
নেপোলিয়ন
রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘জুলাই আন্দোলনের সঙ্কট আসলে কোথায়’
শেষ পর্ব
প্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০২৫
বিদেশিরা যত আক্রমণের পরিকল্পনা করে ততই সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গিলোটিনে পাঠানো হতে থাকে। সবাই তারা শত্রু কিনা বুঝে ওঠা কঠিন। কারণ চারদিক থেকে বিপ্লব বিরোধীরা মাথা চাড়া দেয়। নিজের ভাগ্য ফেরাতে বিপ্লবের মাঠে তখন উপস্থিত হন নেপোলিয়ন। তিনি বিদেশি শত্রুদের পরাজিত করে বিপ্লবকে রক্ষা করেন। তিনি হয়ে ওঠেন রোবসপিয়েরের বন্ধু এবং যুদ্ধে জয়ের কৃতিত্বে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হলেন চব্বিশ বছর বয়সে।
কিন্তু যারা রাজার শাসন চাইছিলেন না, কিন্তু ভিন্নদিকে শ্রমজীবী বা সাধারণ মানুষকে ক্ষমতা দিতে চান না, তারা প্রতিবিপ্লব ঘটালো এটা বলে যে, জ্যাকোবিনরা খুনী। বিপ্লবকে তারা রক্তাক্ত করে তুলেছে। প্রতিবিপ্লবীরা রোবসপিয়েরকে গিলোটিনে পাঠালেন অন্য বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে। বিপদে পড়লেন নেপোলিয়ন। কারণ তিনি ছিলেন রোবসপিয়েরের কাছের লোক। ফ্রান্সে তখন জ্যাকোবিন বিরোধী ডিরেক্টরদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ডিরেক্টররা ভেবে দেখালেন, নেপোলিয়নের মতন সেনা কর্মকর্তাকে হারালে বিপদ। ফ্রান্স আবার বিদেশিদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। ফলে নেপোলিয়ন আরও ক্ষমতা পেলেন। তিনি ক্ষমতা পেয়ে যেসব দেশ বা বৃহৎ শক্তি ফ্রান্স দখল করে বিপ্লব ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তাদের সে সাধ মিটিয়ে দিলেন। একের পর এক যুদ্ধে তাদের পরাজিত করতে থাকলেন। কম সৈন্য নিয়ে বৃহৎ বাহিনীকে পরাজিত করলেন। পরপর বহু যুদ্ধের একটাতেও নেপোলিয়নের হার হলো না।
নেপোলিয়নের সাফল্যে ভয় পেলেন ডিরেক্টররা। নেপোলিয়ন তখন খুব জনপ্রিয়, বারবার শত্রুর পরাজয় দেখে জনগণের চোখে নেপোলিয়ন তখন বিরাট বীর। কিন্তু নেপোলিয়ন তখনি রাষ্ট্রের ক্ষমতার দিকে আগালেন না। কিছু আরও বিজয় সম্পন্ন করে প্রথম ফ্রান্সের কনসালের পদ দাবি করলেন। কারো না বলবার ক্ষমতা রইল না। কনসাল নেপেলিয়ন পরাজিত করলেন বিরাট রাশিয়া, প্রুশিয়া অস্ট্রিয়া সবাইকে। সমুদ্রের ওপারে ইংল্যান্ড ছাড়া আর সবাই পরাজিত। ফ্রান্সের অধীনে পুরো মধ্য ইউরোপ। যারা ফরাসি বিপ্লব ধ্বংস করতে চেয়েছিল, সবাই নেপোলিয়নের কাছে নতজানু।
ক্ষমতার দম্ভ, অতিরিক্ত বিজয় মাথা খারাপ করে দিল নেপোলিয়নের। নিজেই নিজেকে সম্রাট ঘোষণা দিলেন। চাটুকাররা তো ছিলই। তিনি পরিবারতন্ত্র কায়েম করলেন। বিভিন্ন দেশের রাজাদের উৎখাত করে নিজের ভাই-বোনদের সেখানে রাজা বানালেন। মূল শত্রু এখন ইংল্যান্ড। বিজিত সব রাজ্যকে নেপোলিয়ন বললেন, ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা চলবে না। কারো বন্দরে ইংল্যান্ডের জাহাজ ভিড়তে পারবে না। যারা মানতে চাইলো না, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন তিনি।
এর আগে নানা যুদ্ধে সাধারণ মানুষরা বহু সংখ্যায় প্রাণ দিয়েছে। এবার গ্রামের মানুষ আর সন্তানকে যুদ্ধে পাঠাতে চাইলো না। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ হওয়াতে বহু দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হলো। ফলে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়া প্রথম নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জোট গঠন করে। পরে বাকিরা তাতে গোপনে যোগ দেয়। নেপোলিয়ন নিজের পরাজয় এড়াতে পারে না। যারা এতদিন নেপোলিয়নকে বীর বলে পূজা দিয়েছে সবাই প্রায় তার বিরুদ্ধে চলে গেল। ক্ষমতা ছাড়লেন নেপোলিয়ন।
