
প্রমথনাথ বিশী
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৪৬
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুন ২৯, ২০১৯
প্রমথনাথ বিশীকে নিয়ে নাটোরের মানুষ হিসাবে আমাদের প্রচ্ছন্ন একটি গর্ব আছে। তার বাড়ি এবং জন্ম নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়াড়ি গ্রামে। ঐ টুকুই। তার বেশি নয়। কোনো লেখককে শ্রদ্ধা জানানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে তার রচনা পাঠ করা। এই জায়গাতে আমরা নিদারুণভাবে পিছিয়ে। তাই আমাদের গর্বকে বলা যায় মূর্খের গর্ব। সেই মূর্খতা নিয়েও আমাদের গর্বিত জীবন যাপন করতে মোটেই বাধে না। প্রমথনাথ বিশীর কথা আরেকবার মনে পড়ল সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাবলি পাঠ করতে গিয়ে।
আমি নিজে সবসময় বলি যে সাহিত্যচর্চা কোনো গুরুমুখি বিদ্যা নয়। সঙ্গীত থেকে সুফিবাদ পর্যন্ত বিষয়গুলো গুরুমুখি। কিন্তু লেখক বা কবি হতে হয় একা একা, নিজে নিজে। গুরু নেই। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক আছে অসংখ্য। সৈয়দ সাহেব মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে কারো তত্ত্বাবধানে যদি লেখক হওয়া যেত তাহলে ৪০ বছর রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে শান্তিনিকেতন থেকে লেখক-কবি সৃষ্টি হতো শত শত। কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, সেই ৪০ বছরে শান্তিনিকেতন থেকে লেখক তৈরি হয়েছে মাত্র একজন। তিনি প্রমথনাথ বিশী। আমার মতে অবশ্য সংখ্যাটি নিদেন পক্ষে ২ হবে। কারণ আলী সাহেব বিনয়বশত নিজেকে বাদ দিয়ে হিসাবটা করেছেন।
ইংরেজ কবি শেলীর নাম আমরা বাঙালিরা উচ্চারণ করি পার্সি বিশি শেলী বলে। সৈয়দ মুজতবা আলী বলছেন ইংরেজ বিশি এবং বাঙালি বিশী— দুজনেই প্রথাভাঙা কালাপাহাড়। কাউকে রেয়াত করার মানুষ ছিলেন না তারা। অন্যান্য বড় মানুষদের মতো রবীন্দ্রনাথেরও ডজন ডজন স্তাবক ছিল। শান্তিনিকেতনে সেই সময় স্তাবকদের ভিড়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেও অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন মাঝে মাঝে। কিন্তু প্রমথনাথ বিশী স্তাবকতার পাশ দিয়ে তো যেতেনই না। বরং মাঝে মাঝে বিরোধিতাও করতেন। সেই বিরোধিতা কখনো কখনো এতই তীব্র ছিল গুরু-শিষ্যের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি পর্যন্ত ঘটে যেত। অবশ্য সাময়িক সময়ের জন্য।
শান্তিনিকেতনে ব্রাক্ষ্মণ ছাড়া প্রথম দিকে কোনো ছাত্র বা শিক্ষক ছিলেন না। একজন কায়স্থকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হবে জেনে সেখানে প্রায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। হিন্দু পণ্ডিতরা শাস্ত্রে কী লেখা আছে, তার পাশাপাশি অতীতে কী এমন কোনো উদাহরণ ছিল কি না সে বিষয়ে জানতে চান। কিন্তু সদ্য তরুণ প্রমথনাথ বিশী ওসব কথা কানে নিতে রাজি নন। তার পরিষ্কার কথা— অতীতে কী হয়েছে তা জানার দরকার নেই। বর্তমানে কেমন হওয়া উচিত সেটাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।
১৯২১ সাল থেকে শান্তিনিকেতনে বিদেশী ভাষা শিক্ষা দেবার জন্য বিশিষ্ট্য ব্যক্তিরা আসতে শুরু করেন। তখন ছাত্র-শিক্ষক সবাই ছুটছেন অন্য কোনো ভাষা শিক্ষার ক্লাসে। বিধুভূষণ শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, অমিয় চক্রবর্তী, এমনকী ক্ষিতিমোহনের স্ত্রী পর্যন্ত ছুটছেন বিভিন্ন ভাষা শেখার ক্লাসে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নোটবই হাতে নিয়ে লেভি সাহেবের ক্লাস করছেন নিয়মিত। কিন্তু প্রমথনাথ বিশী নির্বিকার। ওসবের ধারে-কাছে নেই। কেউ জিগ্যেস করলে বলতেন, লখনৌতে খানদানি ঘরের ছেলেদের উর্দু বাদে অন্য কোনো ভাষার লোকের সাথে কথা বলতে দেওয়া হতো না, পাছে তার উর্দু উচ্চারণ অন্য ভাষার সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়, অ্যাকসেন্ট বিকৃত হয়ে যায়! তাই তিনিও বাংলা নষ্ট হবে ভয়ে অন্য ভাষার কাছে ঘেঁষতে চান না।
আসলে এটি ছিল প্রশ্নকারীকে ভড়কে দেওয়ার উত্তর। বাংলাসাহিত্যে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করার সাথে সাথে তিনি খুব ভালো ইংরেজি এবং সংস্কৃত শিখেছিলেন। প্রমথনাথ বিশী এটাও জানতেন যে শান্তিনিকেতনের স্তাবক সম্প্রদায়ের তিনি চক্ষুশূল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও সাধ্য নেই তাকে পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক বা কর্মী হিসাবে গ্রহণ করা। কাজেই ভবিষ্যতে ডাল-ভাত জোটানোর জন্য তাকে কলকাতার কলেজে ভর্তি হতে হয়েছিল। সেখানেও শিক্ষকরা তার প্রশ্নবানে অতিষ্ঠ হয়ে পড়তেন। শিক্ষক প্রশ্ন করলে অনেক ছাত্র উত্তর দিতে পারে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছাত্রের প্রশ্নে শিক্ষকের জেরবার হয়ে যাওয়া দেখাটা কারো জন্যই সুখকর নয়। যেহেতু ক্লাস থেকে শেখার কিছু নেই, তাই প্রমথনাথ বিশী ক্লাস বাদ দিয়ে ময়দানে-রেস্তোরাঁয়-লাইব্রেরিতে সময় কাটাতেন। শিক্ষকরাও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। খুব অক্লেশে তিনি এমএস পাশ করেছিলেন। অধ্যাপনা থেকে শুরু করে একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছিলেন। একবার নয়। দুইবার উপাচার্য হয়েছিলেন। কিন্তু পণ্ডিত তিনি হননি। হয়েছিলেন লেখক। কালচার কাকে বলে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি সবসময় বলতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত ‘জ্ঞানগম্যি’ ভুলে যাওয়ার পরে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে, সেটুকুই কালচার।
শুরুতে বলেছি, কোনো লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে তার গ্রন্থ পাঠ করা। কোনো লেখকের জন্ম-জনপদের মানুষরা যখন লেখক বা গুণী মানুষকে নিয়ে কিঞ্চিৎ আত্মশ্লাঘা বোধ করে, তখন সেই লেখকের গ্রন্থপাঠ তাদের জন্য ফরজ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের নাটোরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারে উল্টো। গণ্ডায় গণ্ডায় কলেজ হয়েছে নাটোর জেলা জুড়ে। সেইসব কলেজের শিক্ষকদের সামনে প্রমথনাথ বিশীর নাম উচ্চারণ করলে তারা গরুর মতো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকেন। তিনি কি বড় কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন? কিংবা বড় কোনো অফিসার ছিলেন? যখন জানানো হয় যে, দুটোর কোনোটাই ছিলেন না তিনি। প্রমথনাথ বিশী একজন বরেণ্য লেখক। তখন তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন, ওহ লেখক! তাহলে আর কী হলো! লেখক তো ইচ্ছা করলে আমিও হতে পারি। নেহায়েত লেখার সময়টা করে উঠতে পারি না তাই লেখক বা কবি হইনি।
যেমন এখন একপাতা শুদ্ধ বানান লিখতে না জানা নাটোরের অনেক সংবাদসংগ্রাহক আমার নাম শুনলে নাক সিঁটকান, ও আর এমনকী! আমরা লেখলেও বাংলা একাডমি পুরস্কার ঠিকই পাইতাম। আর জাকির পুরস্কার পাইলেই বা হইছেডা কী? আমরা সকাল বেলা নাস্তা করি এমপি-র সাথে, দুপরে ভাত খাই ডিসি-র সাথে, সন্ধ্যাত চা খাই এসপি-র সাথে, রাতের ডিনার খাই মেয়রের সাথে। তারা চিনে আমারেক। ঐ লেখকেক কেডা চিনে! না লিখেই এত! ভাগ্যিস তারা লেখেননি!
নাটোর সম্পর্কে দেশের লোকের ধারণা এই জেলাটি সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত। তা একসময় হয়তো ছিল। এখনকার পরিস্থিতি কী? একটা সত্যি ঘটনা বললেই উত্তর পেয়ে যাবেন সবাই। রশিদ চৌধুরী, রফিকুন নবী, আবদুস সাত্তারসহ সাতজন বড় চিত্রশিল্পী এসেছিলেন নাটোরে। আসলে উনারা এসেছিলেন রাজশাহী আর্ট কলেজে(এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ)। আর্ট কলেজের ছাত্র দুইজন বন্ধুর মাধ্যমে অনুরোধ জানিয়ে নাটোরে আধাবেলা সময় দেবার জন্য আমরা তাদের সম্মতি আদায় করতে পেরেছিলাম। তাদের নিয়ে অনুষ্ঠান চলছে মুসলিম ইনস্টিটিউটের ছোট হলঘরে। অনুষ্ঠানের মাঝখানে চা বিরতি আর আড্ডা। একজন বিখ্যাত, ক্ষমতাধর মহিলার স্বামী, তারা পুরো পরিবার সংস্কৃতি(!) করতেন, রফিকুন নবীকে জিগ্যেস করলেন, তা আপনাদের আর্ট ঠিক কী ধরনের আর্ট? ফাইন আর্ট নাকি মার্শাল আর্ট? চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক