রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৩৯

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ১৬, ২০১৯

একসময় কমিউনিস্ট হতে চেষ্টা করেছিলাম। হতে পারিনি। কমিউনিস্ট হতে হলে অনেকগুলি ব্যাপারে পুরোপুরি শুদ্ধ মানব হতে হয়। যেমন, কমিউনিস্ট কখনোই কোনো অবস্থাতেই মিথ্যা বলবে না। ব্যতিক্রম আত্মগোপনের সময়টুকু। তখন পার্টির দেওয়া ছদ্মনাম এবং ছদ্ম ঠিকানা ব্যবহার করতে হবে। নিজের কমিউনিস্ট পরিচয় গোপন করে রাখতে হবে। কমিউনিস্ট তার পার্টির প্রদত্ত দায়িত্ব বিনা প্রশ্নে পালন করবে। যদি কোনো বিষয়ে তার দ্বিমত থাকে তাহলে কেবলমাত্র পার্টি ফোরামেই আলোচনা করতে পারবে। বাইরে কোনোমতেই কোনো দ্বিমত প্রকাশ করা যাবে না।

কমিউনিস্ট তার সঙ্গি বা সঙ্গিনীর প্রতি চরম একনিষ্ঠ থাকবে। সম্পর্ক ভাঙতে হলেও তা পার্টি ইউনিটের আলোচনায় তুলতে হবে। কমিউনিস্ট কোনো অবস্থাতেই দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারবে না বা পরকীয়াতে জড়াতে পারবে না। নারীদের প্রতি কমিউনিস্টের দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে সবসময় শ্রদ্ধামূলক। মাও সে তুং নারীবাদের সাথে কোনো সম্পর্ক ছাড়াই বলেছিলেন যে, নারী দুই স্তরে শোষিত হয়। একটি রাষ্ট্র ও সমাজ দ্বারা, দ্বিতীয়টি পারিবারিকভাবে। কাজেই পরিবারে যাতে নারী কোনোভাবেই নিজেকে শোষিত মনে না করে, সেইজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে একজন কমিউনিস্টকে।

কমিউনিস্ট তার উপার্জনের একটি অংশ প্রতিমাসে অবশ্যই লেভি হিসাবে প্রদান করবে পার্টিফান্ডে। সেই টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেবে সংশ্লিষ্ট পার্টি ইউনিট। পার্টির সকল লিটারেচার, পত্রিকা, বুকলেট, প্রচারপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পাঠ করতে হবে কমিউনিস্টকে। কেউ লেখাপড়া না জানলে তাকে পড়ে বুঝিয়ে দেবে পার্টির শিক্ষিত সদস্যরা। এই পাঠ এবং চিন্তার শৃঙ্খলা এমনভাবে রক্ষিত হবে যে পার্টির সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে পলিটব্যুরো, জেলা কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, সকল পার্টিসদস্য, সহযোগী সদস্য এবং গ্রুপসদস্যের বক্তব্য যেন একই লাইন অনুসরণ করে প্রদত্ত হয়।

পার্টির প্রদত্ত সিলেবাসের বইপত্র খুব মনোযোগের সাথে পাঠ করতে হবে। প্রত্যেকেই হবে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী, নাস্তিক। তবে একজন কমিউনিস্ট কখনোই নাস্তিকতা প্রচার করবে না। প্রকাশ্যে বা জনসমক্ষে নাস্তিকতা, ঈশ্বর বা ধর্ম নিয়ে বিতর্ক করতে পারবে না। কারণ কমিউনিস্ট বিশ্বাস করে যে, বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষের সকল জাগতিক সমস্যার সমাধান হলে তার আর কোনো ধর্ম বা ঈশ্বরের প্রয়োজন হবে না। তখন মানুষ এমনিতেই ধর্ম বা ঈশ্বরের কথা ভুলে যাবে। কোনো কমিউনিস্ট তার পার্টির অনুমোদন ব্যতীত কোনো ধরনের অস্ত্র বহন করতে পারবেন না। এমনকী আঘাত এলেও পার্টি ইউনিটের সিদ্ধান্ত ছাড়া প্রত্যাঘাতও করতে পারবেন না। পার্টি যদি মনে করে সেই মুহূর্তে প্রত্যাঘাত করা পার্টির ক্ষতির কারণ হতে পারে, তাহলে তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

সৃজনশীল লেখক-শিল্পীরা পার্টিলাইনের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো বক্তব্য সম্বলিত গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক লিখতে পারবেন না। এইরকম আরো অনেক ধারা-উপধারা রয়েছে। বিপ্লবের জন্য নিশ্চয়ই এই ধরনের সুশৃঙ্খল এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পার্টির দরকার আছে। কিন্তু আমার পক্ষে সবকিছু মেনে নিয়ে কমিউনিস্ট হওয়া সম্ভব হয়নি। আমার সিনিয়র কমরেডরা টিটকিরি দিয়ে হাসতেন। বলতেন, লেখক-কবিরা পার্টিতে টিকতে পারে না। তারা শৃঙ্খলা নয়, ভাবসাগরে বিচরণ করতে ভালোবাসে। তা যে কারণেই হোক, আমার কমিউনিস্ট হওয়া হয়নি। হয়নি নাস্তিক হওয়াও। যদিও নাস্তিকতার বেশকিছু যুক্তি আমি খণ্ডন করতে পারি না। আবার নিজেকে একনিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমান বলেও দাবি করতে পারি না। চাই-ও না।

তাহলে আমি আসলে কী? নিজের দিকে তাকিয়ে বলতে পারি, আমি মিশ্রিত চিন্তা এবং সংস্কৃতির একজন মানুষ। ধর্ম আমি পেয়েছি কয়েক পুরুষের উত্তরাধিকারসূত্রে। ধর্মের শাস্ত্র-শরিয়ত আমি তেমনভাবে ধারণ করি না। কিন্তু ধর্মের যেটুকু আমার কাছে সংস্কৃতির অংশ বলে মনে হয়, আমি সেটুকু গ্রহণ করি, প্র্যাকটিসও করি। আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির সাথে আমি ইসলামবাহিত কিছু ইতিবাচক সাংস্কৃতিক উপাদান পেয়েছি উত্তরাধিকারসূত্রে। যা পায়নি বাঙালি হিন্দু। সেই অর্থে বলতে পারি সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমি বেশি ভাগ্যবান। রামায়ন-মহাভারত পেয়েছি। পেয়েছি বাংলার অসংখ্য পৌরাণিক ও চিরায়ত আখ্যান। পাশাপাশি পেয়েছি কাসাসোল আম্বিয়া, মর্শিয়াপুঁথি এবং নানারকম মুসলিম এবং প্রাক-মুসলিম আখ্যান। হিন্দুদের পূজা-পার্বন যেমন ধর্মকাজের পাশাপাশি সংস্কৃতিও বটে, আমার জীবনযাপনে সেইরকম কিছু সাংস্কৃতিক উপাদান এসেছে ধর্মের রূপ ধরেও। মুসলিম সংস্কৃতি থেকে আমি পেয়েছি বড়দের সালাম জানানোর রীতি, স্কাউটিং থেকে পেয়েছি কোনো অন্ধ বা বৃদ্ধ মানুষকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দেবার অভ্যেস, প্রতিবেশী শিক্ষিত হিন্দুর কাছ থেকে পেয়েছি যুক্তিশীলতা এবং সহনশীলতার শিক্ষা। এর পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্য এবং বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডারের কাছে আমি যতটা যেতে পেরেছি তা থেকে পেয়েছি নিজেদের শাসক-রাষ্ট্র-আন্তর্জাতিক রাজনীতির নোংরা দিকগুলোকে শনাক্ত করার ক্ষমতা।

সবকিছু মিলিয়েই এই আমি। নিজে মুসলিম মৌলবাদীদের সন্ত্রাসী এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রচণ্ড সমালোচনা করি। আবার কেউ যদি বলে যে, মুসলিমমাত্রই মৌলবাদী জঙ্গি, তাহলে তার ভুল ভাঙানোর জন্য দিনভর তর্কে যেতে দ্বিধা করি না। ঈদের জামাত আমাদের ধর্মকাজের পাশাপাশি খুব বড় সামাজিক সংস্কৃতিও বটে। উৎসবের দিন মানুষ নতুন পোশাক পরে। উৎসব অনুযায়ী সাধ্যমতো সুন্দর পোশাক পরে। পহেলা বৈশাখে শাড়ি-পাঞ্জাবি, বাসন্তি উৎসবে অন্য রঙের শাড়ি-পাঞ্জাবি, বিজয় দিবসে লাল-সবুজ শাড়ি-পাঞ্জাবি, পূজার সময় বাঙালি হিন্দু পুরুষদের ধূতি-পাঞ্জাবি, ঈদের সময় বাঙালি মুসলমান পুরুষদের পায়জামা-পাঞ্জাবি-টুপি এখন সর্বত্র প্রচলিত। এইসব পোশাক আবার ফ্যাশনও বটে। বিদেশে ঈদ করার সুবাদে দেখেছি নানা দেশের মুসলমান নানা ধরনের পোশাক পরে আসে। আরবদের জোব্বা, পাকিস্তানিদের কুচি দেওয়া পায়জামা, আফ্রিকানদের জোব্বা ও চাদরের মিশ্রণ। সবগুলো তুলনা করে আমার সৌন্দর্যবিচারী চোখ বলেছে, বাঙালি মুসলমানের পায়জামা-পাঞ্জাবি-টুপি হচ্ছে সবচাইতে সুন্দর ও সবচাইতে ফ্যাশনেবল পোশাক।

আমার ঈদের পোশাক দেখে কেউ আমাকে মুসলমান বলে ‘গালি’ দিতে চাইলে দিক। কিন্তু যদি কেউ সেই পোশাকের কারণে আমাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যা দেয়, তাহলে তার মুখের ওপর উপেক্ষার ধুলো ছুঁড়ে দেওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর থাকে না। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক