
রূপনির রূপকথা
উপন্যাস ৬
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : মে ১৯, ২০১৯
ফেরার পথে গাড়িতে বসে জিনিয়া আন্টি কিশোরী মেয়ের মতো আদুরে গলায় বললেন, ’তো বাবু আজকের মিটিং এর জন্য আমার গিফট কি?’
জকি তার দিকে বিশেষ ভঙ্গিতে তাকালো। আন্টি বললেন, ‘তাহলে চলো-তিনদিনের জন্য আমরা নাই হয়ে যাই।’
‘কোথায় যাওয়া যায়, বলো তো ডার্লিং? কক্সবাজার নাকি পাতোয়া?’ গাড়ি চালাতে চালাতে জকি বলল। আপাতত জিনিয়া আন্টিকে খসানো যাবে না। দিনতিনেক তাকে বরাদ্দ করা যেতেই পারে। খানের অনেক খুটিনাটি নিশ্চয়ই জিনিয়া আন্টি জানেন। খান সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য জকির জানা চাই। বিশেষ করে খানের দুর্বলতা। জিনিয়া সাহায্য না করলে জকিকে অন্ধকারে থাকতে হবে।
চার.
সন্ধ্যা হবো হবো সময়ে ঈশান আর্ট কলেজের এলো। মাঠের সবুজ চত্বরে আনা আপার চার-পাশে বসে আছে আরও চার-পাচ জন-কমবেশি সবাই ঈশানের পরিচিত। ওরা নড়ে-চড়ে ঈশানকে বসার যায়গা করে দিল। একটা পিচ্ছি এস ঈশানের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আনা আপা বললেন, ‘শোন ঈশান দেশে একটা বড় ঘটনা ঘটেছে। এখন আমাদের কিছু একটা করতে হবে।’ বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে আনাকে।
‘বল কি! এখন দেশে আবার এমন কি হলো! আধা সামরিক শাসনে দেশ তো ভালই আছে। দুষ্ট লোকেরা পালিয়েছে। তুমি আবার কি ঝামেলার খবর দেবে, বলো তো শুনি।’ ঈশান বলল।
‘সবাইকে বলেছি-এখন তোকে বলি। জানিস তো এয়ারপোর্টের সামনে লালনের ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে। গত পরশুদিন একদল মৌলবাদি ছাত্র এসে সেই ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেয়ার জন্য আল্টিমটাম দিয়েছে। আগামি মাসের প্রথম শুক্রবার ওরা লালনের ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেবে।’ আনা বলল।
‘কিন্তু এখন তো দেশে মিছিল মিটিং ব্যান্ড।
‘লাখ টাকার প্রশ্ন! উত্তরটা সহজ-আমাদের শাসকরা বরাবরই মৌলবাদি কার্ড নিয়ে খেলে। আমি নিশ্চিত আগামি মাসের ঐ শুক্রবারেই মৌলবাদিরা লালনের ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেবে। বলতে পারিস মৌলবাদিরা ঐদিন একটা অ্যাসিড টেষ্ট করবে। ওরা সফল হলে ধারাবাহিক ভাবে দেশের অন্য সব ভাস্কর্যের ওপর হামলা চালানো হবে। তারপর শুরু হবে আমাদের অন্য অন্য কিছু শিল্প-সাহিত্য, এমন কি বিজ্ঞান গবেষণার ওপর হামলা। ছবি আঁকা বন্ধ হবে-গান গাওয়া বন্ধ হবে। মেয়েদের ওরা গৃহবন্ধি করবে, একেবারে তালেবানি রাষ্ট্র যাকে বলে।’ আনা খুব উত্তেজিত।
‘বটে! সেই সাথে তোমার রুমাল কেটে পোষাক বানানো বন্ধ হবে। তোমাকে বোরখা লাগিয়ে পাড়া বেড়াতে হবে।’ ঈশান বললো।
‘ফাজলমো রাখ। আমি ভাবছি ব্যাপারটা একেবারে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া যায় না। আমাদের কিছু একটা করতে হবে।’ আনা বলল।
’কেমন করে? আমরা এখন মোটে সাতজন?’ চশমা চোখের জাহিদ বললো।
‘আরে বাবা শুরুটা আমরা করি তো। শুরুটা এভাবেই হয়, এক সময় সাতজনই সাত লাখ হয়ে যাবে। এখন তোরা বল কি কি করা যেতে পারে?’
‘আমরা ঐ দিন মিছিল নিয়ে যাব, মৌলবাদিদের পেটাবো।’ বললো আরেকজন।
‘ব্যাপারটা এত সহজ না। পুলিশ আমাদের মিছিলই করতে দেবে না। আমি চাচ্ছি সব ভার্সিটিগুলোতে একটা করে গ্রুপ তৈরি করে সবাইকে নিয়ে একশন প্লান তৈরি করতে। ঈশান তুই তো প্রাইভেট ভার্সিটিতে-ওখানে তো সব নন্দদুলালরা পড়ে-তারপরও তুই দেখ, ওদের কাজে নামানো যায় কিনা, ছাত্ররাজনীতি করে এমন ছাত্ররা, দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে যাবে না। আমাদের খুব একটা পাত্তা দেবে না, কারণ আমাদের এই আন্দোলনে টাকা পয়সার ব্যাপার নেই। এ কারণে আমাদের দরকার অরাজনৈতিক স্টুডেন্ট, আমি প্রাইভেট ভার্সিটির ছাত্রদের উপেক্ষা করতে চাচ্ছি না। যেহেতু ওদের তারুণ্য আছে ওরা নিশ্চয়ই দেশের কথা ভাবে। নষ্ট পলিটিক্স ওদের এখনো ওদের তেমন পলুটেড করতে করতে পারেনি। ওদের একটু মটিভিটেড করা দরকার। এই যা! বাংলাদেশ দল ক্রিকেট খেললে এই ছেলে-মেয়েগুলো কি ভিনদেশকে সর্মথন করে! নিশ্চয়ই না। তাহলে ওরা আসবে না কেন! ঈশান তুই প্রাইভেট ভার্সিটি গুলোর লিঁয়াজো করবি।’ আনা বলল।
‘তা না হয় হলো। তুমি কি ভাবে কাজে নামাতে বলছ, ঠিক কি করতে চাচ্ছ? ঈশান জিজ্ঞাস করল।
‘ধর, আমরা এখন বিভিন্ন ভার্সিটি ও কলেজ গুলুতে, আমাদের সাথে কাজ করবে, এমন ছেলেমেয়েদের খুঁজে বের করতে পারি। তারপর সবাইকে নিয়েই আমরা এ্যাকশন প্লান তৈরী করবো, একেবারে গণতান্ত্রিক উপায়ে। ভোটের মাধ্যমে। এতে করে ভুল হলেও কেউ কাউকে দোষ দিতে পারবে। আপাতত আমাদের কোন কমিটি দরকার নেই। তবে, এখন আমাদের একটা শক্ত প্রচার সেল দরকার। আমরা বিভিন্ন পত্রিকা অফিসগুলোতে যাব। এছাড়া যার যত লিংকস্ আছে, কাজে লাগাতে চেষ্টা করবো। এছাড়া যদি একটা মৌলবাদ বিরোধি ক্নসার্ট করা যায় তবে খুব ভাল হয়। গানে গানে আমরা মৌলবাদিদের গোষ্ঠি উদ্ধার করবো। চারুকলার স্যারদেরকে আমাদের সাথে নিতে হবে। মৌলবাদিদের বাধা দিতে না পারলে এই স্যারদের ও দেশ থেকে পালাতে হবে, নয়তো খুন হতে হবে অথবা ভাতে মরতে হবে। আশা করা যায় চারুকলার স্টুডেন্ট-টিচারদের আমরা সাথে পাব। এই তালেবানদের ঠেকাতেই হবে।’ একটানা কথা বলে আনা একটু থামল। ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপে ফের চুমুক দিল।
‘সবই বুঝলাম-কিন্তু তুমিই বললে মৌলবাদিদের কর্মকান্ডে সরকারের সায় আছে। ওরা টের পেলে তো আমাদের সবাইকে জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে ঢোকাবে। আমাদের জীবনের বারটা বাজবে। ব্যাপারটায় অনেক ঝুঁকি আছে। মৌলবাদিদের এখন পোয়া বার, ওরাও আমাদের ছেড়ে দেবে না।’ হতাশার সুরে ঈশান বলল।
‘অথচ বাবার কাছে শুনেছি পাকিস্তানী আমলেও নাকি মৌলবাদিরা প্রগ্রেসিভদের ভয় পেত। সরাসরি কনফ্লিক্ট এড়িয়ে যেত।’ চশমার কাঁচ পরিস্কার করতে করতে জাহিদ বলল। জাহিদ চারুকলার ছাত্র। নার্ভাস হলে জাহিদ চশমার কাঁচ করে, এটা বোধ হয় ওর মুদ্রাদোষ।
‘আমার মনে হয় এখন যারা প্রগ্রেসিভ তারা, অযথাই মৌলবাদিদের ওভার এস্টিমেট করে। এ কারণেই ওরা এত দাপট দেখায়। মৌলবাদিদের নানা ধারা-উপধারা যোগ করলেও ওদের ভোট ব্যাংক দশ থেকে পনের শতাংশ। এই ভোট নিয়েই ওরা সবাইকে ব্লাক মেইল করছে।’ আনা বলল।
চলবে