রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ২৯

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ০৩, ২০১৯

আমাদের মেডিক্যাল কলেজে কিছুদিন অর্থোপেডিক বিভাগের শিক্ষক হিসাবে ছিলেন হান্নান স্যার। সমসাময়িক মেডিসিন বিভাগে ছিলেন লতিফা শামসুদ্দীন ম্যাডাম। সেই বছর এইইচসি পরীক্ষার ফল বেরুল। লতিফা ম্যাডামের কন্যা রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। অর্থাৎ বোর্ডে সেকেন্ড স্ট্যান্ড। ক্লাস নিতে এসে হান্নান স্যার তার খাস আঞ্চলিক ভাষায় খেদ প্রকাশ করলেন, লতিফা ছিলি আমার কেলাসমেট। আজ তার মেইয়ে আইএসসি পাশ করে। বোর্ডে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করে। আর আমার ছাওয়াল এখনো মাটির সাতে কতা কয়। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ি তারপর সংসার করতি গেলে এই রকমই হয়। আপনেরা ঠিক সময়ে বিয়েডা করি ফালাইয়েন। প্রতিষ্ঠিত হয়ি বিয়ে করতি গেলে আমার দশাতি পড়বেন কিন্তু।”

স্যারের পরামর্শ মেনে আমি এমবিবিএস ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের আগেই বিয়ে করে ফেললাম। (আসলে প্রেমিকাকে দূরে রেখে থাকতে পারছিলাম না)। তার পরেই বাস্তব পৃথিবী হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল আমার কাঁধে। তার মানে এই নয় যে, আমি বিয়ে করার কারণে পস্তাচ্ছি। পাহাড়সমান প্রতিকূলতা সামনে এসে দাঁড়ালেও কখনোই আমি পেশাগত সাফল্যের আগে বিয়ে করার জন্য নিজেকে দোষারোপ করিনি। যত সমস্যা এসেছে সেগুলো পাশ কাটিয়ে যাইনি। মোকাবেলা করেছি। বছরের পর বছর সেই যুদ্ধের কথা ভাবলে এখন রীতিমতো কেঁপে উঠি। কীভাবে পারলাম!

যে কথাটা বলার জন্য এই কাসুন্দি ঘাঁটা তা হচ্ছে, এই রকম পরিস্থিতিতেও আমি একদিনের জন্যও লেখার জগৎ থেকে সরে যাইনি। কখনো ভাবিনি যে আগে একটু সামলে-সুমলে উঠি, তারপরে নাহয় আবার লেখা শুরু করা যাবে। দিন-রাত যুদ্ধ করার পরেও সাহিত্যের পড়া চলেছে সমানতালে। লিখতে বসেছি সময় পেলেই। বেশিরভাগ সময়ই রাতে। তার মূল্য সবচেয়ে বেশি দিতে হয়েছে আমার স্ত্রীকেই। একটাই ঘর। লেখার টেবিলটা খাটের মাথার কাছ ঘেঁষে। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে খুটখাট করি আমি। বেচারা বউয়ের ঘুম পাতলা। আলোর কারণে এবং আমার নড়াচড়ার কারণে ঘুমাতে পারে না সে। আমি লেখালেখি করে শুতে গেলে কেবলমাত্র তখনই ঘুমের সুযোগ পায় সে। আবার সকাল সকাল উঠতে হয়। বেশ খানিকটা রাস্তা ঠেঙিয়ে কলেজে পড়াতে যেতে হয় তাকে। তার তাই পারমানেন্ট মাথাব্যথা। আমি নিজে তাকে এ-ওষুধ সে-ওষুধ দিই। কখনো সিনিয়র ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। কিন্তু আসল কারণ দূর না করলে তো অসুখ সারবে না। সারেওনি। তখন নিজের লেখার ব্যবস্থা করলাম বারান্দার ডাইনিং টেবিলে। লিখতে পারলে লিখি, না পারলে পড়ি, নোট নিই, সাহিত্য নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবি। কেউ জানে না, আমি নিজেও জানি না, কোনোদিন লেখক হয়ে উঠতে পারব কি না।

আমার এই দাঁতে দাঁত চেপে সাহিত্যের সঙ্গে লেগে থাকার সিদ্ধান্ত যে কতটা সঠিক ছিল তা বুঝতে পারি এখন। একসাথে সারাদেশে লিখতে শুরু করেছিলাম অন্তত একশো জন। প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকেরই যোগাযোগ হতো চিঠিপত্র বা পত্রিকা মারফত। কিন্তু আমার বেশিরভাগ বন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লেখা স্থগিত রেখে জীবনে আর্থিক বা পেশাগত নিশ্চয়তা তৈরি করে তারপর আবার লেখালেখিতে মনোযোগ দেয়ার। বাস্তবতা হচ্ছে তারা বেশিরভাগই আর ফিরতে পারেননি লেখালেখির জগতে। আমাদের এক বন্ধু ছিল মঞ্চনাটক-পাগল। এই এক বছর আগে তার সাথে দেখা হলো অনেকদিন পরে। খেদের সাথে বলল, ভাবছিলাম সংসারটা আর একটু গুছিয়ে নিয়ে অবিলম্বে শুরু করব নাটক। কিন্তু এই ‘আর একটু’ আজ পর্যন্ত শেষ হলো না। এখন দেখছি আমার পক্ষে নতুন ভাবে শুরু করা অসম্ভব।

যারা কুড়ি-বাইশ বছর পরে আবার লিখতে আসতে চেয়েছেন, তারা অধিকাংশই তাল মেলাতে পারেনি সাহিত্যের সমকালীন প্রবণতার সাথে। ছাত্রজীবনের সেই রোমান্টিক বিপ্লবী ভাষা এখন আর প্রযোজ্য নয়। পঁচিশ বছর ধরে একটানা লেখার সাথে থেকে আমি পেশাগত লেখকের পর্যায়ে। পেশা হিসাবে নিতে না পারলেও মনোভঙ্গি পেশাদার লেখকের। পেশা হচ্ছে জীবনের প্রধান কাজ। তো লেখা যদি আমার জীবনের প্রধান কাজ হয়ে থাকে তাহলে আমি অবশ্যই পেশাদার লেখকই। বাইশ-পঁচিশ বছর আগের লেখা কবিতা এবং কথাসাহিত্য এখন আর সেভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে না। যদি সেই সময়কার লেখাগুলো এত উন্নত হতো যে তা চিরকালীনতাকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো তাহলে সেটি আলাদা ব্যাপার। কিন্তু তা নয়। আবার মাঝখানের এতগুলো বছর সৃজনশীল সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগহীনতার কারণে নিজের আগের লেখার সাথে বর্তমানের লেখার মান বা উৎকর্ষ পরিমাপ করার ক্ষমতাও হারিয়ে যায়। তখন নিজের ঘাটতির কথা মনে না রেখে অনেকেই দোষারোপ করতে থাকেন পত্রিকার সম্পাদক এবং গ্রন্থের প্রকাশকদের। নিজের খরচে সেই সময়ের লেখা নিয়ে বই ছেপে যখন দেখতে পান যে কোথাও তার গ্রন্থের পাঠক নেই, আলোচক নেই, তখন তিনি কাকে দোষারোপ করবেন? বন্ধুর প্রত্যাশা থাকে আমি বা আমরা তার বই নিয়ে আলোচনা লিখব, তাকে প্রমোট করব। এটি শুধু প্রত্যাশা নয়, দাবিও বটে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই আমার অপারগতা প্রকাশ করতে হয়। তখনকার বা এখনকার কোনো বন্ধুর লেখা যদি আমার কাছে উন্নত মনে না হয়, তাহলে তার প্রশংসা করে লেখা মানে পাঠক এবং সাহিত্যের সাথে প্রতারণা করা। ব্যক্তিগত সম্পর্ক যত মধুরই হোক না কেন, আমি পত্রিকা বের করলে যেমন তার লেখা ছাপব না, তেমনই তার দুর্বল লেখার প্রশংসাও করতে পারব না। কাজী মোতাহার হোসেনের মতো কেউ-না-কেউ ঠিকই ধরে ফেলবেন আমাকে।

কাজী মোতাহার হোসেন একদিন দুপুর বেলায় ছাতা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দৈনিক পত্রিকার অফিসে হাজির। তাকে দেখে সবাই শশব্যস্ত। স্লামালেকুম স্যার! বসুন স্যার! তিনি একটা বই ব্যাগ থেকে বের করে বললেন, আমি বসতে আসিনি। আপনাদের পত্রিকার গত সপ্তাহের সাহিত্য পাতায় এই বইটার খুব প্রশংসা করে আলোচনা লেখা হয়েছে। আমি সেই আলোচনা পড়ে বইটি কিনেছি। তারপর পড়তে গিয়ে দেখলাম বইটি খুব দুর্বল এবং প্রশংসাগুলো মিথ্যা। আপনারা আমার টাকাও নষ্ট করেছেন, সময়ও নষ্ট করেছেন।

কারো কি তখন জবাব দেবার ক্ষমতা থাকে? আমাদের দেশের লেখক-কবিদের নিজের ভেতরে সবচেয়ে বড় যে সীমাবদ্ধতা থাকে, তার নাম ‘ছাপোষা মানসিকতা’। ছাপোষা জীবন অনেককেই যাপন করতে হয়। উপার্জন কম থাকলে এই রকম জীবন যাপন করতে বাধ্য যে কেউ। তা দোষের নয়। আসলে কোনো কবি বা লেখক কোন পেশায় আছেন, তার সামাজিক অবস্থান কত উঁচুতে, এগুলো কেউ ভাবে না। কেবল দেখার বিষয় হচ্ছে তিনি কেমন লেখা লিখছেন। সুকুমার বড়ুয়া পিয়ন ছিলেন নাকি অফিসার ছিলেন কেউ সে বিষয়ে খোঁজ নেবে না। কিন্তু তিনি যে বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেটুকু জানাই সবার জন্য যথেষ্ট। কাজেই ছাপোষা জীবন দোষের নয়। কিন্তু মানসিকতা যদি ‘ছাপোষা রোগে’ আক্রান্ত হয়, তাহলে তিনি মস্তবড় অফিসার হতে পারবেন, কিন্তু লেখক-কবি হিসাবে সামনের কাতারে আসতে পারা তার জন্য দুরূহ। প্রায় অসম্ভবই।

সাহিত্য আপনাকে কিছু দেবে। কিন্তু তার বিনিময়ে আপনার কাছ থেকে নেবেও অনেক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক