রাগীব হাসানের ৫ কবিতা

প্রকাশিত : জুলাই ১৫, ২০২০

কোনো ক্রোধ নেই

আমি দীপাধারকে বুঝি ব্যথাদীর্ণ ভঙ্গিমায় চেয়ে রয়েছে
আর বারান্দার উঠোনের টবের ফুল রাত্রির তুমুল ঝড়োবাতাসে ঝরে পড়ে আছে
কোনো কান্না দক্ষিণ দিক থেকে এসেছিল, দূরের স্থাপত্যের চূড়ার পতাকা শতচ্ছিন্ন হলো
জানলার পাশে মুখ রেখে কে বলে গেল কে বলে গেল, তার সন্ধানে ঘুমন্ত
বাজারের দিকে ছুটবে—
আশ্চর্যই বলা যায়, বিদ্যুতের চলে যাবার প্রেক্ষিত ছিল না—
তবু সে চলে গেল, পুকুর কত নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে

রাস্তার পাশের জানলা কি বলে দেয়, বিদ্যুৎ নেই তো কি হয়েছে
মোম রয়েছে, তার প্রজ্জ্বলন শিখায় অক্ষর ভেসে উঠবে
দীপাধার, আকাশ-সমুদ্রে ভেসে ভেসে অগ্নিবল হয়ে
নেমে আসবে শ্যামল কোনো ঝোপ-জঙ্গলের পাশে
সুনিন্দ্রা বলে যাবে তার কোনো ক্রোধ নেই, কোনো মুখকেই সে
পাংশুটে করে যাবে না, যুগল হয়ে পাশাপাশি শুয়ে থাকবে।

বিষণ্ণ মধ্যাহ্নে

বিষণ্ণ মধ্যাহ্নে পদরেখা জ্বলছে
তমালছায়া, অটোরিক্সায় চড়ে যাত্রীগণ
সূর্যনগরের দিকে ধাবমান— মেঘ উড়ে এলো
সাবমেরিন আকারে
একটি ঘনপত্রছায়া বিদ্যুতে জ্বলে গেল
এসো, বর্ষণ মরুদ্যান ভিজে যাক, ওই অক্ষিগোলক
বহুবার অশ্রুপাতে ভেসে গেছে, আয়না কার প্রতারণার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে?

লোহার পাতের তোরঙ্গ

তোরঙ্গ নির্মাণ হয় ধুলোর ওপর
কেউ প্রায় জনশূন্য পথে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে গেল
পাখির নাম বাজিকর, আর তাদের হরিৎবর্ণ শরীর দেখে—
তাদের শীৎকার ভাস্বর হয়ে ওঠে, আকাশযানকে নিচে
নামিয়ে আনে, সর্বদাই বাজিকর মন্ত্র ছুঁড়ে দেয়, গোপন
পুস্তিকা কি শুধু মন্ত্রগুপ্তি ধারণ করে, যন্ত্রণা, জ্বালা, ক্ষোভ—
বনপথের পাশের বনবিভাগের কর্মীদের অনিন্দ্রা, কামবাসনা
তাদের শয়ন কক্ষের স্যাঁতসেঁতে নক্ষত্রের আলো বহন করে কী?
সেনারা এই পথ দিয়ে কবে এসেছিল, ঝুমবৃষ্টিতে তারা দেখতে পেল
শাদা করোটি ব্রক্ষ্মাণ্ডের পানে তাকিয়ে আছে
লোহার পাতের তোরঙ্গ, বিভাবরী শব্দটি কে স্বেচ্ছায় রাত্রির কাছে রেখে গেছে?

স্মরণ, শরণে নিয়ে ভাবি

স্মরণ, শরণে নিয়ে ভাবি, মিত্রের নিকট
যা ব্যাখ্যা করলাম, কতটুকু বুঝলেন তিনি, আদৌও রন্ধনশালার
ঘ্রাণ কোত্থেকে উড়ে আসে, কার প্রিয় খোঁপা খুলে যায়, চিৎকৃত হয়ে
কে ফলবাগানে চেয়ে আছে
ঐশ্বর্য ঝমঝম করে বেজে ওঠে, খিলানের ওপার থেকে ভেসে আসে
দালির বহুবর্ণের চিত্রের ভাষা, নভস্তল কেঁপে যায়। হরিণশাবক শিকারে
আগ্নেয় অস্ত্র তুমি নির্দ্বিধায় ব্যবহৃত হয়ে যাও বারংবার।
পাতারাশির ফাঁকে শাশ্বতের মুখের মতো দেখা যায়
অনেক যুদ্ধবিগ্রহের ক্ষতে ভাসমান অকেজো কালো জাহাজ।
স্মরণ, শরণে তুলে রাখি তোমাকে, চুপ হয়ে থাকি, সেনাছাউনির পাথুরে পথে
দেখি শালগাছের অজস্র ভেজা হলুদ ফুল দুপুরে পড়ে রয়েছে, গঠনে
তারা ছোট ছোট শিশুর মতন।

মহাদেবদের বাড়ি

বাঁশঝোপের পাশে মহাদেবদের যে বাড়ি
ব্যাংক লোনে তা নিলামে উঠল, এই ঘটনা
মহাদেবরা পশ্চিমবাংলায় চলে যাওয়ার পরে
আমরা সংঘ করে মহাদেবকে ক্যাশিয়ার বানাই, ওর বামন
আকৃতির মামা ওদের বারান্দায় খেজুরের পাটিতে
বসিয়ে যত্নের সঙ্গে আমাদের সকলের পড়াতো,
বারন্দার সামনে জবাফুল আমাদের সরল মুখের দিকে চেয়ে থাকতো, অথচ
একরাতে ওই জবার কণ্ঠনালি চেপে ধরি আমরা ক’জন দুর্বৃত্ত
মহাদেব জানতো না মহাদেব ঘুমিয়ে ছিল
যেমন ওদের বাড়ির অনতিদূরে মহাদেব ভূতলে আর মাকালি
অস্ত্রসস্ত্র হাতে ওপরে দণ্ডায়মান, নাড়ুদের বাড়ি ওই বরাবর
নারকেলপাতা দিয়ে বেড়া বানিয়ে মহাদেব আর মাকালির থাকার গৃহ
ফুটবল খেলে সন্ধ্যাপরবর্তী সময়ে উল্লাসের চোটে গান গেয়ে গেয়ে আমরা
নারকেলপাতার ঘরখানার পানে সনির্বন্ধ দৃষ্টি রেখে ফিরতাম
সরু নালা ছিল তার সামনে, আলোহীন নারকেলবাগানে
অশান্তি মহাযুদ্ধ নাশে পাপাচারে জ্বলে ওঠা পৃথিবীকে যিনি উদ্ধারে
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তার কৃষ্ণশরীরে বাতাসে নারকেলপাতা আঁচড় দিয়ে যেত
বিস্ফোরণ কোথায় হলো, বাঁশঝোপের পাশে মহাদেবরা
এখন আর নেই, ফুটবল মাঠ এখন গরুর খামার
মহাদেবদের পুকুরটা এঁদোই ছিল, কাসার থালাবাসন
মাজার জন্য ওর মা, ছোটবোন ভারতী হয়তো পাথুরে ঘাটে
নেমে যেত, স্নানদৃশ্য কোনোদিন দেখিনি, সেই এঁদো পুকুরপাড়ে
বিশাল বিশাল দেবদারু গাছ
বাঁশবাগান অমনি আছে, অন্তরীক্ষ থেকে গুঁড়োগুঁড়ো নভরশ্মি ছিটকে পড়ে
এই বাঁশবাগানে, গরুর খামারে, মাতালের আনারসক্ষেতে
এসো পৌরসভার পাইপ থেকে তিষ্টা নিবারণ করি
অমিক, দ্রুত পাইপ লাইন নেয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হোক
সঞ্চারণশীল ওয়াসার জলের গাড়ি আমার পাশ দিয়ে ঝুমঝুম চলে গেল
অমিক, ডিশলাইনও দ্রুত নিয়ে নাও বাবা, কিছু ফলের গাছ
লাগালেই বরং ভালো... তোমার স্থিতিধি বড়ো প্রয়োজন এখন, ভরসা তুমিই...