব্বাকে দেখে এসেছি, সে আব্বা তো ইনি নন।
একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে আব্বা বসে ছিলেন আমাদের বাড়ির বারান্দায়। তার দুই বাহুর টান টান পেশি আর নেই। শিনি দিয়ে পানি সেচার সময় তার যে বাহুর পেশিগুলো ফুলে ফুলে উঠত সেগুলো এরমধ্যেই হারিয়ে গেল! তার এক হুংকারে যে সারা গ্রাম কেঁপে উঠত, সেই হুংকারও নেই। তিনি আর কাউকে ধমক দেন না। শশ্রুমণ্ডিত আব্বাকে দেখে মনে হচ্ছিল তার বয়স হঠাৎ করে তিরিশ বছর বেড়ে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ল সুমন চ্যাটার্জীর সেই গান—তিনি বৃদ্ধ হলেন। আমার বুকের ভেতরের বালকটা হাইমাউ করে কেঁদে উঠল।
৫.
দিন কয়েক আগে ছোট বোনের ফোন। ‘আব্বার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ে। ঝাপসা দেখে। পরিষ্কার কিছু দেখতে পায় না।’
‘এইসব লকডাউনের মধ্যে কোথায় নিয়ে যাব, কী করব। ভালো বিপদ হলো তো!’ বললাম আমি।
ছোটবোন বলল, ‘সান্তাহার একটা চোখের ডাক্তার আছে। আপাতত ওইখানেই যাই না হয়।’
‘আচ্ছা যা তাহলে।’
তারা ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার চোখ পরীক্ষা করে। ওষুধ দেয়। ড্রপ দেয়। তারা ফিরে আসে বাড়িতে। মাসখানেক পেরিয়ে যায়। তারপর গতপরশু আবার ফোন। ‘আব্বার চোখের অবস্থা খুবই খারাপ। এখন প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।’
বললাম, ‘ওই ডাক্তারের কাছে আবার নিয়ে যা।’
তারপর ফোনটা রেখে দিলাম। দূরে কোথাও করুণ গলায় কেউ গেয়ে উঠল—তিনি বৃদ্ধ হলেন। শুনতে শুনতে আমার বালিশ ভিজে উঠল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
৬.
ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখলাম। কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বিরলতম কষ্ট কোনটি? আমি তখন উত্তরে বলছি—চোখের সামনে নিজের বাবা মাকে বৃদ্ধ হতে দেখা। সন্তানের জন্য এরচেয়ে বিরলতম কষ্ট আর কিছু নেই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
























