রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৪০

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ১৮, ২০১৯

কয়েক বছর আগেও ঘরের বাইরে সবসময় সঙ্গী পরিবেষ্টিত থাকতাম। আসলে জড়িত ছিলাম বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের সাথে। সেই কিশোর বয়সে খেলাঘর-চাঁদের হাট দিয়ে শুরু। তারপর কত রকমের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যে কাজ করলাম! তাই সঙ্গীর পরিধি সবসময়ই ছিল বেশ বড়সড়। তাছাড়া ছেলেমেয়েরা সমবেত হতো নানা ধরনের প্রণোদনার জন্য। কেউ লিখতে চায়, কেউ আবৃত্তি করতে চায়, কেউ বিতার্কিক হতে চায়, কেউ নাটক করতে চায়, কেউ জীবনের হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। আবার কেউ কেউ স্রেফ আমার সঙ্গে থেকে দেখতে চায় আমি কীভাবে চলি।

এইরকম সঙ্গবেষ্টনি নাটোরে এবং ঢাকাতেও। মাঝে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। কিন্তু ব্লগার হত্যাকাণ্ড শুরু হলে আবার স্বতঃপ্রণোদিত দেহরক্ষীর দল জড়ো হয়ে গেল। আমি বাইরে বেরুলেই তারা পালাক্রমে আমার সঙ্গে থাকে। মোটকথা, আমি লোকজনের ভাষ্যমতো ‘দলবল নিয়ে চলাফেরা করা লেখক’। সেইসময় একদিন হরিপদ দত্ত বলেছিলেন, ভাইরে, এখন সঙ্গী-সাথী নিয়া ঘুরতাছো। কয়দিন পরে এমন অবস্থা হইব যে, মানুষ দ্যাখলেই বিরক্ত আইব তোমার। কোনো ব্যাডাবেডি কাছে আইলেই মনে হইব ঝামেলা আইল। যদি ততদিন লেখালেখি করো তাইলে দ্যাখবা আমার কথাখান কতখানি সত্যি।

‘মানুষ দেখলেই বিরক্ত’ হই না। তবে এই কয়েক বছরে হরিপদ দা’র বাকি কথাগুলো সত্যি হয়ে উঠেছে আমার জীবনযাপনে। যত একা থাকতে পারি তত ভালো লাগে। চিন্তা করার জন্যও বটে, আবার কোনো চিন্তা না করার সময়েও বটে। হাঁটার সময়েও একা হাঁটতে পছন্দ করি। কোনো জায়গাতে দল বেঁধে বেড়ানো, পিকনিকে যাওয়া, সাইট সিয়িং-এ যাওয়া এড়িয়ে একাই যেতে চেষ্টা করি। দল বেঁধে গেলেও জায়গামতো পৌঁছে আলাদা হয়ে যাই আলগোছে। এসব যে আমি খুব সচেতনভাবে করি, তা নয়। আপনাআপনি হয়ে যায়। সচেতনভাবে যে করি না তা বুঝতে পারি যখন মনমতো আড্ডা পাই, এখনো সেই আড্ডাতে নিজেকে মেলে দিই পুরোপুরিভাবে। এই পরিবর্তনটা কেন যে এলো আমার মধ্যে!

কোনো ধরনের সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের সাথে এখন যুক্ত থাকতে চাই না পারতপক্ষে। এতদিনের অভিজ্ঞতা নিজের অজান্তেই মনে মনে হিসাব করে ফেলেছে যে, সংগঠনে যত ইনপুট দিয়েছি, শ্রম-মেধা-ঘাম-সময়-অর্থ ব্যয় করেছি, আউটপুট সেই তুলনায় খুবই নগণ্য। আউটপুট বলতে নিজের লাভ-ক্ষতি বোঝাতে চাইনি। বোঝাতে চেয়েছি যে, সব লক্ষ্য সামনে নিয়ে সংগঠন গড়া এবং চালিয়ে যাওয়া, সমাজকে সেই লক্ষ্যের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি আদৌ। এমনকী সংগঠনের সদস্যদেরকেও। অনেকেই সংগঠনের পদের পরিচয়ে পরিচিত হন, আমার নিজের জন্য সেটি কখনো প্রয়োজন হয়নি। বরং অনেকক্ষেত্রে সংগঠনই আমার পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করেছে। তাতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু সমাজকে যখন সংগঠনের মাধ্যমে কোনোকিছু দেওয়া সম্ভবই হয় না, তখন সেই সংগঠনে থাকা বা সময় দেওয়াটা অর্থহীন। হতে পারে আমি ভুল সমাজে ভুল সময়ে ভুল সঙ্গীদের নিয়ে সংগঠন করেছি। সেকারণেই এই ধরনের ফলাফল বা ফলাফলহীনতা।

ব্রিটিশ আমলে স্বদেশি চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই লেখাপড়া শিখে কলকাতা থেকে ফিরে যেতেন নিজের এলাকায়। গ্রামে স্কুল বানাতেন, সমবায় সমিতি করতেন, যুব সংগঠন গড়তেন, নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যত্রম পরিচালনা করতেন। সেইসাথে তারা চালিয়ে যেতেন পঠনপাঠন। সেজন্য পাঠাগারও প্রতিষ্ঠা করতেন। কলকাতা থেকে নিয়মিত ডাকযোগে বা লোক মারফত আনাতেন পত্র-পত্রিকা। পড়তেন। পড়াতেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। এইভাবে ধীরে ধীরে রাজধানীর বাইরের শহরগুলোতে গড়ে উঠেছিল একটি সারস্বত শ্রেণি, আমি যাদের নাম দিয়েছি ‘মফস্বল ইন্টেলিজেনশিয়া’। তারা প্রধানত ছিলেন হিন্দু ভদ্রশ্রেণি। তাদের দেখাদেখি মুসলমানরাও যেখানে পেরেছেন সেখানে গড়ে তুলেছেন নিজেদের ইন্টেলেকচুয়াল চক্র। এই মফস্বল ইন্টেলিজেনশিয়ার ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি। আজকের দিনে কোনো সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক কি কল্পনা করতে পারবেন যে, ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে ‘মানসী ও মর্ম্মবাণী’ নামের মাসিক সাহিত্য পত্রিকাটির গ্রাহক সংখ্যা ছিল সাত হাজার? তাহলে ‘প্রবাসী’ ‘বিচিত্রা’সহ নামি পত্রিকাগুলোর প্রচারসংখ্যা ছিল নিশ্চয়ই আরো বেশি। আমি মফস্বল শহরের যত পুরনো পাঠাগার এবং স্কুলের লাইব্রেরিতে ঢুকেছি, সব জায়গাতেই এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার সেট দেখেছি। ইংরেজিতে শেক্সপিয়ারের রচনাসমগ্র দেখেছি। বঙ্কিমের রচনাবলি দেখেছি। অনেক লাইব্রেরিতে ‘প্রবাসী’ ‘ভারতবর্ষ’ ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার বাঁধানো সেট দেখেছি। আমাদের ছোটবেলায় বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে তিনি অবশ্যই আমাদের সাথে কোনো ইংরেজি বা বাংলা বাক্যের গঠন নিয়ে আলাপ করতেন। একটি বা দুইটি ইংরেজি ট্রান্সলেশন শিখিয়ে যেতেন। ‘ঐ যে ট্রেন দেখা যায়’ বাক্যের ইংরেজি ট্রান্সলেশন ‘মাইন্ড দ্য ট্রেন’ আমি স্কুল বা কলেজে শিখিনি। শিখেছিলাম আব্বার একজন বন্ধুর কাছে। এমন অনেক কিছুই শিখতে পেরেছি শ্রেণিকক্ষের বাইরেই।

বড়দের আলোচনায় রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের মাঝে হ্যামলেটের বড়সড় সংলাপ মুখস্ত শুনেছি অনেকের মুখে। প্লেটো বা আফলাতুন, ইবনে সিনা, বাৎসায়ন, ইবনে খালদুন— এইসব নাম আমি শুনেছি সেইসব মানুষের গল্পের মধ্যে।

এখন মফস্বল ইন্টেলিজেনশিয়া বলে কিছু নেই। মফস্বলের বুদ্ধিজীবীরা বড়জোর খবরের কাগজের উপসম্পাদকীয় পড়ে। আমাদের শহরের সবগুলো বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, আইনজীবী, ডাক্তার ও সাংস্কৃতিক নেতাকে ঝাঁকি দিলে প্রত্যেকেই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, তারা ১৯৮০ সালের পরে কোনো বই কেনেননি বা পড়েননি। ব্যতিক্রম এক বা দুইজন। সব শহরেই একই অবস্থা। তাদের সাথে কী নিয়ে গল্প করবেন আপনি?

মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তদের মধ্যে এখন দুই শ্রেণীর নরনারী পাওয়া যাবে। একদল নিজেরা সুবিধাভোগী ও দুর্নীতিবাজ। আরেক দল মেরুদণ্ডহীন কেঁচো প্রজাতি। অথচ সবদেশে সবসময় বিপ্লবী চিন্তাধারার মানুষ উঠে এসেছে এই একটি শ্রেণি এবং উপশ্রেণি থেকেই। বাংলাদেশের এখনকার মধ্যবিত্ত দেখলে আপনার মনেই হবে না এই দেশে ভবিষতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। বাকি রইল তরুণ সমাজের কথা। তাদের নিয়েও হতাশই হতে হয়েছে। আপনি আকাশের দিকে আঙুল তুলে তাদের চাঁদ দেখাতে চাইলে তারা আপনার আঙুলের দিকেই তাকিয়ে থাকে। তার চাইতে উঁচুতে তাকানোর সাহস পায় না। আর শেষ পর্যন্ত আপনি খুব বেদনার সাথে আবিষ্কার করবেন যে তারা জ্ঞানচর্চা এবং সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে আপনার সঙ্গে থাকবে বলে কাছে ভিড়লেও কারো কারো মূল লক্ষ্য থাকে আপনি তাকে একটি ভালো চাকুরি জোগাড় করে দেবেন। ফলাফল হতাশা— দুই তরফেই।

একা না হয়ে আর উপায় কী! চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক