রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ২৮

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ০২, ২০১৯

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চাকরি করার সময় খবর পেলাম, একটা গ্রামে পুঁথিপাঠের আসর বসে। গ্রামের নাম নাচাই কোচাই। আসর বসে মঙ্গলবার হাট ভাঙার পরে। গেলাম পুঁথি শুনতে। ছোট্ট বাজার। একটা পাকুড় গাছের নিচে গোল করে বাঁধানো বাঁশের বেঞ্চি। পল্লী বিদ্যুৎ আছে বটে। তবে সেখানে নাকি বিদ্যুৎ থাকে সারাদিনে ঘণ্টাতিনেক। তাই মানুষরা কুপি-হ্যারিকেন-মোমবাতির অভ্যেস ত্যাগ করে উঠতে পারেনি। সেই সন্ধ্যাতেও বিদ্যুৎ ছিল না। কুপি আর মোমবাতির ব্যবস্থা ছিল। বেঞ্চির ওপরে কুপি জ্বলছে, তার পাশে পুঁথি। পুঁথিপাঠক বেঞ্চিতে নয়, বসে আছেন নিচে মাটিতে একটা মাদুর পেতে। পড়ছেন তিনি সুর করে। সেই সন্ধ্যায় পড়া হচ্ছিল জঙ্গে খায়বর। জনা ত্রিশেক লোক তাকে ঘিরে বসে এবং দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে আহা আহা করে ওঠা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ বাতাসে একটু একটু কেঁপে উঠছে কুপির আলো। তাতে পাঠকের কণ্ঠে ছেদ পড়ার কোনো লক্ষণ নেই। সম্ভবত পুঁথি তার মুখস্ত। কেবল সম্মান জানাতেই সামনে খুলে রাখা আর পৃষ্ঠা ওল্টানো।

আমার মটরসাইকেলের শব্দে তারা একটু ঘুরে তাকালেন। নতুন মানুষকে সবাই ভালো করে দেখতে চায়। তাই ক্ষণিকের বিরতি। আমি সালাম জানিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। জানালাম পুঁথি শুনতে এসেছি। কয়েকজন আসেন আসেন বসেন বলে সাদর আহ্বান জানালেন। আমিও বসে পড়লাম বেঞ্চির একটা পাশে। এরপর প্রায় প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেই যেতাম। আকবর প্রধান, মোতালেব মিয়া, আক্কাস খাঁর কণ্ঠে পুঁথি শুনতাম খুব মুগ্ধতা নিয়ে। ফিরতে ফিরতে রাত দশটা-এগারোটা বেজে যায়। কয়েকজন জানালেন রাস্তায় ডাকাতের উপদ্রব আছে। তাদের কবলে পড়তে পারি। হেসে বললাম, পড়লে আর কী করব! পুঁথি শোনা তো বন্ধ করা যাবে না।

পরদিন সকালে একজন লোক এলেন দেখা করতে। আমি আবছা চিনতে পারলাম। পুঁথির আসরে দেখেছি। কথা বলেন না তেমন। পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পুঁথি শোনেন, আবার কিছুক্ষণের জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসেন। গ্রামের সাধারণ গরিব লোকদের মতোই অপুষ্টিআক্রান্ত এবং বাস্তবের আগুনে পোড়া পোড়া চেহারা। আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। তবে তেমন আলাপি মানুষ না। মাঝে মাঝে আমি বাজারের একমাত্র খুলে রাখা চায়ের দোকানে সবার জন্য চায়ের অর্ডার দিই। অন্যেরাও আমাকে চা খাওয়ান। সেই সময় বেশ গল্পগাছা হয়। কিন্তু এই লোককে কখনো চায়ের আসরে যোগ দিতে দেখিনি। তাকে দেখে জানতে চাইলাম, কী ব্যাপার ভাই কোনো অসুখ-বিসুখ?

উনি মাথা নাড়লেন। জানালেন তার নাম ভূগোল মিয়া। তিনি আমাকে একটা কথা জানাতে এসেছেন। জানতে চাইলাম তার কথা। তিনি একটু ইতস্তত করে বললেন, আপনে তো হামাগের নিজের মানুষ বাহে। তাই বলবার আইলাম যে ডাকাতের ভয় পাওয়ার কুনো দরকার আপনের নাই। আপনে যতরাত খুশি যেইখানে খুশি যাবেন-আসপেন। কেউ আপনের চুলের গোছাও ছুঁবি না বাহে। জিগ্যেস করতে যাচ্ছিলাম তিনি এত নিশ্চয়তা দিচ্ছেন কীভাবে। কিন্তু আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নিষেধ করল। যা বোঝার আমি বুঝে নিয়েছি। আর তিনিও ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নিজের মানুষ আমাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। বছরখানেক পরে খবর শুনেছিলাম ভূগোল মিয়া পুলিশের হাতে অ্যারেস্ট হয়েছেন।

সেই পুঁথিপাঠের আসরে কয়েকজন আমাকে ধরে বসলেন, আমরা সগলে বুঝ্যা গেছি আপনেও এই রসেরই মানুষ বাহে। আপনে লিচ্চয় পুঁথিপাঠ জানেন। আমরা আপনের পুঁথি শুনবার চাই। আমি নিজের অপারগতা জানাতে গিয়েও থেমে গেলাম। মনে তখন অন্য একটা এক্সপেরিমেন্টের ইচ্ছা এবং কৌতূহল জেগে উঠেছে। বললাম, আমার কাছে যে পুঁথি আছে তা পদ্যে নয়, গদ্যে লেখা। লোকে তাকে নভেল বলে। আপনারা চাইলে আমি কিছুটা করে পড়ে শুনাতে পারি। বলছিলাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’র কথা। তারা একটু অস্বস্তির সাথে হলেও শুনতে রাজি হলেন।

পরের মঙ্গলবার আমি ‘খোয়াবনামা’ নিয়ে হাজির। আগে চলল যথারীতি মজ্জেম শাহের পুঁথিপাঠ। তারপরে আমি পড়তে শুরু করলাম ‘খোয়াবনামা’। কিন্তু বেশিদূর এগুল না। ফকির মজনু শাহ, গোরা সেপাই আর কণ্ঠনালীতে গুলি খাওয়া মুনসী বয়তুল্লা শাহ-র কথা পর্যন্ত পড়তেই সমবেতকণ্ঠ বলে উঠল, ঠিক ঠিক। হামরা তো শুনিছি মজনু ফকিরের যুদ্ধের কথা।

আমি পড়া থামিয়ে শুনতে থাকি কে কী শুনেছেন সেই কথাগুলো। একজন বলেন, অরা তো খালি গুলি করে নাই বাহে। ফকিরগো ধর্যা ধর্যাল গাছের সাথে ফাঁসিও দিছিল। যেসব গাঁয়ে সেই ফাঁসি দিছিল সেইসব গাঁয়ের নামই তো পরে হইছে ফাঁসিতলা। আমি বলি, ফাঁসিতলা নামে একটা গ্রাম আমি চিনি। কিন্তু কয়টা ফাঁসিতলা আছে?

এই যে ধরেন গোবিন্দগঞ্জের দক্ষিণে পাঁচ মাইল গেলেই পাবেন ফাঁসিতলা। তারপরে ঘোড়াঘাটে যাওয়ার পথে পাবেন আরেকটা ফাঁসিতলা। আরেকটা ফাঁসিতলা পাবেন রাজা বিরাট গঞ্জের পাশেত। হামাগের এই গাঁয়েও একখান বুড়া বটগাছ আছলো। ময়-মুরুব্বির কাছে শুনিছি সেই গাছের নামও আছিল ফাঁসির বটগাছ। আহহারে কত মানুষকে ফাঁসিত লটকায়া মারিছে ইংরেজ সিপাইরা। তারা সব ফকির মানুষ। আল্লার রাস্তার ফকির। মানুষের উপর অত্যাচার দেখ্যা তারা রুখ্যা দাঁড়াছিল বাহে।

আমি চমকে যাই। এত জীবন্ত একটা ইতিহাসের ওপর বসে আছি! সুপ্রকাশ রায়ের ‘ভারতে কৃষক আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ বইতে ফকির-সন্ন্যাসি বিদ্রোহের কথা পড়েছি। মজনু শাহের বিদ্রোহ নিয়ে আলাদা বই-ও পড়েছি একাধিক। সেই জায়গাতে বসে আছি আমি! তারপর মনে পড়তে থাকে, সেই বগুড়া থেকে মহাস্থানগড় হয়ে একদিকে ঘোড়াঘাট, আরেকদিকে রংপুর-দিনাজপুর পার হয়ে চেহেল গাজির মাজার পর্যন্ত বিশাল এলাকা নিয়ে বিস্তৃত হয়েছিল মজনু শাহ-র বিদ্রোহের এলাকা। দেশি জমিদার আর বিদেশী ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুগপৎ যুদ্ধ চালিয়েছেন তারা। মজনু শাহের ফকিরদের সাথে এক পর্যায়ে যোগ দিয়েছিল ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে সন্ন্যাসীর দল। বেশ কয়েক বছর এই বিশাল এলাকাকে প্রায় মুক্তাঞ্চলে পরিণত করে রেখেছিলেন তারা। অনেক ছোট-বড় যুদ্ধ হয়েছে তাদের জমিদার এবং ইংরেজ বাহিনীর সাথে। শেষে মেজর টেলরের নেতৃত্বে বিশাল যুদ্ধবহর আর আধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম নিয়ে ইংরেজবাহিনী পরাজিত করতে পেরেছিল ফকির-সন্ন্যাসিদের মিলিত যোদ্ধাদের। মূল ঘাঁটি মহাস্থানগড়ের পতন ঘটলে ফকির মজনু শাহ যখন সাথীদের নিয়ে করতোয়া নদীর দিকে যাচ্ছিলেন। সেই সময় পশ্চাদ্ধাবন করে অসংখ্য ফকিরকে গুলি করে মেরেছিল ইংরেজ সৈন্যরা। সেই শহীদ ফকিরদের মৃতদেহ যেখানে যেখানে কবরস্থ করেছিল গ্রামের লোক, সেগুলোর মধ্যে কয়েকটা পরবর্তীতে মাজার হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল।

এভাবেই এগিয়ে চলছিল ‘খোয়াবনামা’র পাঠ। বরং দিনে দিনে বেড়ে চলছিল শ্রোতার সংখ্যা। আমাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে, গাঁয়ের অশিক্ষিত মানুষরা আধুনিক সাহিত্যের রস গ্রহণে সক্ষম নয়। কিন্তু সেই সময়ের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে, গ্রামের নিরক্ষর মানুষ তাদের মতো করে সাহিত্যকে গ্রহণ করতে পারে ঠিকই। হয়তো তা আমাদের সাথে হুবহু মেলে না। কিন্তু তাদের কাছে সৎ সাহিত্য নিয়ে যেতে পারলে তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করবেন না। আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ তো তাদের জগতেরই গল্প। ‘খোয়াবনামা’ পুরোটা শোনাতে পারিনি আমি সেই আসরে। তার আগেই বদলির হুকুম এসেছিল। বইটা দিয়ে এসেছিলাম প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ফজলুর রহমানের হাতে। কিন্তু সেটি পড়া হয়েছিল কি না সেই খোঁজ নেওয়া হয়নি। এখন, এত বছর পরে, মনে হচ্ছে খোঁজটা নেওয়া উচিত ছিল।

লেখক: কথাসাহিত্যিক