পুনরায় ফিরে এলো বুরবন রাজবংশের রাজা সপ্তদশ লুই। রাজতন্ত্র আর তাতে ফিরে এলো না। সংসদের শাসন আর রাজার শাসন চলতে লাগল। সাধারণ মানুষের ভাগ্য পাল্টালো না। রাজা চাটুকারদের নিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইলেন। পুনরায় বিপ্লব হলো ফরাসি দেশে ১৮৩০ সালে এবং রাজা লুই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেন।
ফরাসি বিপ্লব প্রথমবার পরাজিত হলেও কিন্তু ব্যর্থ হলো না। বিপ্লব পরাজিত হতে পারে শত্রুদের ষড়যন্ত্রে কিন্তু বিপ্লবী আদর্শ কখনোই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় না। প্রথমবার ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে নেপোলিয়ন ক্ষমতায় এলেন। বিপ্লবের বহু লক্ষ্য প্রথম দিকে তিনি কার্যকর করেন বিভিন্ন দেশে, যেসব দেশ তিনি জয় করেন। তিনি সেইসব দেশে নেপোলিয়ন সংহিতা নামের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চার্চকে দুর্বল করেন, পোপের মূল ক্ষমতা কেড়ে নেন।
পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য বাতিল করেন, সে কারণে পোপ এক টুকরো কাগজে পরিণত হয়। ইউরোপে বিভিন্ন দেশে মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের চেতনা বৃদ্ধি পায়। স্বভাবতই ১৮৩০ এর বিপ্লব শুধু ফ্রান্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। গণতন্ত্র, রাজার শাসনের অবসান, বাক-স্বাধীনতা, ভাষার ভিত্তিতে ইউরোপে জাতিরাষ্ট্র গঠন, ইউরোপের সব দেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদকে হটানো ইত্যকার দাবি নিয়ে পোল্যান্ড, ইতালীসহ অনেক দেশে ১৮৩০ এর বিপ্লব সংগঠিত হয়। কিন্তু সর্বত্র তা সামরিক বাহিনী দ্বারা দমন করা হয়েছিল।
কিন্তু যতই দমন করুক, মানুষের মনে বিপ্লবের চাহিদা রয়ে যায়। ফলে ১৮৪৮ সালে আরো বৃহৎ আকারে ফরাসি দেশসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপ্লব আরম্ভ হলো। কার্ল মার্কস এই বিপ্লবে যুক্ত ছিলেন। বিপ্লব পরাজিত হলো। সত্যি বলতে বিপ্লবের সেই সব দাবিগুলো আদায় করতে প্রথম মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পার হয়ে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত লেগে যায়। বর্তমানে যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, এরকম একটা ইউরোপীয় সংঘ নামে একটি মাত্র ইউরোপীয় দেশের স্বপ্ন দেখতেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট দেড়শো বছর আগে।
মনে হবে ইউরোপে বিপ্লব বারবার পরাজিত হয়েছিল। হ্যাঁ পরাজিত হয়েছিল নিজেদের মধ্যে বিভেদের কারণে। কিন্তু তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়নি। বিপ্লব ব্যর্থ হলে, ইউরোপে একই দাবি নিয়ে বারবার বিপ্লব হতো না। বহু মানুষ প্রাণ দিতো না। বিশেষ করে ১৮৪৮ সালের সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এত বিরাট বিপ্লব পরাজিত হলো, নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি বলে। দ্বিতীয় কারণ, বিপ্লবের পর কী ধরনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এ ব্যাপারে কারো মধ্যেই স্পষ্ট ধারণা ছিল না। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এই পরাজয় ছিল আসলে বাস্তব ঘটনা। কারণ একটি বিপ্লবে বা একদিনে মানুষের সব চাওয়া অর্জিত হবে এই ভাবনাটাই মূর্খের ভাবনা।
সবকিছুই অর্জিত ধাপে ধাপে, এবং জনগণকে তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হয় প্রজ্ঞা দ্বারা। ইতিহাস এটাই প্রমাণ করেছে বারে বারে। ফরাসি বিপ্লব বা তার আগের রেনেসাঁর কয়েকটা দাবি: মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র গঠন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক সংসদীয় রাজনীতি; এসব অর্জন করতে ইউরোপে অনেকগুলো আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু তা তখনো সামগ্রিকভাবে পাওয়া যায়নি। তারপর দু দুটা মহাযুদ্ধ হয়েছে নিজেদের মধ্যে, সাড়ে তিন বা চার কোটি লোক মারা পড়েছে দুটো যুদ্ধে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর রক্তপাতে ভীত ইউরোপ, সকলের মধ্যে নানান রকম বাস্তব অভিজ্ঞতা, রাজনীতিকদের চিন্তা ততদিনে আরো পরিপক্ক হওয়া, প্রথম মহাযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়া; সব মিলিয়ে ১৯৫১ সালে দাবিগুলো গৃহীত হলো। প্রায় আটশো বছর সময় লেগেছে বিভিন্ন সংগ্রামের পর। কিছুই আসলে একদিনে, একটি মাত্র আন্দোলনেই অর্জিত হয় না। বছরের পর বছর কয়েকশো বছর ধরে সংগ্রাম করতে হয় তার জন্য। দ্বিতীয় বিষয়টি, সেই সব ত্যাগী সংগ্রামী মানুষের চিন্তাভাবনার স্তর কেথায় দাঁড়িয়ে আছে সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
চিন্তার রাজ্যে দৈন্যদশা থাকলে ফল ততক্ষণে আসবে না। রক্তপাত ঘটবে, শাসকরা চোখ রাঙাবে, বহু প্রতিক্রিয়াশীল লোকের দেখা পাওয়া যাবে। যারা একদা প্রগতিশীল তারাও অনেকে প্রতিক্রিয়াশীল লুটেরা হয়ে দাঁড়াবে। বারবার অভ্যুত্থান হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কিন্তু পিছনের চিন্তাটা কী তার উপর নির্ভর করবে সাফল্য। যারা অভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারী তাদের চিন্তাচেতনার মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ এসব ক্ষেত্রে।
ফরাসি বিপ্লব পরাজিত হয়েছে বারবার, কিন্তু ইউরোপের চিন্তার জগত, জ্ঞানচর্চার জগত, বিজ্ঞানচর্চা বহুদূর এগিয়ে ছিল। প্রতিটি বিপ্লবেই সেসব এগিয়ে যাচ্ছিলো বাধাহীনভাবে। বিপ্লব পরাজিত হয়েছে কিন্তু জ্ঞান অর্জন বন্ধ থাকেনি বরং বেড়েছে। বিশেষ করে ফরাসী বিপ্লবের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাহিত্য নতুন মাত্রা লাভ করে। রুশ সাহিত্য বিকশিত হয় ফরাসী বিপ্লবকে ঘিরে। ইউরোপের প্রতিটি বিপ্লবের প্রধান ফলাফল বিজ্ঞানের অগ্রগতি। মানুষের মধ্যে অধ্যয়নের আকাঙ্ক্ষা এবং জানার ইচ্ছা বৃদ্ধি পায়।
মুদ্রণ শিল্পের বিকাশের ফলে নানা বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ প্রকাশিত হতে থাকে। বিভিন্ন রকম মত ও চিন্তার সমন্বয় ঘটে। সেই সঙ্গে মানুষের বাক-স্বাধীনতা, মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও মাতৃভাষার প্রতি সম্মান বাড়তেই থাকে। বাংলাদেশে কি সেরকম অবস্থা আছে বর্তমানে? বা কখনো জ্ঞানচর্চার সেই শুভক্ষণ দেখা গেছে? সতেরো কোটি মানুষের দেশে বইয়ের পাঠক কত? কত বই ছাপা হয়? মান কি সেই সব গ্রন্থের? গ্রন্থের মানের কথা বিবেচনা করে বিদেশিরা কি তা অনুবাদ করতে উৎসাহী হয়েছে?
বাংলাদেশের গ্রন্থ বা চিন্তাগুলি কি বাইরের মানুষকে আলোকিত করেছে? অধ্যয়ন, বাক-স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মাতৃভাষার প্রতি সম্মান বলে কিছু কি আছে এই দেশে? গলাবাজি করে কখনো মুক্তি অর্জন করা যাবে না। শত বছর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করলে এসব পাওয়া যাবে না। যতক্ষণ না চিন্তার রাজ্য পরিষ্কার হবে। বৃহত্তর জনগণ যতক্ষণ না সে চিন্তাকে ধারণ করবে। বহু আন্দোলন তো হলো, চিন্তার অগ্রগতি কতটুকু? সাফল্য কতটা? বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের আন্দোলন, গত জুলাইয়ের আন্দোলন; কী পাওয়া গেছে সাফল্য?
যতক্ষণ না সমগ্র জাতির মস্তিস্ক শাণিতত হবে, সাফল্য আসবে খুব কম, কারণ সংগ্রাম ভুল পথে পরিচালিত হবে? চিন্তার অগ্রগতি না ঘটলে, রাস্তায় প্রাণ দেওয়া প্রতিবার দুঃখজনক ঘটনায় পরিণত হবে।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