
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৪৮
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুলাই ০২, ২০১৯
জার্মান কবি হাইনে নিজের দেশে টিকতে পারেননি। জীবনের বেশিরভাগ সময় তাকে কাটাতে হয়েছে ফ্রান্সে। হাইনে মূলত গীতিকবি। জার্মান সরকারের এতে আঁতে ঘা লাগার কথা নয়। তবু হাইনে জার্মান সরকারের কাছে বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত হলেন। সরকারগুলো বোধকরি এই রকমই হয়। ফ্রান্সে পাকাপাকি বাস করছেন হাইনে। গীতিকবিতা দিয়ে মুগ্ধ করে রাখছেন পাঠকদের। একদিন আরো কয়েকজন কবিবন্ধুর সাথে শহরতলীর একটি পাব-এ গেলেন হাইনে। মনে কোনো কারণে বেশি ফুর্তি ছিল। পান করেছিলেন প্রচুর আসব। পাব-এ যে মেয়েটি পরিবেশন করছিল সে ছিল অত্যন্ত সুন্দরী। মাতাল হাইনে তাকে একপর্যায়ে জড়িয়ে ধরলেন। পাব-এ এসব হয়। পরিবেশনকারী মেয়েরা এই রকম পরিস্থিতিতে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার কৌশল জানে। কিন্তু এই মেয়েটি ছিল একেবারেই অন্যরকম ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। সে রীতিমতো রাগারাগি হৈ চৈ শুরু করে দিল। হাইনে এবং তার বন্ধুরা মাফ-টাফ চেয়ে কোনোক্রমে বেরিয়ে এলেন পাব ছেড়ে।
পরের সপ্তাহে বন্ধুরা আবার সেই পাব-এ যেতে চাইলে হাইনে সরাসরি বললেন তিনি যাবেন না। তবু বন্ধুদের চাপে যেতে হলো তাকে। পাব-এ ঢুকে মাথা নিচু করে বসে রইলেন কবি। গত সপ্তাহের ঘটনার জন্য মর্মে মরে আছেন। কোনো মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন না চোখ তুলে। যদি সেই মেয়েটির সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়! কিছুক্ষণ পরে তাদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল এক পরিবেশনকারিণী। সে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল হাইনের। হাইনে দেখলেন, এ তো সেই মেয়ে। মেয়েটি তাকে দেখে মধুর হাসি হাসল। বলল, মশিয়ে হাইনে, আমি আপনাকে চিনতাম না। কিন্তু আপনার কবিতা আমি পড়েছি। আপনি ইচ্ছা করলে এখন আমাকে আলিঙ্গন করতে পারেন। সবার সামনেই আলিঙ্গন করতে পারেন। চাইলে আমাকে চুমু খেতে পারেন। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, কবিতা আপনাকে লিখে যেতেই হবে।
আবেগে হাইনের চোখে জল এসে গিয়েছিল। কবিতা লেখা তাহলে অনর্থক কিছু নয়! নারী তো অলভ্য বা দুষ্প্রাপ্য নয়। ক্ষমতাশালীরা নানাভাবে নারীর সংস্পর্শ পায়। সেলিব্রেটিরা পায়। ধনবানরা পায়। কেউ বিখ্যাত হলে তার পাশে নারীদের কম-বেশি ভিড় জমেই থাকে। আর টাকা দিয়ে নারীর শরীর তো পাওয়া যায় সবখানেই। পৃথিবীর আদিমতম পেশা প্রায় চিরন্তন পেশায় পরিণত হয়েছে। কাজেই নারীর শরীর এখন আর অতি মূল্যবান কিছু নয়। কিন্তু নারীর ভালোবাসা তুলনাহীন। তলস্তয় সেই বিংশ শতকের শুরুতে নারীবাদীদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, তারা আর যা-ই করুন, নারীকে দয়া করে ভালোবাসতে ভুলিয়ে দেবেন না। কারণ নারী যেভাবে ভালোবাসতে পারে, পুরুষ তার কণামাত্রও পারে না।
বৈষয়িক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-পদের ক্ষমতা দিয়ে নারীকে পাওয়া আর কবিতার ক্ষমতা দিয়ে নারীর ‘ভালোবাসা’ পাওয়া যে মোটেই এক জিনিস নয়, তা সাধারণ বোধের মানুষও বুঝতে পারে। যে নারী হাইনের কবিতা পাঠ করে তাকে আলিঙ্গন দিতে চায়, সে তো আসলে কবিতাকে ভালোবেসে কাছে এসেছে। কবি জানেন এই ভালোবাসা নান্দনিক, শুদ্ধ, বিনিময়হীন। তাই তিনি নারীর ভালোবাসাকে প্রকৃতপক্ষে কবিতার প্রতি ভালোবাসা হিসাবেই দেখতে পান। আস্থা ফিরে পান কবিতার ওপর। তাই কবি-শিল্পীদের ভেতরের যে গর্ব, তা অন্যদের গর্বের তুলনায় ভিন্ন মাত্রার।
এই ভিন্নমাত্রার গর্ব অনেকসময় শিল্পীদের দুর্বিনীত করে তোলে। সেই বিনয়হীনতাও খুবই শৈল্পিক। পারস্যের কবি হাফিজ যে প্রিয়ার গালের একটি তিলের বিনিময়ে বোখারা-সমরকন্দ বিলিয়ে দেবার ঘোষণা দেন, তা অনেকেই প্রতীকী মনে করেন। আমি মনে করি তিনি সত্যিসত্যিই এই ঘোষণাটি দিয়েছিলেন। মানে তিনি সত্যিসত্যিই ‘মিন’ করেছিলেন। বোখারা-সমরখন্দের রাজনৈতিক অধিপতি কী মনে করবেন তা নিয়ে কবির কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কারণ সত্যিকারের কবি-লেখক-শিল্পী রাজকীয় ক্ষমতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে থাকেন।
বিটোফেন এবং গ্যেটে একবার হাঁটছিলেন একসাথে। একটা সংকীর্ণ গলির মধ্যে ঢুকে দেখলেন রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্য বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছেন। গ্যেটে রাজকীয় কেতায় অভ্যস্ত। তিনি একপাশে সরে দাঁড়ালেন রাজপুত্রদের জায়গা দেবার জন্য। কিন্তু বিটোফেন তেড়ে-ফুঁড়ে হেঁটে গলিটা পেরিয়ে গেলেন রাজপুত্রদের জটলাকে পাত্তা না দিয়ে। গলির মাথায় গিয়ে তিনি অপেক্ষা করলেন গ্যেটের জন্য। গ্যেটে কাছে এলে বিটোফেন রাজপুত্রদের প্রতি তাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত করে যা বললেন, সেই বাক্যটি এখন ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘এরা কারা? আপনি-আমি দেবদূত। আমাদের কাজ মানুষকে স্বর্গলোকের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া।’
আমরা কবে সেই দুর্বিনয়ের যোগ্য হয়ে উঠব? চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক