মৎস্যকথন

পর্ব ২

আশরাফ রোকন

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৩, ২০২০

হাওড়সংস্কৃতির একটা বড় অংশজুড়ে আছে জল ও জলার গল্প। বিচিত্র সব পললবাহিত নদনদী যেমন আছে, তেমনি আছে নানা ধরনের খালবিল, নালা, খালিজুলি, বাঁওড়, কুড় (বাঁওড়ের চেয়ে আকৃতিআয়তনে অনেকটাই ছোট আকারের গভীর জলাধার), নয়ানজুলি, আঁইড়া (গভীর জলাধারে আস্ত তালগাছ কেটে বানানো বেশ লম্বা পানিসেচের প্রাচীন জলসেচন যন্ত্র, কাঠ জোড়া দিয়েও তৈরি হতো), সেই কোন বাঁশের চিপাকাঠির (বাঁশ দিয়ে আড়াআড়ি মাটিতে পুঁতা বাঁশের খুঁটি) উপর কুড়া (লম্বা আস্ত বাঁশ, যা ভারসাম্য রক্ষাকারী) রেখে কুড়ার এক প্রান্ত ডাঙায় ও অপর প্রান্ত জলে থাকতো।

উপরে ডাঙার অংশে কুড়ার মাথায় চাপানো হতো কছা (খড়, ঘাসলতাপাতার সাথে কাদামাটি মেশানো বড়, ভারি কিছু), আর নিচে পানিতে পড়ে থাকা প্রান্তে পা দিয়ে চাপ দিয়ে পানি তোলার জন্যে কোনের মাথার বড় গোল অংশ লম্বা দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে বাঁধা হতো। হাত দিয়ে টেনে কুড়ার নিচের মাথার অংশ পা দিয়ে চেপে পানিতে ডুবিয়ে ছেড়ে দিলেই কুড়ার উপরের অংশ কছার ভারে উপরে উঠে গেলে কছাগাদ্দিতে (যে স্থানে কছা চাপ দিয়ে কুড়ার মাথা নামিয়ে দেয়) নিচের কোনের মাথার পানি গিয়ে উপরে পড়ে, উপরে খনন করা সেচের নালাগুলি দিয়ে যথারীতি জল চলে যায় ফসলের মাঠে।

সে-ই কোন`র মাথা ডুবানোর জায়গাটি (আঁইড়া) মোটামুটি গভীরই ছিল, যেখানে এসেও কিছু মাছ শীতের সময় হাওড় শুকিয়ে গেলে আশ্রয় নিতো। ছিল বিভিন্ন নামের বিচিত্র সব জলাশয়। যেমন, দাঁইড় (হোগলা, চিঁচড়া, এগড়া, নলখাগড়া, বিষকুমড়ি, বলুয়া, ছাইল্লা প্রভৃতি জলজ বিভিন্ন উদ্ভিজ্জলতায় ঠাসা লম্বাটে ঝিল আকৃতির খাস জলজ ভূমি, পূর্বের কোনো নদনদী বা খালের অপভ্রংশ, যাতে গ্রীষ্মের সময় ঊরু পর্যন্ত পানি থাকে), ডোয়ার (দাঁইড়ের কোনো কোনো অংশ চওড়া ও গভীর,পানির পরিমাণ দাঁইড়ের চেয়ে বেশি), ছইড়া (খাল বা নালা জাতীয়, জলপরিবহনের পথ), কারান (নদী থেকে হাওড়ে পানি নামিয়ে আনার খাল বিশেষ)।

আর এসব জলাশয়াদি ছিল মিঠা পানির মৎস্যের অকৃত্রিম উৎস। হাওড়ের বুক জুড়ে সর্বত্রই জালের মতোই বিস্তৃত ছিল এমনই অজস্র অসংখ্য জলাধার, যেগুলো জলের নিচে ঢাকা থাকে বর্ষার ছ`মাস আবার ছ`মাস থাকে শুকনায়। হাওড়ের জল শুকিয়ে সরে যাওয়ার সময় এ জলাধারগুলি অঢেল নরম পলল আর মৎস্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ঋতুভেদে তাই যেমন হাওড়ের রূপ বদলে যায়, ঠিক ঋতুবৈচিত্র্যের সাথে পাল্লা দিয়ে মৎস্য আহরণের বিচিত্র সব কৌশলও রপ্ত করতে পেরেছিল হাওড়াঞ্চলের অধিবাসীরা। খুব সম্ভব এ জল, জলাশয়ের আধিক্যকে কেন্দ্র করেই হাওড়াঞ্চলে কৈবর্ত, জেলে, নিকারি, মাইমল, বর্মণ ইত্যাদি ভূমিজ বিভিন্ন মৎস্যজীবী সম্প্রদায় ও গোষ্ঠির উদ্ভবেরর হেতু। যারা যুগ যুগ হাওড়ের প্রতিকূল প্রকৃতি-পরিবেশের সাথে কঠিন লড়াই করে টিকে আছে আজ অবধি।

জল ও জলের প্রেমে পড়ে তারা জালকে করেছে তাদের নিজস্ব হাতিয়ার, মৎস্যকে করেছে জীবনের উপাস্য। তাইতো যুগ যুগ ধরেই প্রচলিত এখানে সহস্র মৎস্যগাথা! মাছেভাতে বাঙালি প্রবাদটিও বোধ করি হাওড়বাংলার মানুষের শত সহস্র বছরের এমন মৎস্যকেন্দ্রিক জীবনধারা থেকেই উৎকলিত। চলবে

লেখক: কবি