
মাহবুব মোর্শেদ
মাহবুব মোর্শেদের গদ্য ‘দুনিয়ার দিকদারি’
প্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০২২
আশপাশের মানুষের দিকে তাকান। যারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিচারে সফল, তারা কেমন মানুষ? যারা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত, নানা ক্ষেত্রে আমাদের নেতৃত্ব দেন, তারা কি বইপত্র পড়েন? তাদের কি কোনোভাবে বিদ্বান বলা চলে? কিংবা তারা কি জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত? পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে আপনি কি তাদেরকে প্রজ্ঞাবান হিসেবে চিনিয়ে দিতে পারেন?
আমার মনে হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের নানা ক্ষেত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জ্ঞানী বা বিদ্বান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া কঠিন। সে প্রয়োজনও নেই হয়তো। দুনিয়ার দিকদারি জানতে, বুঝতে ও আয়ত্ত করতে হলে বইয়ের সাহায্য পাওয়া যাবে, এমন কোনো কথা নেই। যদি জ্ঞানী ব্যক্তিরা এই সফল হতেন তবে বড় বড় অর্থনীতিবিদরা সফল ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হয়ে উঠতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা হতেন বড় বড় পলিটিশিয়ান। যারা কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের রাজনীতি বোঝেন তারা হতেন জনপ্রিয়তম নেতা। আসলে তা ঘটে না।
সম্পদ অর্জন, সারভাইভাল ও আধিপত্য বিস্তারের বিদ্যা মানুষ বই থেকে শিখতে পারে না। এই ব্যাপারগুলো তাকে জীবন থেকে নানা রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। ফলে আপনি দেখবেন, আপনার চেয়ে কম ইংরেজি জানা লোকটি ফাইভ স্টার হোটেলে বসে ব্রিটিশ আমেরিকান ইউরোপিয়ান বায়ারদের সঙ্গে দিব্যি ইংরেজিতে কথাবার্তা বলছে। হাজার হাজার কোটি টাকার বিজনেসও করছে। যে লোকটি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না তিনি হয়তো গিয়ে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হচ্ছেন। কে ইংরেজিতে ভালো কথা বলে, কে রবীন্দ্রনাথের বিশেষজ্ঞ সেটা এখানে ম্যাটার করে না। দুনিয়ার দিকদারি সবচেয়ে বেশি কার জানা সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ফলে, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য কে পড়ালেখা করলো আর কে করলো না, তাতে খুব বেশি যায় আসে না। তবে বিদ্যার সার্বিক মান জাতিগত অবস্থানের ক্ষেত্রে হেরফের তৈরি করে দিতে পারে। ইউরোপের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে আসা ব্যক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষলাভ করা ব্যক্তিদের বিস্তর ব্যবধান থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কেননা বিদ্যালয়গুলোর মূল কাজ হলো মানুষকে বেসিক সেই সব বিষয় শিক্ষাদান করা যেগুলো তাকে ভবিষ্যতের সার্ভাইভাল ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে সহযোগিতা করতে পারবে। এক্ষেত্রে কোনো একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি ব্যর্থ হয়, তবে সেই দেশের নাগরিকরা আশপাশের অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়তে থাকবে। এবং একসময় তারা হয়তো অন্যের অধীনতা মেনে নিতেও বাধ্য হবে। সারভাইভালের লড়াইয়ে হেরে যাবে। ফলে আজকে যে লোকটি সারভাইভ করে যাচ্ছে তার উত্তরসূরিরা একইভাবে সারভাইভ করতে পারবে কিনা, প্রশ্ন থেকেই যায়।
ফলে সার্বিকভাবে শিক্ষার মান বাড়ানো প্রথম কর্তব্য। তবে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান বাড়ালেই চলবে না। লোকে যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়েও জানতে চায়, পড়তে চায় এবং শিখতে চায় সে উৎসাহ তৈরি করতে হবে। সার্বিকভাবে, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী একটি বড় জনগোষ্ঠী ছাড়া জাতিগত উন্নয়ন সম্ভব নয়। পড়াশোনা করলেই যে ঘটনাটি ঘটবে তা নয়। কিন্তু পড়াশোনার চর্চা ব্যাপকভাবে ছড়ালে ছড়ানো ছিটানো প্রতিভা রাস্তা খুঁজে পাবে এবং নিজেকে সারভাইভালের জন্য প্রস্তুত করে ফেলতে পারবে।
ইন্টারনেটের যুগে পড়াশোনাটা আরো বেশি প্রয়োজনীয়। কেননা স্মার্ট ডিভাইসগুলো হাতে নিয়ে ছেলেমেয়েরা এখন যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি খোঁজে তা হলো বিনোদন। তারা নানাভাবে আনন্দিত ও শিহরিত হতে চায়। এবং আনন্দিত ও শিহরিত হতে হতে পরিস্থিতি একসময় এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যে, কিছুই আর তাদের আনন্দিত ও শিহরিত করতে পারে না। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, ছবি ছাড়া, ভিডিও ছাড়া, চমকপ্রদ তথ্য ও টুইস্ট ছাড়া এই যুগের অডিয়েন্স আপনি আকৃষ্ট করতে পারছেন না। ফলে নিত্যনতুন কারিগরির আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কিন্তু মানুষের চাহিদার সঙ্গে সেই কারিগরি পেরে উঠছে না। আমাদের বলা হচ্ছে, এভাবে তথ্য ও বিনোদন সরবরাহ করলে মানুষ নেবে। আমরা সেটাই করছি। দেখা যাচ্ছে, তাতেও কাজ হচ্ছে না। আরো নতুন ও অভিনব চমকদার কোনো পদ্ধতি বাজারে চলে এসেছে। ফলে আইডিয়া ও বিষয়ের চেয়ে ভঙ্গি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যুগে মানুষকে একটু রংচংহীন, স্লো ও ডিটেইল কোনো জিনিস দিয়ে আকৃষ্ট করা খুব কঠিন। ফলে, বিনোদনের মধ্য দিয়ে জ্ঞান প্রচারের যে চর্চা ইন্টারনেট মাধ্যমে চলছে তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য। কেননা, একটু বেশি না জানলে আপনি বেশি জানা লোকটির চেয়ে পিছিয়ে পড়বেন। আপনার ও সেই লোকটি সারভাইভাল পাওয়ার যদি সমান সমান হয় তবে যে বেশি জানবে সে এগিয়ে যাবে। ফলে ডিটেইল জানাশোনা বা বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।
কিন্তু জানার বিষয়টি শুধু বইয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। আপনি নানা পদ্ধতিতে জানতে পারেন। একজন ব্যক্তি মিশর নিয়ে ১৮টি বই পড়তে পারেন, কিন্তু যিনি মিশর গিয়েছেন তিনি ১৮টি বই পড়া লোকটির চেয়ে মিশর সম্পর্কে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বেশি জানবেন, তাতে সন্দেহ নেই। আর বই পড়া লোকটি তথ্য বেশি জানবেন তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যদি বই পড়া ও ভ্রমণ দুটোই একসাথে হয় তবে সেটি নিঃসন্দেহে ভিন্ন রকম ফল দেবে।
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, জনসমাজের সাথে সম্পৃক্ততা ইত্যাদি শিক্ষার ভালো উপায়। ডিল করতে করতে শেখা শিখলে সেটি যেমন দ্রুত কার্যকর হয় তেমনিভাবে সেই বিষয়ে দক্ষতা আপনাআপনি অর্জিত হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পড়াশোনার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। যেমন ধরুন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি। আপনি বাংলাদেশের ইতিহাস সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর পড়ালেখা করলেন। নানা গবেষণা অভিজ্ঞতাও লাভ করলেন। কিন্তু বর্তমানে যা ঘটছে তা তো বইয়ে লেখা নেই। এ বিষয়ে আপনার মতামতটা বইয়ের লেখা থেকে আসবে না। আপনি বই পড়ে যদি সিদ্ধান্তে আসার মতো শিক্ষা ও মানসিকতা অর্জন করতে না পারেন তবে বর্তমান পরিস্থিতির সামনে আপনি অন্ধ ও বধিরের মতো আচরণ করবেন। আমাদের সমাজের অনেক বিদ্বান ব্যক্তিদেরই এখন তেমন আচরণ করতে দেখা যায়। তারা হয়তো অনেক বিদ্বান কিন্তু বিদ্যা তাদেরকে জ্ঞানী করে তোলেনি। জ্ঞানী করলেও পরিস্থিতি বিচার করার টুলগুলো তারা আয়ত্ত করতে পারেননি। অথবা সারভাইভালের প্রশ্নে তারা এমন কোনো জায়গায় ধরা খেয়ে আছেন যে সেখান থেকে কিছু বলা বা কিছু বিশ্লেষণ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। ফলে, আপনার জ্ঞান বিদ্যা এমন কি প্রজ্ঞারও কোনো দাম নেই যদি না আপনি আপনার সময়কে বিশ্লেষণ করতে পারছেন এবং আপনার কথাটি সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারছেন। এর বাইরে জ্ঞান শুধু বইয়ের পাতায়। আমরা দেখবো, আপনার জ্ঞান আমাদের কাজে লাগছে কিনা। আপনি মুখোমুখি দাঁড়াতে পারছেন কিনা। আপনি অনেক জ্ঞানী হলেন, প্রচুর পড়াশোনা করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে অত্যাচারীর পক্ষেই আপনাকে দাঁড়াতে হলো। এর মানে হলো, আপনার অবস্থান সমাজে একটা পাবলিক লাইব্রেরির চেয়ে আলাদা আর কিছুই নয়।
বুদ্ধিজীবী অবশ্যই বই পড়বেন। তারও চেয়ে বড় কাজ বর্তমান পরিস্থিতির নিরন্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রচার। আপনি যদি বলেন বুদ্ধিজীবীর কাজই বই পড়া তবে সেটা কোনো কাজের কথা নয়। বই বুদ্ধিজীবীর কাছে টুল। তার অভিজ্ঞতা, বোধবুদ্ধি, বিশ্লেষণ করার সহজাত ক্ষমতা, মানুষজনের সঙ্গে সংযোগ সবই তার টুল। বই না পড়ে যদি কেউ কাজটি করতে পারে তবে তাকে দুয়ো না দিয়ে বরং তাকে নিয়ে বই রচনা করা দরকার।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক