গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৫০

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুলাই ০৬, ২০১৯

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ আর তার উপন্যাস ‘শতবর্ষের নির্জনতা’ রচনা-সংক্রান্ত গল্পটি অনেকেরই জানা। সেই যে মার্কেজ কুড়ি বছর ধরে তার বন্ধুদের বলে আসছিলেন তিনি এই রকম একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করবেন অচিরেই। এক বছর, দুই বছর, পাঁচ বছর ধরে শুনতে শুনতে বন্ধুরাও ধরেই নিয়েছিলেন যে, মার্কেজ কেবল লিখতে শুরু করার কথাই বলে যাচ্ছেন। শুরু আর করছেন না। তারা হয়তো লিখতে বসার জন্য বন্ধুকে তাগাদা দেওয়াটাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। হয়তো তারা ভাবছিলেন যে, মার্কেজ তাদের, এবং নিজেকেও, সান্ত্বনা দিয়েই যাচ্ছেন কেবল। প্রতিশ্রুত উপন্যাসটি আর কখনোই হয়তো লেখা হয়ে উঠবে না। হয়তো মার্কেজ নিজেই এমন একটি উপন্যাসের স্বপ্ন দেখেছেন যা লেখার সক্ষমতা তিনি অর্জন করে উঠতে পারেননি। ভবিষ্যতেও পারবেন কি না সেটাও অনিশ্চিত। তাই বন্ধুরা সেই স্বপ্নের উপন্যাস নিয়ে মার্কেজকে প্রশ্ন করাটাও হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন। তবু কিছুদিন পর পর মার্কেজ বলতেন, তিনি সেই উপন্যাসটি একদিন লিখবেন। বন্ধুদেরকে বলতেন মাঝে মাঝে। আর হয়তো নিজেকে বলতেন প্রতিদিনই, প্রতিমুহূর্তেই। কিন্তু লেখা শুরু করতে পারছিলেন না।

সেই দিনটি এলো কুড়ি বছর পরে। কয়েক বন্ধু মিলে যাচ্ছিলেন পিকনিকে। হঠাৎ-ই রাস্তার একটা বাঁকে এসে মার্কেজ বললেন, আমাকে নামিয়ে দাও। আমি যাব না তোমাদের সাথে।
কেন?
আমি লিখতে শুরু করব আমার উপন্যাস।
তারপর একটানা ১৮ মাস মার্কেজের দেখা পায়নি কেউ। বাইরে বের হতেন না মার্কেজ। অফিসে যাওয়া বন্ধ। কারো টেলিফোন ধরা বন্ধ। উপার্জন বন্ধ। কী খাবেন বা কীভাবে খাবেন, সেই চিন্তাও বন্ধ। সেই ভার ১৮ মাস ধরে বহন করতে হয়েছে তার স্ত্রীকে। জমানো টাকা শেষ। মূল্যবান যা কিছু বিক্রি করা যায়, সেগুলো বিক্রি করা শেষ। যত জনের কাছে ধার চাওয়া সম্ভব, তাদের সবার কাছে ধার গ্রহণ করা হয়েছে। আর কেউ বাকি নেই যার কাছে হাত পাতা যায়। ঘরের আসবাবপত্রও বিক্রি করা শুরু হয়েছে। তবু মার্কেজের লেখার ধ্যান যাতে না ভাঙে সেদিকে তীক্ষ্ন লক্ষ রেখে দিন পার দিচ্ছেন স্ত্রী। মার্কেজের টেবিলে কফি আর চুরুটের অঢেল সরবরাহ যাতে বন্ধ না হয় তার জন্য নিজে উপোস দিচ্ছেন কোনো কোনো বেলাতে।

অবশেষে ১৮ মাস পরে চুরুট-তামাকের ধোঁয়াভর্তি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। সঙ্গে ‘শতবর্ষের নির্জনতা’র পাণ্ডুলিপি এবং ফুসফুসের ক্যান্সার। (এই সংক্রান্ত বিবরণ পাঠক আরো সুন্দর এবং পরিষ্কারভাবে পাবেন আমাদের বন্ধু আনিসুজ্জামানকৃত মূল স্প্যানিস থেকে বাংলায় অনূদিত বইটিতে। আনিস কেবল যে বইটি মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করেছেন তা-ই নয়, বরং মার্কেজের জন্মস্থানসহ স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলোতে গেছেন, মার্কেজের রচনার সাথে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মিলিয়ে নিয়েছেন সেইসব স্থানের বাস্তবতাকে বা জাদুবাস্তবতাকে। সেইসাথে বলে রাখি জিএইচ হাবিব এবং শাহাবউদ্দিন আহমেদের অনুবাদ দুটিও খুব মানসম্পন্ন বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। তবে তারা অনুবাদ করেছেন ইংরেজি থেকে।)

‘শতবর্ষের নির্জনতা’ লেখার এই চিন্তা, তা লেখা শুরু করা, এবং লেখা সম্পন্ন করার এই ঘটনাগুলো থেকে আমরা যা শিখতে পারি তা হচ্ছে, একটি উপন্যাস লিখতে চাইলেই তা তক্ষুণি লিখে ওঠা সম্ভব হয় না সবসময়। এমনকী লেখা শুরু করতেও দুই দশক দেরি হতে পারে। কারণ লেখাটি লেখকের করোটির মধ্যে চেতন-অবচেতন মিলিয়ে পরিপূর্ণ অবয়ব পেতে সময় লেগে যেতে পারে অনেক। তাই সময় হবার আগে যদি উপাখ্যানটি লেখক নামিয়ে ফেলেন গ্রন্থাকারে, তা অকালপ্রসবিত সন্তানের মতো রক্তশূন্যতা, বাতাসশূন্যতা এবং জীবনীশক্তির শূন্যতায় ভুগে অকালমৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে পারে। লেখকের জন্য অপেক্ষার কোনো বিকল্প নেই। লেখাটি মনের মধ্যে দাঁনা বেঁধে ওঠার জন্য যেটুকু সময় দরকার, সেটুকু দিতেই হবে। সেই অপেক্ষা কোন্ লেখার জন্য কতদিন বা কতমাস বা কত বছর তা বলে দিতে পারে কেবলমাত্র লেখকের ভেতরের লেখকসত্তাই। এমনও তো হতে পারত যে মার্কেজ জীবিতকালে সেই উপন্যাস শুরু করার সংকেত না-ও পেতে পারতেন। পারত। কারো কারো ক্ষেত্রে যে এমনটি ঘটেনি তা-ও নয়। আমাদের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে যে উপন্যাসটি লিখতে চেয়েছিলেন, তা লিখে যেতে পারেননি। জানতেন যে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার হাতে সময় বেশিদিন নেই। তবু তিনি অপেক্ষা করছিলেন উপন্যাসটি মনের মধ্যে দানা বেঁধে ওঠার জন্য। তড়িঘড়ি করে আখ্যানটিকে অক্ষরে রূপ দিতে গেলে তা যে স্রষ্টা, অর্থাৎ ইলিয়াসের, মনের মতো হবে না, সেটুকু বোঝার মতো সাহিত্যিক পরিপক্কতা ইলিয়াসের ছিল। (বেশিরভাগেরই থাকে না)। আমাদের দুর্ভাগ্য ক্যান্সার তাকে সেই সময়টুকু দেয়নি।

আর এই যে উপন্যাসটি লেখার জন্য মার্কেজ ১৮ মাসের নির্জন ধ্যানমগ্ন একাকিত্ব মেনে নিলেন, তার পেছনের কারণ কী? ছয়শো পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস লিখতে ১৮ মাস সময় লাগার কথা নয়। প্রতিদিন পাঁচ পৃষ্ঠা করে লিখলেও তাতে সময় লাগার কথা ১২০ দিন বা চার মাস। বড়জোর ছয় মাস। কিন্তু তারচেয়ে তিনগুণ সময় কেন লাগল? ধারণা করতে পারি, এতটা সময় লেগেছিল উপন্যাসের আখ্যানটিকে ঠিক কোন অবয়ব দান করলে তা হবে সবচাইতে লাগসই, সেটি খুঁজে বের করতে। স্টোরি টেলার হিসাবে মার্কেজ আগে থেকেই বিশ্বসেরাদের একজন। কিন্তু ‘শতবর্ষের নির্জনতা’ লেখার সময় ঠিক কোন ধরনের গদ্যে তিনি গল্পটি বলবেন সেটিও বেছে নিতে হয়েছে তাকে। কোন অধ্যায়ে কোন বাক্যে কোন শব্দটি প্রয়োগ করতে হবে, সেই কঠিন বাছাইপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হয়েছে তাকে। অথবা অজস্র শব্দের মধ্যে অসংখ্যবার ডুব দিয়ে দিয়ে সঠিক শব্দটি তুলে আনতে হয়েছে তাকে।

উপন্যাসটি লেখা শুরুর আগের কুড়ি বছরে মার্কেজ অনেক ধরনের লেখা লিখেছেন। গল্প লিখেছেন, রিপোর্টাজ লিখেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন, পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। উপন্যাসও লিখেছেন। বহুচর্চিত বিষয় নিয়েও উপন্যাস লিখেছেন। যেমন ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’। প্রত্যাশিত চিঠি বা সুসংবাদের অপেক্ষায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করার গল্প ইংরেজি এবং বাংলাভাষাতেও লেখা হয়েছে একাধিক। নিজস্বতাচিহ্নিত হলেও এই ধরনের উপন্যাস মার্কেজের প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু যে উপন্যাস নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন কুড়ি বছর যাবত, সেই উপন্যাসে বিন্দুমাত্র শিথিলতার অবকাশ রাখেননি মার্কেজ।

আমার নিজের স্বপ্ন ছিল একদিন শুধু চোখের দেখা দেখতে যাব মার্কেজকে। এটাও ঠিক করে রেখেছিলাম যে তার জন্য উপহার হিসাবে নিয়ে যাব বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’। এই উপন্যাস বেছে নেওয়ার কারণ একটাই। বাঙালির দারিদ্র্যভরা জীবনও যে পুরোপুরি রুক্ষ্ন হয়ে যায় না, বরং সবুজতা সজলতা ধরে রাখে, তা দেখানো। মার্কেজের কাছে নিশ্চয়ই এই আবিষ্কার নতুন মনে হবে।

কিন্তু মৃত্যু তাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে অনতিক্রম্য দূরত্বে। মেক্সিকো বা কলম্বিয়া বা কিউবা অনেক দূর। কিন্তু তা অতিক্রম করা যেত। মৃত্যুর ওপারে তো যেতে পারব না নিজের মৃত্যুর আগে। সেই দুঃখ লাঘব করার চেষ্টায় তার মৃত্যুর পরে একটি গল্প লিখেছিলাম ‘গাবোর সাথে বারানকিয়ায়’ নামে। টাইম এবং স্পেস ভেঙে গল্পের মাধ্যমে সাক্ষাৎ করেছিলাম গাব্রিয়েল মার্কেজের সাথে। হাতে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ও ছিল। কিন্তু সে তো আমার মনোভ্রমণই। তা দিয়ে বাস্তবের অতৃপ্তি দূর হয় না। হয়নি। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক