
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৪৪
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুন ২৫, ২০১৯
ক্রিকেট মানেই নগদা-নগদ। ব্রায়ান লারা ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট খেলতেন ওয়ারউইকশায়ার দলের হয়ে। তখন ইংলিশ কাউন্টিতে খেলা ছিল সব ক্রিকেটারেরই স্বপ্ন। আভিজাত্য তো বটেই, অর্থপ্রাপ্তির মানদণ্ডেও কাউন্টি ক্রিকেটের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল না। এই দলের হয়ে খেলেই প্রথম শ্রেণির ম্যাচে এক ইনিংসে হানিফ মোহাম্মদের ৪৯৯ রানের রেকর্ড ভেঙে ব্রায়ান লারা করেছিলেন ৫২৬ রান। (একজন ব্যাটসম্যান একটানা দুইদিন ধরে ব্যাট করে পাঁচশোর বেশি রান তুলে ফেললেন। ভাবা যায়, কী দানবীয় কাজ!)। কিন্তু একটা মৌসুমে পর পর কয়েকটি ম্যাচে খুবই খারাপ করলেন লারা। সাথে সাথে ইংলিশ ট্যাবলয়েডগুলো হৈ চৈ শুরু করে দিল। লারা ফুরিয়ে গেছেন। অল্প রান করে লারা আউট হয়ে ফিরে আসছেন আর সমর্থকরা তাকে দুয়ো দিচ্ছে। এমনকী মাঠের বাইরের অনুষ্ঠানেও সামনাসামনি পেলে অপমান করছে লারাকে। লারা খুব মুডি ক্রিকেটার ছিলেন। মানুষ হিসাবেও মুডি। তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন যে কোনো প্লেয়ার ইচ্ছা করে খারাপ খেলে না। আর কোনো ব্যাটসম্যানই সবদিন বেশি বেশি রান করতে পারে না। ভদ্রলোক সমর্থকরা তখন সরাসরি বলেছিল, রান করার জন্যই তোমাকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেয়া হয়। রান করতে না পারলে মাঠ ছেড়ে দাও।
পরের বছর থেকে লারা আর কাউন্টি ক্রিকেটে খেলেননি। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে ব্রিটিশ দলের বিরুদ্ধেই গড়েছিলেন টেস্টে এক ইনিংসে ৪০০ রান করার ইতিহাস। সেই রেকর্ড অটুট। যেমন অটুট প্রথম শ্রেণির ম্যাচে এক ইনিংসে পাঁচশোর বেশি রান করার রেকর্ডটিও।
ক্রিকেট খেলা বা তাৎক্ষণিক উত্তেজনা যেসব জিনিসে আছে, সেগুলো সবই নগদ বিদায়ের ব্যাপার। আজ সাকিব-মুশফিকদের বন্দনা। কেউ কি আজকের ম্যাচ জেতার পরে স্মরণ করেছেন বাংলাদেশ দলকে ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র এনে দেওয়া খেলোয়াড়দের নাম? তামিম ইকবাল এখন মুখে মুখে। কিন্তু খেলোয়াড় হিসাবে তারই চাচা আকরাম খানের কথা কেউ মনে রেখেছেন? রেডিয়োতে খেলা শুনতাম তখন। বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে হলে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই-এর মধ্য দিয়ে যেতে হতো, সেসব কথা এখন কারোই তেমন মনে নেই। নেদারল্যান্ডস-এর বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা। পরাজয়ের শঙ্কায় কাঁপছে বাংলাদেশ দল। সেই সময় কী অসাধারণ একটি অপরাজিত ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে জেতালেন আকরাম খান, সেই শিহরণ এখনো মনে আছে আমাদের। রেডিয়োতে খেলার ধারাবিবরণী শুনছি। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য মৌলি একটানা দোয়া পড়ে যাচ্ছে। ক্রিকেট সে তখনো ভালো করে বুঝতে শেখেনি। আকরাম খান উইনিং স্ট্রোকটা নিলেন আর ধারাভাষ্যকার বাংলাদেশের বিজয় ঘোষণা করলেন চিৎকার সহযোগে আবেগে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে। আর মৌলি ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল হাউমাউ করে। কেনিয়ার বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলায় মোহাম্মদ রফিকের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স? শেষ বলে হাসিবুল হাসান শান্ত-র এক রান নিয়ে জয় এনে দেওয়া! সেই মুহূর্তগুলোকে আর নামগুলোকে মনে রেখেছে কয়জন? সম্মান জানায় কয়জন?
এখন তো ভারতের জয় দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আশির দশকে আমরা যখন ক্রিকেট বুঝতে শিখেছি, টিভিতে দেখতে পাচ্ছি, তখন নিত্যদিন পাকিস্তানের কাছে ভারতের হার দেখতে দেখতে নিজেরাই নিস্তেজ হয়ে যেতাম। গাভাস্কার, কপিল দেব, রবি শাস্ত্রী, আজহারউদ্দিন, শচীন তেন্ডুলকার, নভজোৎ সিঁধু, চেতন শর্মারা পরাজয়ের সাগরে হাবুডুবু খেতেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। ইমরান খান, জাভেদ মিয়ানদাদ, সেলিম মালিক, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুসরা তো ছিলেনই। যদি কোনোদিন তাদের ওপরের সারির ব্যাটসম্যানরা ফেইল করত, আমরা ভাবতাম আজ ইন্ডিয়া জিতবেই, ঠিক তখনই আগে না-না-শোনা নতুন এক ব্যাটসম্যান একাই হারিয়ে দিল ভারতকে। মঞ্জুর এলাহী বা এজাজ ফকিহ। কিংবা উইকেটকিপার মইন খান। সারজা-র মাঠে আকিব জাভেদ একে একে বিশ্বসেরা সাত ভারতীয় ব্যাটসম্যানকে আউট করে দিল। বাসিত আলী, আমির সোহেল, সাইদ আনোয়ার, ইনজামামুল হক, সাকলায়েন মুশতাকরা আসার পরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের হারটা প্রায় নিয়তির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ভারত যদিও ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জিতেছিল, কিন্তু সত্যিকারের ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল নব্বই দশকের শেষে এসে বাঙালি সৌরভ গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে। এবং বাংলাদেশে তখন থেকে ভারতীয় ক্রিকেট দলের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছিল কেবলমাত্র সৌরভ গাঙ্গুলীর জন্যই।
১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ জিতেছিল পাকিস্তান। ঐ বিশ্বকাপটি নানা কারণেই স্মরণীয়। সেবারই প্রথম রঙিন পোশাক পরেছিলেন খেলোয়াড়রা। প্রত্যেক দলের আলাদা আলাদা রঙ ও ডিজাইনের জার্সি ছিল। সেবার খেলা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে। নিউজিল্যান্ড ছিল কুলীন ৬টি দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কমজোরি হিসাবে পরিচিত। কিন্তু সেবার বিশ্বকাপ শুরু করেছিল তারা চ্যাম্পিয়নের মতো। উদ্বোধনী খেলাতে হারিয়েছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে। মার্টিন ক্রো ছিলেন দলের ক্যাপ্টেন। এবং অসম্ভব ফর্মে তিনি। সেবার ওয়ান ডে ম্যাচে সম্পূর্ণ নতুন স্ট্রাটেজি গ্রহণ করেছিল। আগে পর্যন্ত ওয়ান ডে ম্যাচ মানে ৪০ ওভার পর্যন্ত দেখে-শুনে স্বাভাবিক ভাবে রান করা। আর শেষ ১০ ওভারে তেড়ে-ফুঁড়ে পিটিয়ে রান তোলা। নিউজিল্যান্ড পরিবর্তন নিয়ে এল। প্রথম ১৫ ওভারে ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশনের সুযোগ নিয়ে উড়িযে মারতে শুরু করল তারা। মার্ক গ্রেটব্যাচ ব্যাটসম্যান হিসাবে তেমন পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু দেখা গেল প্রথম ১৫ ওভারে তিনি বল ফিল্ডারদের মাথার ওপর দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সীমানার বাইরে। হয়ে গেলেন হট ফেভারিট ওপেনার। আবার স্পিন দিয়ে প্রতম ওভার থেকে আক্রমণটাও শুরু করল নিউজিল্যান্ড। দীপক প্যাটেলের অফ স্পিন মোকাবেলা করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল সব দলের ব্যাটসম্যানদের। আবার এই বিশ্বকাপেই নিউজিল্যান্ড প্রথম ক্রিকেট দলের জন্য একজন কোচ নিয়োগ করেছিল। তিনি ছিলেন ওয়ারেন লী। তার আগে ক্রিকেট দলে ম্যানেজার থাকত, কোচ থাকত না কোনো। দাপটের সাথে খেলে নিউজিল্যান্ড সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের। পাকিস্তান সেমিফাইনালে এসেছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। লীগ ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অল আউট হয়ে গিয়েছিল ৭৪ রানে। বৃষ্টিতে খেলা ভেসে যাওয়াতে এক পয়েন্ট পেয়েছিল ভাগ্যক্রমে। তারপরেও তাদের সেমিফাইনালে খেলাটি নির্ভর করছিল অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচের ওপর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতলে তারাই খেলত সেমিফাইনালে। কিন্তু লারাকে রানআউট করে দিয়ে ফিল সিমন্স হারিয়ে দিলেন নিজের দলকে। সেমিফাইনালেও সেঞ্চুরি করেছিলেন মার্টিন ক্রো। নিউজিল্যান্ড দলের সংগ্রহও ছিল যথেষ্ট। জেতার পথেই এগুচ্ছিল তারা। জাভেদ মিয়ানদাদ একদিক আগলে রেখে অন্যদের আউট হওয়া দেখছিলেন। সেই সময় নামলেন প্রায় অপরিচিত এক ব্যাটসম্যান ইনজামামুল হক। বিশ্বকাপের আগে তিনি কোনো ওয়ান ডে ম্যাচ খেলেননি। টিভিতে পেস বোলারদের বিরুদ্ধে তাকে অনায়াসে খেলতে দেখে নিজের ক্যাপ্টেনসি পাওয়ারের অপব্যবহার করে ইনজামামকে দলে ঢুকিয়েছিলেন ইমরান খান। সেদিন দেখলাম যুবকের মুখ সবসময় ভাবলেশহীন। বলকে জোরে পেটানোর সময়েও মুখ কুঁচকে যায় না তার। আর কী খেলাটাই না খেললেন। মার্টিন ক্রো-র দলকে আউট করে দিলেন সেমিফাইনালে। ফাইনালেও সেইরকম ব্যাটিং। তার ব্যাটিং এবং ওয়াসিম আকরামের বোলিং পাকিস্তানকে সেবার বিশ্বকাপের ট্রফি এনে দিয়েছিল।
হতাশ মার্টিন ক্রো পরে আর ঘুরে দাঁড়াতেই পারেননি। ক্রিকেট এমনই। নগদ পাওয়া। নয়তো নগদ বিদায়। এমন নগদা-নগদি ব্যাপার আমার পোষায় না। তাই সারাজীবন ধরে যে কাজ করা যায়, সেই সাহিত্যই করছি। ক্রিকেটে যাইনি। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক