আলোকচিত্রী: রুদ্র আরিফ

আলোকচিত্রী: রুদ্র আরিফ

রথো রাফির ৬ কবিতা

প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০২০

প্রশ্নমন্দির

প্রশ্নমন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে দূর থেকে।
মনোযোগ দিয়ে শোনো। ভক্তির নয়, প্রশ্নের এ ঝরণায়
স্নান করে নাও। তাহলে হয়তো-বা বুঝতে পারবে—
কখন বাতাসে ফুটে উঠবে ওই রক্ত মেঘের আলপনা।

না হলে বোকার মতো ফের ভাবতে চাইবে তুমি
সবই চিরকাল বসন্ত বাতাস! আর
তারুণ্যের তাপে চোখ মেলবে, কিন্তু মিলবে না
তোমার ভাবনার সঙ্গে চারপাশের এ জগৎ!

আগের মতোই কেঁদে উঠবে তুমি, কিন্তু আগের
মতোই বাতাসে মিলবে না কোনো সাড়া।

ভুলে যাবে তুমি বাতাসের প্ররোচনায় কতকিছু।
ভুলে যাবে তুমি এই সেই বাতাস—
গাছকে যা রঙিন করে তোলে। আর
ভুলিয়ে দিতে চায়— সেই ফের কেড়ে নেয় সমস্ত সবুজ।

এই সেই বাতাস যা স্নান করায় পৃথিবীকে কত
শতবার আগের মতোই নতুন করবে বলে।
যা ফের এ মাতৃ-পৃথিবীকে মর্চে ধরা বালির
চাদরে ঢেকে ফেলে। আর কী যে নির্বিকার বয়ে চলে।

প্রশ্নমন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে দূর থেকে।
মনোযোগ দিয়ে শোনো। তাহলে হয়তো বুঝতে পারবে—
কখন ছাতা দরকার হয় মানুষের, আর কখন দরকার
ছাদ। আর কারা ঝুঝেও না বোঝার ভান করে চলে।

তখন তুমিও হয়তো বুঝতে পারবে কখন ভাতের
থালায় ফের ভাত নয়, ডেকে ওঠে কর্ণফুলির সেই ব্যাঙ!
                                                    ৭.৭.২০২০

প্রশ্ন

প্রশ্ন করো প্রশ্ন করো এবং প্রশ্ন করো
নতুন প্রশ্ন মানে নতুন উত্তর

প্রশ্ন করো নিজেকে
নিজের চিন্তাকে
প্রশ্ন করো নিজের কাজকে
প্রশ্ন করো প্রতিটি বস্তুকে
পাখিকে পাথরকে
গাছকে হাঁসকে
প্রান্তরকে পাহাড়কে
প্রশ্ন করো একে ওকে তাকে
প্রশ্ন করো প্রশ্ন করো
প্রশ্ন করো ভাষার
নীল নকশাকে প্রতিটি শব্দকে

প্রশ্ন করো প্রশ্ন করো
আর মনে রেখো
প্রশ্ন হতে পারে আত্মঘাতী
হতে পারে অদৃশ্য আততায়ী
হতে পারে প্রকাশ্য খুনি
এমনকি হতে পারে
অনিচ্ছুক প্রাণ সংহারী
হতে পারে আরও কত কিছু
কিন্তু তুমি প্রশ্ন করো

প্রশ্ন করো প্রকাশ্যে
প্রশ্ন করো এমনকি মনে মনে
প্রশ্ন করো এমনকি সাধ্যের
শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে
কিন্তু প্রশ্ন করো

প্রশ্ন করো প্রতিটি উত্তরকে
প্রতিটি স্বস্তিকে
এবং প্রতিটি গোপন দুঃখকে
প্রতিটি ক্ষতকে প্রতিটি স্বপ্নকে
ক্ষমতাকে অক্ষমতাকে
প্রশ্ন করো রীতিকে
ভীতিকে ভ্রান্তিকে
প্রশ্ন করো প্রতিটি প্রশ্নকে

প্রশ্ন করো প্রশ্ন করো
প্রতিটি প্রশ্নকে হত্যা করতে
প্রশ্ন করো আরও হাজারো
নতুন প্রশ্ন উস্কে তুলতে
হয়তো শত শত
হাজার হাজার প্রশ্নের নিচে
চাপা পড়ে যাবে তুমি
কিন্তু প্রশ্ন করো

প্রতিটি নতুন প্রশ্ন মানে
নতুন দরজা
হয়তো কোনো নতুন পথের
প্রতিটি নতুন প্রশ্ন মানে
নতুন জানালা
হয়তো আদিগন্ত নতুন দৃশ্যের

হয়তো প্রশ্নই হ্যামিলনের
সেই বাঁশিঅলা
যে তোমাকে বাঁচাতে পারে
তার বাঁশির সুর থেকে
প্রশ্নহীন নিহত হওয়া থেকে
কিংবা নিদারুণ
হারিয়ে যাওয়া থেকে

প্রশ্নই হয়তো সেই আলাদীনের দীপ
প্রশ্নের জাল ফেলে ফেলে
হতাশ হতে হতে অবশেষে যাকে
সমুদ্র ছেকে তুলে এনেছো
যা তোমার চির-অন্ধকার পথকে
হয়তো দিতে পারে ফের
একটুখানি আলোর বিভ্রম

নিরুত্তর দিন

সংশয় দাবি করে শুধু বিশ্লেষণ, কখনও একাত্ম হতে দেয় না।
আর ফলও ভিন্ন কিছু নয়, অবশেষে পাঠকের জিভ থেকে
সেই আগের মতো খসে পড়ে— `ভালো, তবে ভালো লাগে না!`

আবিশ্ব প্রিয় কিছুর দিকে ছুটে ছুটে না পেয়ে অভিজ্ঞরা ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত
কিংবা তরুণেরা অভিজ্ঞতার দিগন্তে হারিয়ে যায়নি এখনও
তাই তারা সবাই যেন প্রশ্নের দিকে কেমন ঘৃণার চোখে তাকায়,
যেন ভাবে— একাত্মতার একটু সুযোগ এখানেও নেই!
ওফ কবিতা, তোমার রূপ দেখতে এসেছি, একটা চুম্বন পেতে
এসেছি, কিন্তু এ কী করো তুমি! গোলাপের রঙিন স্বরে
ডেকে ডেকে এনে কেন দেখাও এই অসহনীয় কাঁটার প্রাসাদ,
সিঁড়ির প্রতি ধাপে কাঁটা আর কাঁটা! আমিতো অনেক দূর থেকে
গোপন কাঁটা বিছানো পথ পায়ে পায়ে রক্তিম করে এসেছি,
দেখো আহত পা দুটি এ সিঁড়ি আর সহ্য করতে পারছে না!`

আমি মনে মনে বলে উঠি, `ওওফ! আবারও সেই সজারুর জন্ম দিলাম!`
আর মনে মনে কেঁদে উঠি, `কবিতা, কবিতা, আমাকে আবারও ক্ষমা করো!`

কিন্তু একটু পরেই তার কানে কানে আমি ফের সেই পুরোনো প্রশ্ন করি—
`বলো তো, সাগরে পড়ে যাওয়া লোক ক্লান্ত হয় যদি, জীবন তাকে ক্ষমা করে কি?`
জবাবের আশায় বসে থাকি, কিন্তু কবিতা সেই আগের মতোই নিরুত্তর!

আমার এই শহর

লি পো, তুমি তো দূর পাহাড়ে ছিলে।
আশপাশে ছিল না কেউ।
তাই নিঃসঙ্গবাস ছিল তোমার বড় চেনা।
আর এত তীব্র ছিল তা
মদের পেয়ালা হাতে
তোমার ছায়া আর চাঁদ মিলে
তুমি তিনজন হতে বাধ্য হয়েছিলে!

লি পো, তুমি যদি জানতে
আমি যে শহরে থাকি
পকেটের দুর্বলতাবশত সেখানে
এক রুমে চার-পাঁচজন থাকি
আর দরজা খুলে রাস্তায় নামলেও
মানুষ এত গিজগিজ করে
যে বুকে পিঠে লেগে যায়!

লি পো, তুমি যদি জানতে
এ শহরে প্রতিটি মানুষ কত যে নিঃসঙ্গ
টিকেট কেটে শিল্পী ভাড়া করে খোলা মাঠে
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই গান গায়
নিঃসঙ্গতার গান
গায়ক সে বিষাদের ঝর্ণামাত্র
পান করে করে মাতাল হয় আর
নাচে বিষণ্ণ মানুষেরা!

লি পো, তুমিতো মদে মিলিয়ে যেতে কিছু সময়
এ শহরে কারো মদেও আস্থা নেই।

ভেসে যাচ্ছে এক টুকরো মেঘ

দক্ষিণ আকাশ থেকে উত্তর আকাশে ভেসে যাচ্ছে
সাদা এক টুকরো মেঘ
রাতের নীলচে কালো এ আকাশের তুলনায় কত ছোট
যেন ধীরে ধীরে ভেসে চলেছে
হাঁটার ভঙ্গিতে থাকা সাদা তুলোর একটি মুরগি ছানা

আমি তাকে আর দেখতে পাব না
সুবিস্তৃত অন্ধকার আকাশ
আজ রাতে আমাকে শুধু এ কথাই বলে গেল

আজ বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি
এই মাঝরাতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি
আমি কখনও আর তাকে দেখতে পাব না

মন্বন্তরের আভাস দিচ্ছেন পণ্ডিতেরা
আমারও অনেক গরিব স্বজন রয়ে গেছে পৃথিবীতে
আর আমিও আগের মতোই গরিব

পথেঘাটে কে কখন কিভাবে মরে পড়ে থাকবে কে জানে
আমার চোখে হয়তো আর অশ্রুও দেখা দেবে না

পশ্চিম আকাশ ঘেঁষে তাকে ভেসে যেতে দেখছি আমি

আমার মনে পড়ছে কতদিন আমি
কারো বাড়ি যাই না
কতদিন হলো কত জনের খবর আমি নেই না
আরও অনেকের মতো
তবুতো আমার মন শব্দহীন কেঁদে ওঠে

মৃত্যু মাত্র কত না মুখ ভেসে আসে আজকাল
আমার এই ভার্চুয়াল আকাশে

আর হারানোর খবর পেয়ে কেমন চুপচাপ
বারান্দায় এসে আমি একটু সময় দাঁড়িয়ে থাকি

পশ্চিমের এই বিস্তৃত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি
দেখতে থাকি দক্ষিণ থেকে উত্তরে ভেসে চলে এক টুকুরো মেঘ

ট্রাজেডি

 

সরলতা ট্রাজেডি। জটিলতা ট্রাজেডি।

গভীরতা ট্রাজেডি। অগভীরতাও ট্রাজেডি।

সংঘ ট্রাজেডি। সঙ্গহীনতাও ট্রাজেডি।

সামষ্টিকতা ট্রাজেডি। ব্যক্তিকতাও ট্রাজেডি।

আশা ট্রাজেডি। হতাশাও ট্রাজেডি।

প্রেম ট্রাজেডি। প্রেমশূন্যতাও ট্রাজেডি।

আনুগত্য ট্রাজেডি। বিদ্রোহও ট্রাজেডি।

স্বর্গ ট্রাজেডি। এবং নরকও ট্রাজেডি।

ক্ষমতা ট্রাজেডি। অক্ষমতাও ট্রাজেডি।

পার্থিবতা ট্রাজেডি। এবং অপার্থিবতাও ট্রাজেডি।

পূর্ণতা ট্রাজেডি। অপূর্ণতাও ট্রাজেডি।

এমনকি শূন্যতাও ট্রাজেডি।

 

........................................

আর কমেডি?
হ্যাঁ, এটাও ট্রাজেডি।