মৎস্যকথন

শেষ পর্ব

আশরাফ রোকন

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৩, ২০২০

হাওড় জনপদের উত্তরাংশে গারোপাহাড় ও উত্তরপূর্বাংশে মেঘালয় পর্বতের অবস্থান। যে কারণে পাহাড়ি নদনদীগুলোর স্রোত সমতলে এসে হাওড়ের বুকে প্রবাহিত হয়েই সমুদ্রে গিয়ে মিলিত হওয়ার পথ খোঁজে। আর সর্পিল গতিতে চলার মুহূর্তে নদীগুলো তাদের নানান কীর্তি রেখে যায়। কিছু দূর যেতে না যেতেই পরিবর্তন আসে নদীর চলার পথে। কখনো তাই ইচ্ছেমতো চলার হেতু স্থানে স্থানে রেখে যায় নানা স্বাক্ষর। মাঝে মাঝে চলার গতির পরিবর্তনের কারণে বাঁকে বাঁকে মরানদী (নদীর সোঁতা, পুরাতন গতিপথ, আবদ্ধ-গভীর লম্বাটে জলাশয়), বাঁওড়-বিল-কুঁড়-খাল-নালা-দাঁইড়-ডোয়ার-ডোবা-খাদ-পাগার-ছইড়া-আঁইড়া (যেগুলো সম্পর্কে মৎস্যকথনের পূর্ববর্তী পর্বগুলোয় বলা আছে) ইত্যাদি বিভিন্ন গভীর-অগভীর জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে, যেগুলো মিঠা পানির বিরাট উৎস বলেই জেনেছি।

কেউ কেউ ভাটির অঞ্চলের এ হাওড়ভূমিকে অবশ্য মৎস্যভাণ্ডার বলেও অভিহিত করে থাকে। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে কালবোশেখির প্রভাবে অবিরাম তুমুল ঢল নামলে সে ঢলের পানি সোজা নদনদীগুলোতে জোয়ার আসতো, কানায় কানায় ভরে গিয়ে সে জোয়ারের জল উপচে পড়তো নদীপাড়ের সমতল অংশের ধান ফসলের জমিতে। আর সে জন্যে প্রায়শ অকালে পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফসলডুবির মতো সর্বনাশা কাণ্ডও হাওড়বাসী মানুষের জীবনে দুঃখ হয়ে দেখা দিয়েছে বহুবার। সে পাহাড়ি ঢলের পানিতে যখন পুরো হাওড়াঞ্চল সয়লাব হয়ে যেত, তখন তা সমুদ্রের রূপ নিতো। আর তখন নদনদীসহ বিল বাওড় দাঁইড়কুঁড় যাবতীয় সব জলাশয় যেত ডুবে। এরই ফলে এ সমস্ত জলাশয়ে আশ্রয় নেয়া মাছ, কাঁকড়া, সাপ, কচ্ছপ, কুইচ্চা, ব্যাঙ ইত্যাদি যত জলজ প্রাণীরা জলের সাথে সাথেই ছড়িয়ে পড়তো সর্বত্র।

জলে জলাকার হয়ে ওঠতো সমস্ত এলাকা। নদনদী, খালবিলনালাডোবার কোনো চিহ্ন থাকতো না। জলমগ্ন, জলময় হয়ে ওঠতো গোটা ভাটির প্রকৃতি। নতুন নৌকো নামতো জলে। বাহারি নামের সব নৌকো! পাতাম, পানসি, সরঙ্গা, গয়না, ভাওল্লিয়া, ভাগলপুইরা, বাজিতপুইরা, কেরায়া, কোন্দা, ডিঙি, ডিঙ্গা, বেপারী নাও। যত পরিমাণ জল, তত পরিমাণ নাও। নানান রঙের পাল উড়িয়ে যাওয়া শৈশবের নৌকোগুলির সাথে তুলনা দেয়ার মতো জাহাজ মিলবে না কোনোদিনও জানি! নতুন জলের নতুন আনন্দে দিশেহারা হতো হাওড়জলের বিচিত্র ধরনের ছোটবড় সকল মৎস্যদল অবারিত ঘুরে বেড়ানোর জন্যে পেত এক নিবিড় মুক্ত জলাঞ্চল। কিন্তু জলের মাছেদের এ-হেন আনন্দের বাগড়া হয়ে দাঁড়াতো স্থলের মানুষেরা; হাজার বছর ধরে যাদের রক্তে বইছে মৎস্যশিকারির রক্ত। বোশেখের ধানে গোলা ভরে তোলার পর যখন হাওড় জলে ডুবে গিয়ে সমুদ্র হয়ে যেত, তখন তাদের বর্ষার ছ`মাস বসেশুয়ে কাটানো ছাড়া কোনো গতি থাকতো না।

হয়তো সে অলস-সময় যাপনের মাধ্যম হিসেবে পালা, জারি, সারি, মুর্শিদি, ঘেটু, মারফতি, বাউল, কিচ্ছা,কাহিনিকাব্য পুঁথি, নৌকোবাইচ, মৎস্যশিকার, পাখিশিকার প্রভৃতি কার্যের সাথে নিজেদের ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। যা যুগ যুগ ধরে চর্চার ফলে হাওড়পাড়ের সংস্কৃতির অনন্য সব উপাদানে রূপ পেয়েছে। সাধারণত জ্যৈষ্ঠমাসের শুরুতে ঘাটে নতুন পানি আসার সাথেই শুরু হয়ে যেত হাওড়ে মাছ ধরার মওসুম। ঠেলাজালি নিয়ে সকালসন্ধ্যায় রাখালদের হল্লা। ডাক বেঁধে (একদল রাখাল দু`ভাগ হয়ে দু`টি পৃথক দল তৈরি করে পরস্পর বিপরীত মুখ থেকে ঠেলে নিজেদের জাল `ঠেলাজালি `পানির নিচে টক্কর (ধাক্কা) লাগলে জালে ওঠে আসতো কৈ, শোল, লাইট্টা (গোয়াড়িয়া, উগোল) মাছের উকরি (ছোট্ট পোনা মাছ) ছাড়াও অন্য ছোট ছোট মাছ যেমন: চেলা, ঢেলা, মোলা, চান্দা, বইচা, বাইলা, বাচা, হিলুং, গিলাচাকী, টেংরা, খইলসা, গুলশা, রাণী কত প্রজাতির দেশি মাছে চুক্রা (মাছ রাখার জন্যে বাঁশ দিয়ে তৈরি তৈজস) ভরে নিয়ে ফিরে আসতো।

এ সময়টাতে প্রচুর বৃষ্টি হতো। বাড়ির পাশের খালপাড় বেয়ে নামা জলের চিকন স্রোতে উজাতো কৈ মাছ, কানতাতে কানতাতে উপরে ডাঙ্গায় উঠে পড়তো এসে। ডাঙায় ফেলে কৈ মাছ ধরার স্মৃতি অমলিন। এছাড়া বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়া ডোবা, নালা সিঁচে মাছ ধরারও হিড়িক পড়ে। পাতা হতো বাঁইড়, বাঁশের তৈরি মাছধরা ফাঁদ, একবার ঢুকলে সে মাছ আর বেরর হবার জো থাকতো না। পাড়ার ছেলেরা দলবেঁধে এমন মাছধরা কাজের মজা লুটতাম। বিকেলের দিকে দেখতাম আব্বা ও আরও পাড়ার জনাচারেক সৌখিন শিকারি বেরিয়ে যেতেন যাদের প্রত্যেকের মাথায় জঙ্গুড় (ডেফল পাতা/পলিথিন দিয়ে ছাওয়া বাঁশের নকশাদার চাটাই দিয়ে তৈরি এক ধরনের বর্ষাতি) দিয়ে। এক হাতে তিন ব্যাটারি এভারেডি টর্চলাইট, আরেক হাতে কোঁচ। ঘাটের নৌকো নিয়ে তারা চলে যেতেন বাড়ির ঘাট থেকে বেশ কিছুটা দূরে মাঝ হাওড়ের দিকে। কোনো কান্দা বা ট্যাকে (উঁচু জায়গায়), যেখানটা তখনো তলিয়ে যায়নি, সেখানে নিজেদের নৌকো ভিড়িয়ে দিয়ে আশপাশের নালাজলার পাহাড় থেকে নেমে আসা ঘোলাজলে টর্চ জ্বেলে ডিম পাড়তে নিরিবিলিতে আসা মাছগুলির গতিবিধি ঠাহর রেখে সে-মতো ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো করেই ডানহাতের কোঁচের ঘা`য়ে আহত করে বড় বোয়াল, পাঙ্গাস, রুই শিকার করে যখন বাড়ি ফিরতো।

এটা হাওড়াঞ্চলে `উইজ্জা` নামে পরিচিত। নদনদী থেকে, বিলবাঁওড় ইত্যাদি থেকে বর্ষার জল বাড়ার সাথে সাথে মাছেরাও তাদের নিজ নিজ আবাস ছেড়ে উজিয়ে এসে কতক হাওড়কিনারার দিকে ভিড় জমাতো। অধিকাংশ ডিমপড়া মাছেরাই পুরুষ মাছের পাহারায় ডিম ছাড়ার জন্যে নিরিবিলি পরিবেশের খোঁজে নলখাগড়া চিঁচড়া ঘাসলতা পরিবেষ্টিত ট্যাক বা কান্দা বা গোপাটের কাছাকাছি চলে আসতো। মাছেদের এভাবে চলে এসে থাকার অবস্থাকে মৎস্যশিকারিদের কেউ কেউ বীড় ধরা, কেউ আবার মীড় ধরা, উইজ্জা মারা ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকত। উইজ্জা শিকারিদের প্রখর দৃষ্টির বদান্যতা শোনা যায় এখনো গাঁয়ে। আর উইজ্জামারা ভালো নয় বলে কোনো কোনো মুরুব্বিদের বলতে শুনতাম। অনেকট মনে হয় ডিমওয়ালা মাছেদের প্রতি মানুষের হৃদয়ে এক ধরনের যন্ত্রণা হতো, আর সে যন্ত্র্রণা মাতৃত্বের, পিতৃত্বের যন্ত্রণা, যা মানুষেরর বিবেকে আঘাত হানতো বলেই এমন বলতো। সব মানুষ সমান হয় না বলেই হয়তো হাওড়পাড়ের কেউ কেউ মৎস্যশিকারি হয়েছে।

পুরো রাতই কাবার করে ভোরের দিকে ফিরতেন আব্বা। কোনো কোনো সকালে হয়তো ঘুম ভাঙতো দাদির ডাকে, `মাছ দেখ, মাছ দেখ` বলে যখন জোরে জোরে ডেকে তুলতেন। বড় বড় মাছ দেখলে যে আমার আনন্দ বেড়ে দ্বিগুণ হতো, দাদি মনে হয় তা ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন; এছাড়া আমার আনন্দ দেখে যে দাদি আরও উল্লাসের `ফুটকা `(বেলুন) হয়ে যেতেন, সে কথাও মনে পড়ে আজ। দেখতাম ইয়া বড় বোয়াল মাছ, দাদার সমান বড়, তিরিশ-চল্লিশ সের ওজনের মাছ দেখে সে-ই ছোট বয়সে যে মৎস্যপ্রীতি গড়ে ওঠেছিলো আমার, সে প্রণয়ই বোধ করি এখনো তাড়িত করে, স্মৃতিচ্ছন্ন করে তখন, যখন দেশি মাছের বদলে ভিন দেশি মাছের থলে আমারই হাতে, দেখি নদনদী, খালবিলনালাবাঁওড় সবই তাদের বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। দুপুর গড়ালেই মধ্যহাওড়ে পাতা হতো ফুটবাইন (বড় মাছ ধরার জন্যে বড় হাওয়ার জাল, মাঝারি মাছের জন্যে ছোট হাওয়ার জাল; এখানে `হাওয়া` মানে জালের ঘর, খোপ— যার মধ্যে গলামাথা আটকে মাছেরা ধৃত হয়) পাতা হতো।

দু`পাশে দুইটা চিকন বাঁশের লগি বা খুঁটির সঙ্গে জালের `বঁর`র (উপরের শক্ত দড়ির পাড়) দুইপাশ বেঁধে জলের নিচে জাল ডুবিয়ে মাটিতে খুঁটি দুটি জালের দৈর্ঘ্যের সমান দূরত্বে বেশ কিছুটা পুঁতে দিয়ে, জালের বঁর`র দড়ির সঙ্গে মাঝে মাঝেই `হরঙ্গা` (কচুপানার পাতা ফেলে দিয়ে শুধু ডাঁটা বা শোলা/ধঞ্চে দিয়ে তৈরি কাঠি বিশেষ, যা বর্তমান জামানায় প্লাস্টিকের বল ডিব্বা/কৌটো সাইজের ভাসমান কিছু পদার্থ দিয়েই তৈরি, যা জালের ভারসাম্য রক্ষা করে মূলত জালকে লেপ্টে পড়ে মাটিতে মিশে যায় না, জালকে উপরের দিকে টান টান রাখে) দেয়া হতো। ছোট কাক্কুর ফুটবাইন বাওয়ার যক্ষ ছিলেন। এসব ফুটবাইন জালে ধরা পপড়তো রুই, কাতলা, মৃগেল, কাল বাউশ, আইড়, পাঙ্গাস, উগলী, বাচা, বড় বাইম, বোয়াল, সরপুঁটি, গইন্না, বড় পাবদা ইত্যাদি নানান প্রজাতির দেশি বড় মাছ, মাঝারি আকারের মাছ। আমার মনে হয় স্বাদে, গন্ধে এসব মৎস্য পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলের মৎস্যের চেয়ে আলাদা মাত্রার। সর্বতো খাদ্যগুণের অধিকারী। এছাড়া একেকজন মৎস্যপ্রেমীর ছিলো একেক কায়দায় মাছ শিকারের ঘরানা। একেকজন একেক কায়দাকৌশলে মাছ ধরার ফায়দা নিত।

কেউ কেউ আবার বেশ কয়েকটা কায়দাপদ্ধতিই রপ্ত করতে পারতেন। গাঁওগেরামে কেউ কেউ পাকা শিকারি, ঝানু শিকারি বলে পরিচিতি পেতেও দেখেছি। বর্ষার হাওড়ে সারাদিন ধরেই কোনো না কোনো কৌশলে মাছ ধরা পড়তোই। একদল যখন লার পাততো, অন্য আরেক দল নামতো জড়া টানতে, একদল লোক সারাদিনই ঠেলাজালি ঠেলে ঠেলে ধরতো চিংড়ি। একদিকে হয়তো খনাজাল নিয়ে নামছে একদল, আরেক দিক দিয়ে হয়তো হুঁহা (চাপিলা) মাছের জাল ফেলেছে রানাহিজল কিংবা লক্ষণপুরের জেলেরা; ছোট্ট কোন্দা নৌকোয় ছোটো ছোটো বৈঠা হাতে সাহসী জেলেরা মাঝহাওড়ে তাড়িয়ে নিয়ে চাপিলা মাছেদের ঝাঁককে জালের সীমার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, ছোটো ছোটো অনেকগুলি ছোটো দাঁড় ও বৈঠাবাওয়া নাওয়ের জেলেমাঝিরা উলুধ্বনি দিচ্ছে, হৈ হুল্লোড় করছে কখনো কাঁসর, কখনো নৌকোয় হাতের দাঁড়বৈঠা দিয়ে আঘাত করে আরও আরও উচ্চশব্দের সৃষ্টি করতে চাইছে, যাতে চেঁচামেচি, হৈহুল্লোড়ের শব্দ হাওড়ভরা জলের বুকে আছড়ে পড়ে প্রতিধ্বনিত হলে তা আরও উঁচু উঁচু শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি করতো। সোরগোল তৈরি হতো।

চাপিলা মাছের ঝাঁক ভয়ে আতংকে দিশেহারা হয়ে অনায়াসে পথ হারিয়ে ধরা পড়তো গিয়ে পাতা জালে। হাওড়পাড়ে অপেক্ষাকৃত কম গভীর অংশে কিনারার দিকে সাধারণত চতুর্দিক হতে ভেসে আসা কচুরিরা ভিড় করতো। সেখানে কচুরিধামের মাঝে মাঝে একটু ফাঁকা করে পাতা হতো চুঙ্গি বড়শি। ধরা পড়তো কৈ, শিং, মাগুর, লাইট্টা মাছ। লার, জড়া টানা, খনা জালে ধরা পড়তো ছোট বাইম, পুঁটি, তিত্ পুঁটি, চান্দা, টেংরা, বড় মাছের পোনা, রাণীমাছ, বাঁশপাতা মাছ, চেলাঢেলামোলা, বৈচা, চিংড়িসহ আরও নাম ভুলে যাওয়া অগণন প্রজিতির দেশি, স্বাদু মাছ। জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্রের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাছ ধরার এরূপ কৌশল বলা যায় অব্যাহত থাকতো। তখন পানি কমে এলে ভাদ্রের হাওড়কিনারে বাওয়া ধানের (আমন ধানগাছ বিশেষ, জলের সঙ্গে বেয়ে বেয়ে জলের উপরে উঠে মাথা করে বাঁচে এবং জলের উঠানামার সাথে সাথে উঠেনামে) ক্ষেতে বিকেলের মৃদুরোদে অবসর কাটানোর ছলে বিলাসী কিছু মাছেরা দলবলহীন, উদাসি বেরিয়ে পরে ধানগাছে জমা শেওলাকেওড় ঠুকরে ঠুকরে খাওয়ার সময় শিকারিরা তাদের তীক্ষ্ম জহুরি দৃষ্টি দিয়ে সে সব বিলাসি মাছেদের মনোভাব লক্ষ্য করে কোঁচ বা জুইত্তা ছুঁড়ে দিয়ে বিদ্ধ করে আহত করে শিকার করার এ পদ্ধতি বা প্রক্রিয়াটিকে হাওড়ের গ্রামাঞ্চলে `কাজা মারা বা ধরা বলে।

ঢেউবাতাসহীন নীরব নিস্তব্ধ বিকেলের পরিবেশের সাথে মিল রেখে এ উপায়ে মাছ শিকারের সময়টাকে `নিরাগ মারা` বলতেও শুনতাম। অনেকটা তাল নিরাগের সাথে তাল রেখেই ধানগাছের ফাঁকে ফাঁকে ঢিমে তালে চালানো নাওয়ের গলুইয়ে বসে নিশানা করতেন শিকারিজন, নাও চালাতেন ধীরে, অতি সাবধানে একজন সারেং। শিকারি নাওয়ের মাঝি সবাই হতে পারতো না। শিকারিরা সে সময় তার পছন্দের মাঝিকেই সঙ্গে লইতেন। দক্ষ সারেং আর পাকা, ঝানু সৌখিন শিকারিরাই সাধারণত এ ধরনের শিকারকার্যে অংশ নিত। সেক্ষেত্রে তাদের প্রস্তুতি প্রায় উইজ্জাওয়ালাদের মতোই। তবে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যেত `নিরাগ ধরা`। ধরা পড়তো কাইলারা, রুইয়ের বাড়া, চিতল— নানান মাছ। ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি প্রায় জেগে ওঠা বিলবাঁওড়ে পাতা হতো কৈ জাল। বাঁশের তৈরি বিশেষ বড়শিতে ঘাসফড়িং, তেলাপোকার টোপ লাগিয়ে বিলবাঁওড়ের শালুকপদ্মশাপলা ভিড়ের ফাঁকে ফাঁকে পাতা হতো চুঙ্গি। ধরা পড়তো দেশি বড় বড় কৈ মাছ। রাতবিরেতেও কখনো কখনো চলতো জাল পেতে, বড়শি ফেলে মাছ ধরা। একদল লোক বেরিয়ে পড়তো হাত বড়শি
নিয়ে। হাতে ছিপ রেখে দুতিনটা বড়শি-ছিপ চালাতেও অনেকের জুড়ি নেই।

সাধারণত ভাদ্রের মাঝামাঝি থেকেই হাওড়ের পানি নামা শুরু হতো। চৌবাচ্চার ন্যায় তিতিয়ে সব পানি যখন নিচে ধাবিত হয়ে পানির রঙ যেতো বদলে কেলাসিত দ্রবণের ন্যায় স্বচ্ছ, ঝকঝকে হয়ে যেত হাওড়ের অবস্থা। তলা পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠতো ভাদ্রচাঁদের আলোয় মাছ শিকারে বেরর হতো একদল। মাছের চলাচল, গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্যে বড় হ্যাজাক লাইট জ্বেলে নৌকোয় করে মাছ শিকার করার পদ্ধতিটিও বেশ বুদ্ধিবৃত্তিক। জলের উপর হ্যাজাকের আলোকরশ্মি পড়ে তা জলের গভীরে থাকা পলকবিহীন মাছের চোখে লাগলে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ধাঁধিয়ে তোলে মাছেদের দৃষ্টিশক্তিকে, মাছেরা মনে হয় হতভম্ব ছুটে পালাবার পথ খুঁজেই পায় না। অপর দিকে শিকারির তীক্ষ্ম দৃষ্টি পড়তে দেরি লাগে না। দ্রুতই কোঁচের ফলায় গেঁথে নিতে ভুল করেন না দক্ষযজ্ঞ
শিকারিরা। এ ব্যবস্থায় চার-পাঁচজনের একটা দলের মাছ শিকারের কৌশলটা গ্রামে `আল্লরা দেয়া` নামে পরিচিত। হ্যাজাক লাইট ছাড়াও আল্লরা দেয়া যায়, সেক্ষেত্রে হারিকেন, টর্চলাইট, বড় কেরোসিন বাতি, পাটখড়ি দিয়ে তৈরি বোম (আঁটি) জ্বেলে ব্যবহার করতে হয়।

লেখক: কবি