রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৪৯

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুলাই ০৫, ২০১৯

মৌলবাদ শব্দটি আমরা ব্যবহার করি ইংরেজি ফান্ডামেন্টালিজমের প্রতিশব্দ হিসাবে। শব্দ হিসাবে ফান্ডামেন্টালিজমের বয়স খুবই কম। ১৯৫০ সালের আগে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে এই শব্দটি ছিল না। কিন্তু সমাজে, রাষ্ট্রে, বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক কাল আগে থেকেই বিরাজ করত মৌলবাদ। জোসেফ প্রিস্টলি ১৭৭৪ সালে অক্সিজেন আবিষ্কার করার কোটি কোটি বছর আগেও প্রাণীরা অক্সিজেন গ্রহণ করেছে প্রশ্বাসের সাথে। তেমনই মৌলবাদ শব্দটি আবিষ্কৃত হওয়ার শত শত বছর আগে থেকেই মানুষ নিশ্বাস নিচ্ছে মৌলবাদের বিষাক্ত বাতাসে।

জেনে অবাক হতে হয় যে, আধুনিক মৌলবাদের সাংগঠনিক উৎপত্তি প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের দ্বারা। এবং সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। যে খ্রিস্টান ধর্মকে বিশ্বে উদার ধর্ম হিসাবে পরিচিত করার প্রপাগাণ্ডা সবচেয়ে বেশি, আর যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তুলে ধরা হয় বিশ্বের সবচাইতে উদার মুক্তমনা দেশ হিসাবে— তারাই এই সাংগঠনিক মৌলবাদের হোতা। ১৮৭৬ সালে ম্যাসাচুসেটস-এ সাংগঠনিকভাবে যাত্রা শুরু করে প্রটেস্ট্যান্টদের মৌলবাদী সংগঠন। আর ১৯১০ সালে এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। মূল উদ্দেশ্য ছিল, ডারউইনের বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করা। তারা বাইবেলের পাঁচটি বিষয়কে অলঙ্ঘনীয় বলে ঘোষণা করে। ১, জেনেসিস বা সৃষ্টির অধ্যায়। ২. অলৌকিকত্ব। ৩. ভার্জিন মায়ের গর্ভে খ্রিস্টের জন্ম। ৪. খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়া। ৫. ক্রুশে মৃত্যুর পরে খ্রিস্টের শারীরিক পুনরুত্থান। এই মৌলবাদীরা প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে রাজি নয়। তারা দাবি জানায় যে, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ানো যাবে না। কারণ এটি বুক অফ জেনেসিসের সাথে সাংঘর্ষিক। সেই আন্দোলন এখনো চলছে।

মৌলবাদের উৎস নিহিত আছে ‘বিশ্বাসের অভ্রান্ততা’র মধ্যে। সেই কারণে বলা চলে কেবল ধর্ম নয়, অনেক মতবাদও আংশিক মৌলবাদী রূপ পরিগ্রহণ করেছে। মৌলবাদী সে-ই যে নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষমতা হারিয়েছে। গুরু, পীর বা ওস্তাদের কাছ থেকে পাওয়া কয়েকটি সিদ্ধান্তই তার জীবনকে পরিচালনা করে। সে অন্য কোনো কথা বিশ্বাস তো দূরের কথা, শুনতে পর্যন্ত রাজি নয়। মূর্খতাই শুধু নয়, মূর্খতাকে গৌরবজনক মনে না করলে পুরোপুরি মৌলবাদী হওয়া যায় না। আদর্শবাদ আর মৌলবাদ এক জিনিস নয়। আদর্শবাদী পরিস্থিতি ও যুক্তির বিচারে বার বার যাচাই করে নেয় আদর্শকে। কিন্তু মৌলবাদী সে ব্যাপারে নির্বিকার। সেই জন্যই বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন, প্রতিটি আদর্শবাদীই আসলে ভেতরে ভেতরে কিছুটা সংশয়বাদীও বটে। এই সংশয়ই তাকে যে কোনো কথা বা তত্ত্ব নির্বিচারে মেনে নিতে বাধা দেয়। তাকে মুক্তমনা করে তোলে।

বিশ্বজুড়ে প্রপাগাণ্ডার জোরে আজ মুসলমানরাই একমাত্র মৌলবাদী প্রাণী হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। দেড়শো কোটি মুসলমানদের মধ্যে কতজন মৌলবাদী তার হিসাব কেউ করেনি। তার কারণ হচ্ছে ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে বিশ্বের মুসলমানদের তুলনামূলক মূর্খতা। গান্ধীকে একজন জিগ্যেস করেছিল, তোমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করো কেন? গান্ধী উত্তর দিলেন, ইংরেজ করায় বলে। আবার প্রশ্ন এলো, ইংরেজ করায় বলেই তোমরা করো কেন? গান্ধী উত্তর দিলেন, আমরা মূর্খ বলে।

মুসলমানদের বিরাট এক সমস্যা কোরআনের ব্যাখ্যা। যুক্তিবাদী মুসলমানরা বলেন, কোরআনের বিভিন্ন আয়াত বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নাজিল হয়েছিল। কোনো কোনো আয়াত আবার পরবর্তীতে অ্যামেন্ডমেন্টও করা হয়েছে। সেই কারণে শানে নুজুল বা কোন পরিস্থিতিতে কোন আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল তা না জেনে পালন করতে গেলে ভুল করার আশংকা থাকে। কখনো জেহাদকে শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা অর্থে বলা হয়েছে, কখনো বলা হয়েছে নিজের খারাপ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে। বরং বলা হয়েছে নিজের খারাপ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই হচ্ছে বড় জেহাদ (জেহাদে আকবর)। ওদিকে রক্ষণশীল এবং মৌলবাদী ঘরানার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে, কোরআনকে যদি কোনো সময় বা স্থানের সীমায় আবদ্ধ করা হয় তাহলে তা যে শাশ্বত, সর্বকালে সর্বদেশের মানুষের জন্য প্রযোজ্য এই কথাকে অস্বীকার করা হয়। কোরআনকে আংশিক মান্য করা হলে সে তো পরিপূর্ণ মুসলমান হতে পারে না।

শেষের যুক্তিতে সাধারণ মুসলমান ধোঁকা খেতে বাধ্য। তবে মৌলবাদী বা সশস্ত্র জেহাদিরাও যে কোরআনের বিশেষ বিশেষ অংশতেই জোর দিয়ে নিজেদের বৈধতা দিতে চাইছে, এটা তাদের নজরে পড়ে না। আমরা দাবি করি যে, ইসলামি মৌলবাদীরা ভ্রান্ত। তারা যে ভ্রান্ত তা তাদের কর্ম এবং ফলাফলই বলে দেয়। সার্বিকভাবে মানুষকে প্রস্তুত না করে কোনো ব্যবস্থা তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর লোককে হত্যা করে তাকে নিজের পথে আনা যায় না। সমাজেরও কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো যায় না। যেমন নকশালরা কিছু জোতদারের গলা কেটে কৃষিবিপ্লব ঘটাতে পারেনি।

মুসলিমদের গলায় একচেটিয়াভাবে মৌলবাদী জঙ্গি তকমা যারা ঝুলিয়ে দিয়েছেন, তাদের একটি বড় যুক্তি হচ্ছে কোরআনের মধ্যেই নিহিত আছে সহিংসতার উৎস। কিছু আয়াতের উল্লেখ করেন তারা। যেখানে শত্রুদেরকে সরাসরি হত্যা করার নির্দেশ রয়েছে। অতএব কোরআন একটি জঙ্গি পুস্তক। আমি স্বীকার করি এই অভিযোগ সত্য। তবে এই অভিযোগ কেবলমাত্র কোরআন নয়, অন্য ধর্মগ্রন্থগুলির ব্যাপারেও কম-বেশি প্রযোজ্য। ইহুদি ধর্মগ্রন্থগুলো পড়ে দেখুন। সেখানে অন্য ধর্মের এবং জাতির ওপর আক্রমণ করার কত নির্দেশ রয়েছে। এবং তারা সেগুলি পালন করেই যাচ্ছে। বিশেষ করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। তফাৎ হচ্ছে, তারা সেগুলোর মতো করে বিশ্বজনমতকে প্রস্তুত করে নিয়েছে। আর আমাদের প্রতিবেশী হিন্দু ধর্মপুস্তক কী বলে? ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিমদের মতো হিন্দুদের কোনো একক ধর্মপুস্তক ছিল না। এখন হিন্দুরা গীতা-কে সেইস্থানে বসাতে চাইছেন। সেই গীতা কী? অর্জুন যাতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নেন, এবং আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করেন, তার জন্য আবেগ, যুক্তি, পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ যে বিশাল বাণী প্রদান করেন, সেটাই গীতা। তার উৎপত্তিই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ময়দানে। গীতা তবু জঙ্গি উদ্বুদ্ধকরণকারী পুস্তক নয়?

আমি এই রকম একচক্ষু হরিণদের জন্যই ‘মুসলমানমঙ্গল’ লিখেছিলাম। মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষকে যেমন লড়াই করতে হবে ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে, তেমনই অন্য সব ধর্ম ও মতবাদের মৌলবাদীদের বিরুদ্ধেও। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক