Inside Outside Painting by Kari Sagal Allgire

Inside Outside Painting by Kari Sagal Allgire

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৪৭

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০১৯

কী নিষ্ফলা কেটেছে গত একটি বছর! নিষ্ফলা। বন্ধ্যা। এমন একটি পঙ্‌ক্তির কথাও মনে পড়ছে না যা নিয়ে সান্ত্বনা পেতে পারি। এক বছরে এমন কোনো লেখা লিখিনি যা নিয়ে বলতে পারি যে, আমি আমার লেখকসত্তার প্রতি সুবিচার করেছি। এমন বন্ধ্যাত্ব কেন আক্রমণ করল আমাকে? পরিবারে নতুন কোনো সমস্যার উদ্ভব হয়নি। গত সিকি শতাব্দী ধরে যেসব সমস্যা বয়ে চলেছি তার সাথে বাড়তি কিছু যোগ হয়নি। লঘু হবার কথা ছিল, সেটাও হয়নি। কিন্তু এটুকু সান্ত্বনাই তো অনেক যে বাড়েনি সমস্যা।

সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় গেছে বটে। কিন্তু খারাপ অবস্থার মধ্যেই তো লিখে আসছি আমরা। পেছন দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখতে পাই, এমন কোনো রেজিম ছিল না যে সময়ে রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মিথ্যাচার, মিথ্যা আশ্বাস, ধোঁকাবাজি, লুটপাট অনেক বেড়েছে। অনেক বেড়েছে অসাম্য। তবু যে রাষ্ট্রের অবস্থাই আমার কলমকে স্থবির করে দিয়েছে তা বোধহয় বলা যাবে না। কারণ একবছরে অবস্থার উন্নতি হবে এমন কোনো আশা মনের কোনো তলানিতেও ছিল না। যেহেতু আশা ছিল না, তাই আশাভঙ্গের ঘটনাটিও ঘটেনি। কবি আবুল হাসান শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে ‘কুরুক্ষেত্রে সংলাপ’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমি জানতাম হে অর্জুন তুমি পারবে না। শেফালির সোমত্ত গ্রীবায় লাগবে লম্পটের লালা ও বিষ। রিলিফের কাপড়ে তুমি যুবতীর ইজ্জত ঢাকতে পারবে না। অনাহারে অনেকেই যুবতী হয়েও আর যুবতী হবে না।’ (স্মৃতি থেকে এলোমেলোভাবে লেখা)।

আর এখন তো পারা না-পারার কথাটা তোলাই যায় না। করা-না-করায় এসে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরবন, তনু, পূর্ণিমা, নুসরাতদের সারি সারি ধর্ষিতা লাশের পাশে বসেই আমরা জীবনযাপন চালিয়ে যাই নির্বিঘ্নে। আমাদের খাদ্যে অরুচি হয় না, আমাদের সুনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে না। আজকের দিনটির সাথে আগামীকালকের দিনটির প্রতিযোগিতা চলে অবক্ষয়ের দিকে দ্রুততমভাবে কোন দিনটি বেশি ধাবমান। লোকে প্রবাদ আওড়ায়, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের জন্য কোনোদিন কোনো ভালো দিন ছিল না। সেই অবস্থার মধ্যেও তো আমরা লিখেছি। আমিও লিখেছি।

লেখক হিসাবে প্রণোদনার ঘাটতি ছিল না বছরজুড়ে। আমাকে উজ্জীবিত করার জন্য যথেষ্ট সাড়া এবং প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। একজন পাঠক অনেক দূর থেকে দেখা করতে এসেছেন। কেন? তার ভাষায় তিনি মাফ চাইতে এসেছেন। কীসের জন্য মাফ চাওয়া? এতদিন তিনি ‘পিতৃগণ’ উপন্যাসটি পড়েননি, সেটি তার কাছে পাপ মনে হয়েছে। তাই তিনি সেই পাপমোচন করে, অর্থাৎ বইটি পাঠ শেষ করে তবেই আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। লেখক আর কী চাইতে পারে!

অনেক দূরের মফস্বল শহর থেকে একজন তরুণী ইনবক্সে আমার ‘সূতানাগ’ গল্পটির পেপার কাটিং-এর ছবি পাঠিয়েছেন। সাথে লিখেছেন, এই গল্পটি তিনি মাঝে মাঝেই পড়েন। লেখক প্রণোদনার জন্য আর কী দরকার! ‘কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন’ পড়ে কওমী মাদ্রাসা থেকে পাশ করা একজন ইনবক্সে বললেন, কত ভুল তথ্য এবং মিথ্যা শেখানো হয় আমাদের! উত্তরে বললাম, শুধু ওখানে নয়, সব জায়গাতেই ভুল তথ্যই শেখানো হয়। সবগুলো ঘরানাই এক-একটি অচলায়তন। দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখা হয়, যাতে বাইরের উৎসাহী বাতাস, চন্দ্রালোকের আহ্বান কিছুতেই ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। আর এইভাবে শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, প্রতিটি মানুষই হয়ে ওঠে এক-একটি অচলায়তন। সে নিজের ভেতরে আলোড়ন তুলতে পারে এমন কোনোকিছু দেখলেই ভয় পায়।

ফেসবুকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেক পাঠক বিভিন্ন বইয়ের আলোচনা লিখেছেন গত এক বছরে। নারী-পুরুষ উভয়েই। কলকাতার একটি ছোট কিন্তু আন্তরিক প্রকাশক ওখানে ছেপেছেন ‘কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন’ বইটি। পাঠকের সাড়া পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি। সেই খুশি তো স্পর্শ করবেই আমাকে। ‘মুসলমানমঙ্গল’ মানুষ আরো অনেকদিন ধরে পড়বে, একথা মনে ছিল আমার প্রথম প্রকাশের সময়ই। একজন খুবই সম্মানীতা মহিলা ফোন করে কথা বললেন বইটি নিয়ে। বললেন, তিনি নিজে তো পড়েছেনই, আরো প্রায় ৩৫ জনকে কিনে উপহার দিয়েছেন বইটি।

একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ফেসবুকে জানান দেয় সে আমার উপন্যাস ‘কুরসিনামা’ পড়ছে। বইটা পেয়েছে তার এক শিক্ষকের কাছ থেকে। সেই ছাত্রী এবং সেই শিক্ষক কতখানি উৎসাহের উৎস তা কী বলে বোঝানো যায়! আমার বন্ধুভাগ্য অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। তারা কেউ লেখার জগতের, কেউ লেখার জগৎ থেকে দূরের। কিন্তু আমার কোনো কাজের জন্য তারা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কিছুই মানে না। তারা সবসময় বলে, তোমার কাজ লেখা। অন্য কোনো আয়োজন নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সেসবের জন্য আমরা আছি।

মুখের কথায় নয়, কাজ দিয়ে তারা প্রমাণ করে দিয়েছে বার বার। যতবার দরকার হবে, ততবার দেবে। আবার রাইটারর্স ব্লক নামের সাময়িক বা দীর্ঘমেয়াদী যে সমস্যা লেখকদের অনেকের জীবনে আসে, সেটাও যে আমাকে আক্রমণ করতে পেরেছে, তা-ও মনে করি না। কারণ মনের ভেতর সবসময় লেখা তৈরি হচ্ছে, যাচাই-বাছাই হচ্ছে, গ্রহণ-বর্জন হচ্ছে। ভবিষ্যতের লেখার জন্য তথ্য-উপাদান সংগ্রহের কাজ চলমান। পড়ছি গোগ্রাসে নানা ধরনের লেখা।

সবই তো উৎসাহব্যঞ্জক। তবে আমি কেন একবছর বন্ধ্যাত্ব-আক্রান্ত রইলাম? কেন মগজের ভেতরে ক্রিয়াশীল রচনাগুলিকে শব্দে-অক্ষরে রূপ দিতে পারছি না? নিজেই নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছি এই বলে যে আগামীকাল থেকে ঠিক শুরু করব। পরের দিন ভাবছি এই বেলাটা যাক, ঐ বেলা থেকে লিখতে শুরু করব। লেখকের জন্য সবচাইতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া কোনটি? বিছানা থেকে নিজেকে নামিয়ে লেখার টেবিল পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার পথটুকুই হচ্ছে দীর্ঘতম এবং সশ্রম পথ। এই পথ পাড়ি দিতে পারা মানেই, লেখার কাজে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া। এ তো আমি সেই তারুণ্যের শুরু থেকেই জানি। একা-একাই শিখেছি। পরে দেখেছি, অনেক বড় লেখকই নিজেদের ক্ষেত্রে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। নিষ্করুণভাবে নিজেকে বিশ্রাম এবং আলস্যযাপনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছি দশকের পর দশক। বিছানা থেকে নিজেই নিজেকে ঘাড় ধরে তুলে পাঠিয়ে দিয়েছি লেখার টেবিলে। গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-শিশুসাহিত্য-মুক্তগদ্যগুলো তো লিখিত হয়েছে সেভাবেই। তাহলে এখন কেন পারছি না? কেন প্রায় পুরো একটা বছর নষ্ট হয়ে গেল?

নিজের কাছে সৎভাবে প্রশ্নের উত্তরটা চেয়েছি। এমনকী আজ সারাটা দিনও। কোনো জোড়াতালির অজুহাত নয়। সত্যিকার কারণটা খুঁজতে চেয়েছি। উত্তর যেটাই হোক, আমি মেনে নেব। এমনকী তা যদি এমনও হয় যে, আমি ফুরিয়ে গেছি, সেটাও মেনে নিতে দ্বিধা করব না আমি।

অকস্মাৎ মনের গোপন থেকে উঠে এল একটি নতুন সম্ভাবনার বার্তা। বোধহয় খুব বড় কোনো বাঁক নিতে যাচ্ছে আমার লেখা। এই যে সাময়িক বন্ধ্যাত্ব, তার উৎপত্তি ঘটেছে প্রচলিত ধাঁচের আর কোনোকিছু আর না লিখার অনিচ্ছা থেকে। এই মুহূর্তে আমার কাছে বন্ধ্যাত্বকে আর বন্ধ্যাত্ব বলে মনে হচ্ছে না। বরং নতুন নির্মাণের চেতন-অবচেতন প্রস্তুতি মনে হচ্ছে। অতএব আরো কিছুদিন বেঁচে থাকা অন্যায় হবে না বোধকরি। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক