‘যুবসমাজ মূর্খ, তাই কোকাকোলার এ বিজ্ঞাপন’

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জুন ১১, ২০২৪

মুসলিম অধ্যুষিত গাজা উপত্যকায় চলছে ইহুদিবাদী ইজরায়েলি আগ্রাসন। এ ইস্যুতে ব্যবসায়িক সংকটে পড়েছে জনপ্রিয় কোমল পানীয় ব্র্যান্ড কোকাকোলা। ইজরায়েলকে সমর্থনের অভিযোগে মুসলিম দেশগুলোর নাগরিকেরা এরই কোকাকোলা বয়কট করেছে। মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকররাও সবসময় সোচ্চার ইজরায়েলি হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে। এ ধাক্কায় এ দেশেও কমেছে কোকোকোলার বিক্রি।

এ সংকট কাটাতে এবং নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে সম্প্রতি একটি বিজ্ঞাপন বানিয়েছে কোকাকোলা বাংলাদেশ। এ বিজ্ঞাপন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠেছে সমালোচনার ঝড়। বিজ্ঞাপন নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া হচ্ছে বয়কটের হুমকি। এ অবস্থায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিবৃতি দিচ্ছেন কলাকুশলীরা। কিন্তু কথা উঠেছে, বিজ্ঞাপনের আগে কেন তাদের বোধোদয় হলো না।, যখনই গণমানুষের চাপে পড়েছেন, তখনই তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে শুরু করলো।

কোকাকোলার বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কোককে সবাই যে দেশের পণ্য মনে করছে, আসলে সেই দেশের পণ্য নয় কোকাকোলা। মানুষ সঠিক তথ্য না জেনেই কোকাকোলা বয়কটের ডাক দিয়েছে। ১৯০টি দেশের মানুষ কোক খায়। এমনকি ফিলিস্তিনে কোকাকোলার ফ্যাক্টরি রয়েছে। তাই বিভ্রান্ত না হয়ে গুগলে সার্চ দিয়ে নিশ্চিত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে বিজ্ঞাপনটিতে।

কিন্তু অন্তর্জাল ব্যবহারকারীরা বলছে, ফিলিস্তিনে কোকাকোলার কারখানা আছে ঠিকই, তবে সেই ভূখণ্ড এখন ইজরায়েলের দখলে। বাংলাদেশের মানুষ যেকোনো ইস্যুতে শান্তির পক্ষে। গাজায় নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করছে ইজরায়েল। জাতিসংঘের নিষেধও তারা তোয়াক্কা করছে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ইজরায়েলি গণহত্যার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এদিকে কোকাকোলার বিরুদ্ধে রয়েছে ইজরায়েলের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ।

এ অবস্থায় নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়ে তৈরি করা কোকাকোলা বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনটি বুমেরাংয়ের মতো কাজ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কোকাকোলা বয়কটের ডাকের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞাপনটির কলাকুশলীদের বয়কট করার আহ্বান। নেটিজেনরা ভাবছে, কোকাকোলা তাদের ইমোশন নিয়ে খেলছে। কারো অভিযোগ, দেশের যুবসমাজকে অশিক্ষিত ও মূর্খ ভাবার ফলেই এরকম বিজ্ঞাপন বানিয়েছে কোকাকোলা বাংলাদেশ।

এই বিজ্ঞাপনটিতে মডেল হিসেবে ছিলেন অভিনেতা-নির্মাতা শরাফ আহমেদ জীবন, শিমুল শর্মা, আব্দুল্লাহ আল সেন্টু প্রমুখ। তুমুল বিতর্কের মুখে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছেন নির্মাতা-অভিনেতা শরাফ আহমেদ জীবন ও অভিনেতা শিমুল শর্মা। সোমবার ফেসবুক পোস্টে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন জীবন। পাশাপাশি জানিয়েছেন, কাজটি তার পেশাগত জীবনের একটি অংশমাত্র। তিনি সব সময় ন্যায়ের পক্ষে এবং মানবতার পাশে আছেন।

ফেসবুকে জীবন লিখেছেন, “আমি একজন নির্মাতা ও অভিনেতা হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। দুই দশক ধরে আমি নির্মাণ ও অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি কোকাকোলা বাংলাদেশ আমাকে তাদের একটি বিজ্ঞাপন নির্মাণ ও অভিনয় করার জন্য নিয়োগ করেছিল। আমি শুধু তাদের দেওয়া তথ্য ও উপাত্তই কাজটিতে তুলে ধরেছি। বিজ্ঞাপনটি প্রচার হওয়ার পর থেকে আমি আপনাদের অনেক মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছি এবং আপনাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি আবারও বলতে চাই, কাজটি শুধুই আমার পেশাগত জীবনের একটি অংশমাত্র।”

সবশেষ তিনি লিখেছেন, “ব্যক্তিগত জীবনে আমি সব সময় মানবাধিকারবিরোধী যেকোনো আগ্রাসনের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছি এবং আপনাদের অনুভূতি ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছি। এখানে আমি কোথাও ইজরায়েলের পক্ষ নিইনি এবং আমি কখনোই ইজরায়েলের পক্ষে নই। আমার হৃদয় সব সময় ন্যায়ের পক্ষে এবং মানবতার পাশে আছে, থাকবে।”

তার এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অনেকেই বলছে, পেশাগত কাজের অংশ হিসেবে কেউ যদি তাকে রাস্তার মাঝখানে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে তাহলে কি তিনি তা করবেন? পেশা সব মানুষেরই আছে। সেই পেশায় নৈতিকতার দিকটি যদি স্পষ্ট না হয়, তাহলে মানুষ হিসেবেও সে যথেষ্ট পরিপক্ব নয় বলেই মতামত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। কোকোকোলা কোম্পানি জীবনকে যা শিখিয়ে দিল পেশাগত কারণে জীবন তা-ই ক্যামেরার সামনে বলে গেল কিছু না উপলব্ধি করেই, এটা তার উপলব্ধি-বোধেরই অভাব।

অভিনেতা শিমুল শর্মা ফেসবুকে লিখেছেন, “যদিও পরিচয় দেওয়ার মতো একজন অভিনেতা এখনো হয়ে উঠতে পারিনি, কারণ একজন অভিনেতা হওয়ার জন্য যে অধ্যবসায় ও দূরদর্শিতা দরকার, সেটা এখনো আমার হয়ে ওঠেনি, আমি চেষ্টা করছি মাত্র। তাই হয়তো না বুঝে করা আমার কাজ আজ আমার দর্শক তথা আমার পরিবার ও দেশের মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। আর আমি ভবিষ্যতে কোনো কাজে অভিনয় করতে গেলে অবশ্যই আমাদের দেশের মূল্যবোধ, মানবাধিকার, মানুষের মনোভাবকে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে বিবেচনা করে তারপর কাজ করব।”

তিনি আরও লেখেন, “আমি মাত্র আমার জীবনের পথচলা শুরু করেছি। আমার এই পথচলায় ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আমাকে ভবিষ্যতে একজন বিবেকবান শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য শুভকামনায় রাখবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।”

এই বিজ্ঞাপনে কাজ করা নিয়ে কোনো অনুশোচনা হচ্ছে কিনা, এরকম প্রশ্নের জবাবে একটি জাতীয় দৈনিককে শিমুল বলেন, “আমি যেহেতু কাজ করেছি, তার মানে জেনেশুনেই কাজ করেছি। আমি পণ্যটাকে প্রাধান্য দিয়েছি। আমরা কিন্তু কোনো গালি দিই নাই, উদ্ভট কোনো কাপড় পরি নাই, এমন কোনো প্রোডাক্টের কথা বলি নাই, যেটা সরাসরি ধর্মকে আঘাত করে। মানুষের সেন্টিমেন্ট তো আর পড়তে পারি না। তারা বিজ্ঞাপনটি কীভাবে নেবে, সেটা জানা ছিল না। আমি জানতাম না ধর্মপ্রাণ মানুষ বিষয়টি এমনভাবে নেবে, তাদের মনে আঘাত লাগবে। জানলে হয়তো আরও ভাবনার জায়গা থাকত।”

তিনি আরও বলেন, “তবে আমি জানি, অভিনেতা হিসেবে আমাদের কিছু দায়িত্ব আছে। ভালো-মন্দ যাচাই করে আমাদের কাজ করা উচিত। সেই জায়গা থেকে আমারও দায় আছে, সেটা অস্বীকার করব না।”

সমালোচনা থেকে বাদ যাননি নির্মাতা কাজল আরেফিন অমি। বিজ্ঞাপনটিতে জীবন ও শিমুল শর্মাকে দেখে অনেক নেটিজেন মনে করছে, এটি পরিচালনা করেছেন কাজল আরেফিন অমি। কারণ এই নির্মাতার বেশিরভাগ নির্মাণে এই অভিনয়শিল্পীদের দেখা যায়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ফেসবুকে নিজে থেকেই অবস্থান পরিষ্কার করেছেন অমি। তিনি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “আমি কখনো বিজ্ঞাপন বানাই নাই। আমি নাটক, ওয়েব ফিল্ম, ওয়েব সিরিজ নিয়েই কাজ করেছি, ভবিষ্যতে সিনেমা বানাব।”

সমালোচনার ঝড় সামলাতে না পেরে এরই মধ্যে বিজ্ঞাপনটি কোকাকোলা বাংলাদেশ তাদের ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরিয়ে নিয়েছে। আজ মঙ্গলবার (১১ জুন) দুপুরের পর থেকে এটি আর দেখা যাচ্ছে না। তবে এ বিষয়ে কোকাকোলা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো পাওয়া যায়নি।

মালয়েশিয়ায় বসবাসরত তথাকথিত বাংলাদেশি ইসলামি আলোচক মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী আজ মঙ্গলবার নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে লিখেছেন, “কোরবানির আগে আগে ওদের বিজ্ঞাপনটা অনেকটা পাগলের সাঁকো নাড়ানোর অনুরোধের মতোই হয়েছে। পন্য বয়কটের মুভমেন্ট খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল। এবার নতুন করে আবার চাঙা হবে।”

তিনি আরও বলেন, “যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিন। যার যতটুকু সম্ভব ইসলাম বিদ্বেষী ও জালিমদের পন্য কেনা থেকে দূরে থাকুন। মালয়েশিয়াতে ম্যাকডোনাল্ড ও স্টারবাকস অনেকটা আইসিউতে।”

ইসলামি আলোচক শায়েখ আহমাদুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে লিখেছেন, “আপনার ঈদ হোক চিহ্নিত ইসলামবিদ্বেষীদের পণ্যমুক্ত। সাধারণ মানুষের বর্জন যে কত শক্তিশালী হাতিয়ার, তা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ঈমানের দাবিতে এই শক্তিশালী হাতিয়ারকে সঠিক জায়গায় ব্যবহার করুন। আমাদের বর্জন হোক মজলুমের প্রতি ভালোবাসা নিবেদনের জন্য।”