
মাহবুব মোর্শেদের গদ্য ‘ই-বুকের ভবিষ্যৎ’
প্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০২১
২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আমি ই-বুক নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল, ছাপা কাগজের বইয়ের দিন শেষ হয়ে আসবে শীঘ্রই। স্থান করে নেবে ই-বুক। স্মার্টফোনের মতো যন্ত্রে ই-বুক পড়ার ভালো ব্যবস্থা হবে। যারা স্মার্টফোনে বই পড়বে না তাদের হাতে হাতে ঘুরবে কিন্ডেল, নুকের মতো ডিভাইস। ই-বুকের বাজার ধীরে ধীরে বাড়বে, এমনকি ই-বুকের একটা বড় বাজারও তৈরি হবে।
এ চিন্তা থেকে বইয়ের দোকান নামে একটা ই-বুক সাইটও তৈরি করে চালিয়েছিলাম বেশ কয়েক বছর। সে সময় উদ্যোগটা অনেকটা নতুন ছিল। তখন ই-বুকের যত সাইট ছিল তাতে জনপ্রিয় বইগুলোর পাইরেটেড বই-ই মূলত পাওয়া যেত। লেখকের অনুমতি ছাড়া বইগুলো স্ক্যান করে আপলোড করা হতো। এখনও এমন উদ্যোগ আছে। আমি চেষ্টা করেছিলাম, লেখকদের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে বই আপলোড করতে। এবং সেগুলো বিনামূল্যে ডাউনলোড করার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল, জনপ্রিয় হলে, এ সাইট থেকে ই-বুক বিক্রির ব্যবস্থাও করা হবে। কিন্তু, প্রায় ১৪০টা বই আপলোড করার পরও তেমন সাড়া পাওয়া গেল না।
সমসাময়িক লেখকদের বইয়ের প্র্রতি পাঠকদের আগ্রহ কম থাকতে পারে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, ছাপা বই নিয়ে যে আগ্রহ দেখা যায় ই-বুকে তেমন আগ্রহও দেখা গেল না। আমার আরেকটা ধারণা ছিল, প্রবাসে যে বাঙালিরা থাকে এবং যাদের কাছে কাগজের বই পৌঁছানো একটা কঠিন ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার তারা হয়তো ই-বুক নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখাবে। কিন্তু সেটিও প্র্রত্যাশিত মাত্রায় সফল না হলে আমি এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। এসব অনেক দিন আগের কথা।
সাম্প্রতিক আরেকটা অভিজ্ঞতা বললে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। কয়েকমাস আগে আমি আমার ফেস বাই ফেস উপন্যাসটির পিডিএফ ফরম্যাট বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ফেসবুকের ইনবক্সে এবং মেইলে প্রায় পাঁচশো জনকে বই পাঠাই। গত তিন চার মাসে সাকুল্যে পাঁচজন আমাকে বলেছেন তারা বইটি পড়েছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। আমি নিজেও ল্যাপটপে হাজার খানের ই-বুক নামিয়ে রেখেছি। কিন্তু সেগুলোর মধ্য থেকে খুব কমই পড়া হয়েছে। সে বইটাই পড়া হয়েছে যেটার প্রিন্ট ভার্সন আমার কাছে নেই। প্রিন্ট ভার্সন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অথবা যে বইটি এখনই না পড়লে আর চলছে না।
এটা কেন হয়? এর আরেকটা কারণ সম্ভবত ডিভাইসের নানা উপাদানের প্রলোভন। ল্যাপটপ বা ফোনে বই পড়তে বসলে অন্য অনেক দিকে চোখ চলে যায়। বই পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা খুব কঠিন। বই পড়তে কাগজের বই-ই শেষ পর্যন্ত হাতে তুলে নিতে হয়, স্মার্টফোন তুলে রেখে। আমাদের পরের প্রজন্মের পাঠকদের অনেকেই হয়তো ই-বুকে অভ্যস্ত। ই-বুক পড়ে অনেকের পাঠাভ্যাস তৈরি হয়েছে। তাদের কাছে ই-বুক জনপ্রিয়। কিন্তু যে প্রজন্মের কথা বলছি, সে প্রজন্মে পাঠাভ্যাসটাই বিরল ব্যাপার বলে মনে হয় আমার কাছে। তাদের কাছে অডিও-ভিজুয়াল বরং ই-বুকের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হওয়ার কথা। তবু ধরে নিচ্ছি তাদের এই প্রজন্মগুলোর কাছে ই-বুক বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু, এ প্রজন্মগুলোতে পাঠকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
পাঠক বেশি আমাদের আগের প্রজন্মগুলোতে। আমাদের প্রজন্মেও পাঠক আছে। এই পাঠকরা ছাপা কাগজে পড়ে বই অভ্যস্ত। ছাপা কাগজের বই নিয়ে নানা নস্টালজিয়ার কথা বাদ দিয়ে যদি শুধু পাঠাভ্যাসের কথা বলি তবু অভ্যস্ততার কারণে আগামী ত্রিশ-চল্লিশ বছর বইয়ের ভবিষ্যৎ ছাপা কাগজের বই-ই। এটাই আমার কাছে আপাতত মনে হচ্ছে। একটা কথা তো স্পষ্ট, বইয়ের পাঠক কমবে। এভারেজ মানুষের জ্ঞান ও তথ্যের যে তৃষ্ণা সেটা ইন্টারনেটেই মিটে যায়। গল্পের তৃষ্ণাও অনেকটা মিটিয়ে দেয় অডিও-ভিজুয়াল। ফেসবুকের কারণে কিছু কমপ্লেক্স সিচুয়েশনে লোকে নিজেরাই বাস করে। এই পরিস্থিতিতে সামনের দিনে সমাজে কম লোকের বই পড়ার প্রয়োজন হবে। কম কম মানুষ অরিজিনাল টেক্সট খুলে নিবিষ্ট মনে কোনো ঘটনার আদ্যোপান্ত জানার প্রয়োজন বোধ করবেন।
চারশো-পাঁচশো পৃষ্ঠার উপন্যাস পড়ার দরকার হবে খুব কম মানুষের। সমাজে এই লোকেগুলো ভবিষ্যতে গোপন বই পড়া সংগঠনের সভ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। তারাই সামাজিক মাধ্যমে ও ইন্টারনেটে অরিজিনাল টেক্সটের কথা আলোচনা করবেন। অরিজিনাল টেক্সটকে অডিও-ভিজুয়ালে রূপান্তরিত করে আমজনতার উপভোগ্য করে তুলবেন। এই বিশেষ লোকগুলোই বই পড়তে থাকবে। আর তাদের কাছে ই-বুক বিশেষ ফ্যাক্টর হবে না। তারা কাগজের বই-ই হয়তো শেষ পর্যন্ত পড়ে যাবেন। অনেকেই আমাকে বলেন, আসেন আবার একটা ই-বুকের অ্যাপ বা সাইট করি। আমি তাদের নিরুৎসাহিত করি। এর অন্যতম কারণ হলো, পাঠ্যাভ্যাস। যেখানে কাগজের বই-ই লোকে পড়তে চায় না সেখানে ই-বুক কষ্ট করে কেন পড়বে? তাছাড়া ই-বুক মূলত ফ্রি দিতে হয়, বই বিক্রির সহজ কোনো উপায় নেই।
পাশ্চাত্যে হয়তো ঘটনাটা ভিন্ন। পাঠাভ্যাস ও জীবনযাত্রার আপডেটেড ধরনের কারণে তারা ই-বুকেও যেমন অভ্যস্ত তেমনি কাগজের বইয়ের কদরও তাদের ভেতর কমেনি। কিন্তু আমাদের দেশে শেষ পর্যন্ত ছোট একটা গোষ্ঠীর মধ্যে হলেও ছাপা বইয়ের আকর্ষণই টিকে থাকবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী