রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘করোনাকালে আনন্দময় অর্থোপার্জন’
প্রকাশিত : জুন ১৭, ২০২০
হালখাতা নামে একটা ত্রৈমাসিক পত্রিকা আছে। অনেক দিন ধরে বের হচ্ছে। পত্রিকাটা বেশ নাম করেছে, প্রচেষ্টাও ভালো। কখনো আমি লিখিনি সে পত্রিকায়। তবে নাটক সম্পর্কে আমার বড় একটা লেখা সংক্ষিপ্ত করে ছাপিয়ে ছিল সম্পাদকরা। বহুদিন পর সেটা জানতে পারি। ঘটনাচক্রে সম্পাদকদের একজন শওকত হোসেনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। আমি তখন ভারতে। খুব জরুরি কথা বলার জন্য আমাকে ফোন করে শওকত। সেভাবেই, প্রাথমিক পরিচয়। বয়সে যথেষ্ট তরুণ, কিন্তু লেখালেখির জগতে অনেক কিছু করবার ইচ্ছা। দুরন্ত সাহস।
মাস দুয়েক আগে শওকত হঠাৎ করোনা ভাইরাসের উপর একটা লেখা চেয়ে বসে টেলিফোনে। কথা দিয়েছিলাম লিখবো। কদিন পর ফেসবুকে আমি একটা লেখা দেই করোনা ভাইরাস সম্পর্কে। শওকত লেখাটা পাঠ করার পর বলে, সে লেখাটা তার পত্রিকায় ছাপাবে। কিন্তু ছাপাখানা যেহেতু বন্ধ প্রথম সে অনলাইনে পত্রিকাটা বের করবে। শওকতকে বললাম, লেখাটা আরেকটু বড় করে দেবে। কিছুদিন পর শওকতের তাগাদা এলো লেখাটার জন্য। কিন্তু তখন আমার ল্যাপটপ নষ্ট। কীবোর্ড আর কাজ করছে না। তবুও শওকতকে বললাম লেখাটা দেবে ঠিকঠাক করে। কিন্তু তার মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। মধ্যরাতে প্রচণ্ড পেটের ব্যথা, কদিন চললো সেটা। শওকতকে জানালে বললো, আগে আপনার স্বাস্থ্য, লেখাটা সুস্থ হয়ে দিন। ভেবেছিলাম, তিন-চার দিনের মধ্যে লেখাটা দিতে পারবো। কিন্তু আ হয়ে ওঠেনি।
শওকতকে লেখাটা দেয়ার ব্যাপারে আমি খুবই আন্তরিক ছিলাম। কিন্তু একটার পর একটা বাধা এসে যাচ্ছিল। ল্যাপটপ ঝামেলা করছে, কিন্তু আবার চশমার কাচ দিয়ে ঠিক দেখতে পাচ্ছি না। সম্ভবত জীবাণু ধ্বংস করার জন্য বারবার পরিষ্কার করতে গিয়ে কাচদেুটো ঘোলা হয়ে গেছে চশমার। কিন্তু সে কথা শওকতকে বলতে লজ্জা পাচ্ছি। চশমা ঠিক করার উপায় নেই তখন। দোকানপাট বন্ধ। দোকানপাট খোলার পর দেখা গেল, চিকিৎসকের দেয়া আমার চোখের ব্যবস্থাপত্র খুঁজে পাচ্ছি না। আর যেখানে আমি চশমা বানাতে দেই, দেখি সেটা বন্ধ থাকছে। শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাপত্র পাওয়া গেল আর দোকানটাও খুললো। দুদিনেই চশমা ঠিক হলো। লিখতে বসবো ঠিক করেছি পরদিন সকালে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটার দিকে মনে হলো. যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে মাত্র ডা. আবু সাঈদ ভাই ফোন করেছিলেন। খবরাখবর নিলেন আমার। তখনো আমি বেশ ভালো বোধ করছিলাম। কিন্তু শ্বাসকষ্ট নিয়ে গা করলাম না প্রথম। বিকেল পর্যন্ত চলতে থাকলো কষ্টটা। বিকেলে ভাবলাম, জ্বরটা মাপি। মেপে দেখলাম, একশোর সামান্য কম। জ্বর তো থাকে না আমার। রক্তচাপ পরীক্ষা করলাম। কিন্তু রক্তচাপ দেখলাম অনেক।
হৃদস্পন্দন পর্যন্ত বেশি। কিছুদিন ধরে সাধারণত আমার রক্তচাপ থাকে উপরে বেশি হলে ১১০ আর নিচে ৭০ বা ৬৫। হৃদস্পন্দন পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন। কখনো হৃদস্পন্দন তার চেয়েও কম থাকে। সেদিন দেখলাম হৃদস্পন্দন ৯৯। রক্তচাপ নীচে ৯০ আর উপরে ১৫৪। কী ব্যাপার ভাবছি। জাফরুল্লাহ ভাইকে নিয়ে কদিন ধরে বেশ দুশ্চিন্তা করছি। নিজের অজান্তে সে মানসিক চাপ কি আমার শরীরে উপর প্রভাব ফেলেছে? প্রায় সন্ধ্যা তখন। ভাবলাম কাউকে ফোন করি। পরামর্শ নেই। প্রথম ফোন করলাম আবদুন নূর তুষারকে, কিন্তু পেলাম না। তারপর ফোন করলাম অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ আবু সাঈদ ভাইকে। তাকেও পেলাম না। সাঈদ ভাই, খুব নির্ভর করার মতো মানুষ, সঠিক পরামর্শ দেবেন। সকালে সাঈদ ভাই ফোন করেন আমাকে, তখনো শরীর বেশ সুস্থ ছিল। সাঈদ ভাইকে না পেয়ে তারপর ফোন করলাম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বন্ধু ডা. আরমানকে। কিছুক্ষণ কথা হলো ওর সঙ্গে। জাফরুল্লাহ ভাইকে নিয়ে তখন ওরা ব্যস্ত। কিছু পরামর্শ দিয়ে আরমান বললো, পরে আবার ফোন করবে। ডা. তারেককে মাঝখানে ফোন করেছিলাম। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বন্ধু সাইদুর রহমানকে ফোন করলাম। যিনি অন্যান্য সময়ে আমার জরুরি বা জটিল চিকিৎসার ব্যাপারে খুব সহযোগিতা করে থাকেন। কিন্তু তিনি বর্তমানে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনা বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন, সেজন্য তাকে বিরক্ত করবো কিনা ভাবছিলাম। তিনি সব শুনে ফোনে অনেক কথা বললেন। প্রথম বললেন, মনে হয় না আপনার ভয় পাবার কিছু আছে। এখন পরীক্ষার সুযোগ নেই। কারণ প্রায় সন্ধ্যা তখন। তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবে আর যা বললেন, পরীক্ষা করে যাই ফলাফল আসুক ঘরে থাকতে হবে আপনাকে। ঘরে থাকাটা নিরাপদ কষ্টটা খুব না বেড়ে গেলে। তিনি বহু কিছু বললেন। সবগুলিই যুক্তিসঙ্গত, গঠনমূলক। কথাগুলি আমাকে অনেকটা নিশ্চিন্ত করলো। বললেন, কিছুক্ষণ নিজেকে পর্যবেক্ষণ করেন। চিকিৎসকরা যে নানাভাবে এখন কতেটা অসহায় আর চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বুঝতে পারলাম তার কথায়।
সাইদুর রহমানের পরামর্শ পাবার পর আর বন্ধু ডা. জাহিদকে ফোন করলাম না। কারণ আমি রাতবিরাতে হঠাৎ অসুস্থ হলে ডা. জাহিদ হোসেন বা সাঈদ ভাইকে ফোন করে পরামর্শ নেই। ভাবলাম, থাক। আর কাউকে আপাতত অস্থির না করি। সাইদুর রহমান খসরুকে যারা চেনেন সকলে জানেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি অসম্ভব আস্থাবান, নীতিবান আর যোগ্য ব্যক্তি। তিনি মূলত অষুধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, বর্তমানে সে বিভাগের সভাপতি। নিজের কর্মক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশে সেরা ব্যক্তিদের একজন। সকলেই হয়তো এটা মানবেন। মানবেন না কিছু অষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। খসরু ফোন রাখলেন পরে আবার খোঁজ নেবেন বলে। তিনি ফোন রাখতেই, আবদুন নূর তুষারের ফোন। সব শুনে বললো, ভয়ের কিছু নেই। রাতে একটা ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমাবেন। তুষার আরেকটা অষুধ খাবার পরামর্শ দিয়েছিল সেটা সামান্য আগেই খেয়ে নিয়েছিলাম। নূর তুষার আরও কিছু সাহস দেবার মতো কথা বললো। তুষারের সঙ্গে প্রায় আমার বর্তমান করোনা সঙ্কট নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। তুষার আমাকে বলে রাখল, দরকার হলে বা যেকোনো সঙ্কটে ফোন না করে যেন ম্যাসেঞ্জারে একটা বার্তা দেই। কারণ সে অনেক সময় ব্যস্ত থাকছে অন্যদের সঙ্গে করোনা সম্পর্কিত বিভিন্ন পেশাদার কাজে। আমার বার্তা পেলে সে নিজেই সুবিধামতো ফোন করবে। তুষারের কথামতো রাতে ঘুমের অষুধ খেয়ে পরদিন থেকে যথেষ্ট সুস্থ বোধ করতে লাগলাম।
সকালে সুস্থ বোধ করার পর প্রথমে ঠিক করলাম, আগে শওকতের লেখাটা লিখে পাঠাতে হবে। যে ক‘দিন লাগুক সবার আগে শওকতের কাজটা বুঝিয়ে দিতে হবে। শওকতকে ম্যানেঞ্জারে আস্থা দিয়ে বললাম, লেখার কাজ চলছে। শওকত তখন আমাকে একটা প্রস্তাব দিল, আমাকে একটা বইয়ের সমালোচনা লিখে দিতে হবে। সেজন্য টাকা দেয়া হবে। বললাম, বইয়ের সমালোচনা আমি সাধারণত করি না। টাকার জন্য তো নয়ই। শওকত কথাটা মেনে নিল। তারপর নিজের কাজের বাইরে শওকতের লেখাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম ক’দিন। দেখলাম লেখাটা বেশ বড় হয়ে যাচ্ছে। শওকত অবশ্য বড় লেখা আশা করেছিল। আমারও অনেক কিছু বলার ছিল বর্তমান পরিস্থিতিতে। কিন্তু এটা মনে হলো অনেক বড় হয়ে গেছে। যদিও আমার লেখা অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায়।
পিএইচডি করবার আগে প্রথম প্রথম মনে হতো, দুশো পৃষ্ঠার একটা থিসিস লিখবো কী করে! কত পৃষ্ঠা, কোথায় পাবে অতসব চিন্তা। পরে চারশো পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বইয়ের সাড়ে ছয়শো পৃষ্ঠা। কিছুতেই লেখা যেন আর ছোট হতে চায় না। সম্পাদনা করে করে ছোট করতে হয়। দেখলাম, শওকতের জন্য লেখাটা এ ফোর সাইজের বিশ পৃষ্ঠা হয়ে গেছে। লেখাটা শেষ করে শওকতকে পাঠালাম। শওকত লেখা পেয়ে খুব খুশি। ম্যাসেঞ্জারে জানালো, রাহমান ভাই, আমরা খুব গরিব পত্রিকা। কিন্তু আপনাকে সামান্য টাকা দিতে চাই। বিকাশ অ্যাকাউন্ট থাকলে জানাবেন। আমি আসলে কখনো টাকার জন্য লিখি না। শওকতের কাছ থেকে টাকা নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু শওকত দ্বিতীয়বার আমার বিকাশ নাম্বার জানাতে অনুরোধ করে। তখন ভাবলাম, দিক না যদি দিতে চায়। পরিমাণ যাই হোক, সম্মানটা বড় কথা। টাকাটা আমি নিতে না চাইলে কাউকে না কাউকে দিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু বিকাশ নম্বর পাঠাবার সঙ্গে সঙ্গে দেখি, একহাজার বিশ টাকা পাঠানো হয়েছে আমার কাছে। খুব অবাক হলাম। লেখাটা ছাপা হয়নি, পড়েও দেখেনি। কিন্তু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে লিখেছে, জানি আপনাকে আরও বেশি সম্মানি দেয়া দরকার ছিল, কিন্তু আমাদের সঙ্গতি নেই। পরিমাণ যাই হোক, আমার কাছে হালখাতা পত্রিকার শওকতের পাঠানো এই একহাজার বিশ টাকা খুব মূল্যবান লাগছে। নিশ্চয় এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা পেয়েছি অনেক পত্রিকায় লিখে। আবার অনেক পত্রিকা টাকা দেয় না। বহু পত্রিকার দেবার সামর্থ নেই। আবার অনেক পত্রিকায় লিখে তাদের দেয়া পরপর দুটো চেক ফেরত দিয়েছি নীতিগত কারণে। তৃতীয়বার তাদের অনুরোধে লিখেছি, কিন্তু চেক গ্রহণ করবো না জেনে হয়তো আর চেক নিতে বলেনি। কিন্তু শওকতের পাঠানো সামান্য টাকাটা কী কারণে যেন খুব তৃপ্তি দিয়েছে। হয়তো ওর আন্তরিকতা।
























