রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ৮

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : মে ২২, ২০১৯

সাত.
বুঝলি ঈশান, তোরা কিছুই করতে পারবি না। আমি নিশ্চিত তোরা আগেই হেরে গিয়েছিস। সিগারেটের খোসায় গাঁজা ভরতে ভরতে ইকবাল ভাই বললেন। একটু বিরতি দিয়ে ফের শুরু করলেন, ওসব বাদ দে। গাঁজায় একটা টান দিয়ে দেখ না, মহাসুখ পাবি। তোদের গানজুট্টি বানাতে পারলে আমার কত লাভ জানিস, একেবারে বিনা মেহনতে গাঁজা পেতাম। তোরাও সময় মতো গাজাঁ না পাওয়ার জ্বালা টের পেতি। আমার দুঃখটা বুঝতি।
থামুন তো ইকবাল ভাই। এখন আমার সাথে চলেন। আজকে আমাদের মাস্ কমিউনিকেশন। ভার্সিটির স্যারদের সাথে বসবো। বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে যাব। ঈশান ইকবাল ভাইকে তাড়া দেয়।
বুঝলাম, তোদের সাথে কি আনা থাকবে, আনা থাকলে যাওয়া যেতে পারে?
ইকবাল ভাই, সময় আছে ভালো হয়ে যান। নইলে খবর আছে। নিজের বয়স কত, ভাবুন। কঠিন গলায় ঈশান বলল।
আরে, এত রেগে যাচ্ছিস কেন! আর আমার বয়স নিয়ে টানাটানি করিস কেন! আমি দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাচ্ছি কেবল।
ইকবাল ভাই, আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আর কখনো আনাকে নিয়ে আজে-বাজে কথা বলবেন না। ঈশান হঠাৎ রেগে গেল যেন। ঈশানের চেহারা দেখে ইকবাল ভাই মিইয়ে গেল। তারপর বলল, তখন তোদের জন্ম হয়নি, বাংলাদেশেরও জন্ম হয়নি। তখন তো রেডিও টিভির যুগ না। তারপরও দেশে নতুন বাতাস আসে, কোনোটা টাটকা কোনোটা দূষিত। ভিয়েতনামের যুদ্ধ নিয়ে আমাদের মধ্যে উত্তেজনা। পশ্চিমা তরুণরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভার্সিটি ছেড়ে রাস্তায়। কী সব দিনই না ছিল! এসব খবরে আমাদের কিশোর রক্তও টগবগ করে ফুটত। পত্রিকার পাতায় যোয়ান বায়েসের কথা জানলাম, বিটলসদের কথা জানলাম। কিশোর বয়সেই হিপ্পি হওয়ার স্বপ্ন দেখালাম। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের পর জানলাম যোয়ান বায়েস জর্জ হ্যারিশনের সাথে নিউইর্য়কের রাস্তায় বাংলাদেশের জন্য গান গেয়েছে। কত ছিল মেয়েটার বয়স! হয়তো পঁচিশ, বড়জোর ছাব্বিস। পত্রিকার পাতায় ছবি দেখে রীতিমতো প্রেমে পড়ে গেলাম। অনেক চেষ্টা করেছি আমেরিকা যাওয়ার, হয়নি। আমেরিকা গেলে কখনো হয়ত যোয়ান বায়েসের দেখা পেতাম। আর কিছু না পারি একটা ধন্যবাদ তো দিতে পারতাম! হলো না, এ জীবনে আর হবেও না। তোদের আনা না ফানা, ওকে দেখলে যোয়ান বায়েসের কথা মনে পড়ে।

ঈশানের রাগটা পানি হয়ে গেল। ঈশান মুখে কোনো ভাষা যোগালো না। ইকবাল ভাই আস্তে আস্তে বললন, চল যাই, তুই আমাকে আজ আবার কোন চুলায় নিয়ে যাবি।
ইকবাল ভাইকে নিয়ে ঈশান টির্চার’স ক্লাবের গেটের সামনে এসে রিকশা থেকে নামল। ওদের দেখে আনা এগিয়ে এলো, আনা সম্ভবত অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। আনার চোখে বিরক্তি। ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর তাকালো ইকবাল ভাইয়ের দিকে। ইকবাল ভাইকে সাথে দেখে হয়তো আনা, ঈশানের ওপর রাগটা ঠিকমতো ঝাড়তে পারলো না।
আঙ্কেল ভালো আছেন? ইকবাল ভাইকে আনা বললেন।
জি, জি, হ্যাঁ। বোকার মতো হেসে মাথা দোলাতে দেলাতে ইকবাল ভাই উত্তর দিলেন। ইকবাল ভাইয়ের অবস্থা দেখে ঈশান মনে মনে হাসে। উনাদের খবর কি? টির্চার’স ক্লাব ভবনটা দেখিয়ে ঈশান জিজ্ঞাস করল।
একমাত্র বসির স্যার দেখা করার জন্য সময় দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিলাম, অপেক্ষা করতে বলেছেন। আমাদের গেস্টরুমেও ঢোকাতে চাচ্ছেন না। এই সব লোক আর আমাদের জন্য কতটা করবেন! কিছুটা হতাশ গলায় আনা বলল।
কিরে ঈশান, বলেছিলাম না তোরা কিছুই করতে পারবি না। মাঝখান থেকে এই মেয়েটা খেটে মরবে। তোদের সাথে কেউ আসবে না। এখন যে যার স্বার্থ নিয়ে আছে। ইকবাল ভাই বললেন।
আপনি এত ভেঙে পড়ছেন কেন ইকবাল আঙ্কেল? আপনি তো এসেছেন। আমাদের সাথে আপনার মতো অনেকেই আসবেন। আনা বলল।
আমি! আমি তো একটা ফালতু বুড়ো। আমতা আমতা করে ইকবাল ভাই বললেন। আমাকে গোনায় ধরছে কে? আনা কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেল। ক্লাবের গেট দিয়ে এগিয়ে আসছেন বসির স্যার। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টক শোগুলোতে তার প্রতিনিয়ত সরব উপস্থিতি। এ লোকের সমর্থন খুবই মূল্যবান। ওরা বসির স্যারকে আসতে দেখে আশাবাদি হয়ে উঠল। বসির স্যার শশব্যাস্ত। তিনি চারিদিক দেখতে দেখতে আসছেন। যেন অন্যের উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইছেন। লাইট পোস্টের আলোটা এড়িয়ে তিনি একটা অন্ধকার জায়গায় দাঁড়ালেন। ওরা কাছে যেতেই তিনি বলেলন, তোমাদের সাথে আমি আছি। তবে এখন কিছু কৌশলগত কারণে তোমাদের প্রকাশ্যে সমর্থন করা যাচ্ছে না। তবে আমার ব্লেসিং আছে, গো এহেড। কথাগুলো শেষ করে বসির স্যার আর দাঁড়ালেন না। ওরা কিছু বলার আগেই চলে গেলেন।

টিচারস্ এসোসিয়েশনের আগামি নির্বাচনে উনি প্রার্থী হতে চান। তাই এখন থেকেই সাবধানে চলতে চাচ্ছেন। এই ভদ্রলোকেরও মৌলবাদী ভোট দরকার। মিয়িয়ে যাওয়া গলায় আনা বলল। এরপর মোবাইল ফোনে কথা বলল আরেকজন প্রগতিশীল ধারার শিক্ষকের সাথে। এ ভদ্রলোক বললেন, মৌলবাদীরা এখনো ভাস্কর্য ভাঙেনি। একটা হুমকি দিয়েছে মাত্র। এ ধরনের হুমকি কত লোকেই না দেয়। এ সব গনায় ধরলে হুমকি দাতাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। বরঞ্চ বিষয়টা উপেক্ষা করাই ভাল। চিলে কান নিয়েছে ভেবে চিলের পেছনে ছোটার মানে হয় না। ভদ্রলোকের কথাগুলো আনা ঈশান আর ইকবালভাইকে বলে। কথাগুলোতে যুক্তি আছে।

এখন আমরা কি করতে পারি?’ আনা ওদের দুজনকে বলল। ঈশান ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে! ইকবালভাই মুখ খুললেন, মৌলবাদীরা এখন ভাস্কর্য ভাঙেনি, ঠিক আছে। আমরাও বলছি না যে ওরা ভাস্কর্য ভেঙেছে। ওরা হুমকি দিয়েছে, আমরা এই হুমকির প্রতিবাদ করছি। আমাদের প্রতিবাদে যদি মৌলবাদীরা পিছিয়ে যায়, ভালো। এটাই আমরা চাচ্ছি, ব্যাস। ঐ টিচার একজন এস্কেপিস্ট।
তা হলে কি আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব? আনা জানতে চাইল।
কেন নয়। আমরা প্রতিবাদ করলে মৌলবাদীরা জানবে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়া যাবে না। এমনও হতে পারে ওরা ভয় পাবে। ইকবাল ভাই ফের বলল। এরপর আর কথা থাকে না।
ওরা তিনজন এবার গেল একটি বড়দলের মাধ্যম সারির একজন নেতার বাড়িতে। দলটি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন এই ব্যক্তি একজন জুনিয়র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এখন দলের দুর্দিন থাকলেও তিনি ভালোই আছেন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞান বিতরণ করে চলছেন। মাঝে মাঝে তিনি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধেও নানা মতবাদ দেন। আনা ধরেই নিয়েছে এই নেতার সমর্থন পাওয়া যাবে।

নেতার বাড়ির ড্রয়িং রুমটা দেখে ওদের টাসকি লেগে গেল। দুনিয়ার ভাল ভাল জিনিশের সব রিপ্লিকা দিয়ে রুমটা সাজানো হয়েছে। রুমের শো পিসগুলোর দাম বাজার মূল্যে অর্ধ কোটি টাকার কম হবে না। দেয়ালে দুটি পেইন্টিংও ঝুলছে। বোঝা যায় শিল্পকর্মের ওপর ভদ্রলোকের পড়াশুনা ও আগ্রহ রয়েছে। এ ধরনের লোক নিশ্চয়ই ওদের সমর্থন করবে। লুঙ্গি আর গেঞ্জি গায়ে মোটা একটা ইংরাজি বই হাতে নিয়ে ভদ্রলোক ড্রয়িং রুমে এলেন। এই লোক নিশ্চিত ভাবে বিনয়ের অবতার। বর্তমানে তাদের দলের ওপর যে বিপর্যয় চলছে তার দীর্ঘ ফিরিস্তি দিলেন। লালনের ভাস্কর্য ইস্যুতে তার দল নিশ্চয়ই মৌলবাদীদের সমর্থন করে না। তবে এই মুহূর্তে তাদের নেত্রী সাব জেলে আটক। এখন দলই শুধু না জাতির উচিত সাব জেলে আটক তাদের নেত্রীর মুক্তির জন্য ঝাপিয়ে পড়া। এই মুহূর্তে মৌলবাদীরা লালনের দু একটা ভাস্কর্য ভেঙে ফেললেও ক্ষতি নেই। নেত্রীর মুক্তির পর দল ক্ষমতায় এলে একটার বদলে দশটা ভাস্কর্য তৈরি করা যাবে। এখন ভাস্কর্য ইস্যুতে দল বেশি জড়িয়ে গেলে নেত্রীর মুক্তি প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অপর প্রধান দলটি ফয়দা লুটবে।

লোকটির কথা শুনে এক রাশ হতাশা নিয়ে ওরা তিনজন রাস্তায় নামল। ভদ্রলোকের বাসায় দুধ-চিনি ছাড়া চায়ের লিকারের মুখে লেগে থাকা স্বাদ এখন বড় তিক্ত মনে হচ্ছে। এখন তুমি কি করতে চাচ্ছ? ঈশান বললো। আনা বলল, পত্রিকা অফিসগুলোতে যাব। আমাদের প্রতিবাদলিপি ছাপাতে অনুরোধ করবো। এ কাজটা আমি একাই পারবো।

সেকি, তুমি একা যাবে! তাহলে আমরা এসেছি কেন? ইকবাল ভাই বললেন। আনা কিছু বলল না, শুধু হাসলো। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ওরা তিনজন বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে ঘুরে ঘুরে প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিলি করলো। আনার পরিচিতিটা কাজে লাগলো, প্রেস ওদের তেমন নিরাশ করলো না। একদল লোক সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটা ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। কেউ কিছু বলবে না এটা হতে পারে না। কিছু একটা হলেই একটা লিড নিউজ পাওয়া যায়, বেশ কয়েক দিন এটা-সেটা লিখে পাঠককে মাতিয়ে রাখা যায়। সুতরাং সংবাদপত্রগুলো ওদের বিবৃতি ও কর্মসুচির সংবাদ বেশ গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ করলো। পাশাপাশি মৌলবাদীদের পক্ষে বিভিন্ন ফতোয়া ও ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেয়ার বিভিন্ন প্রস্তুতির খবর। মৌলবাদীদের উৎসাহিত করার জন্য একটি সংগঠন কাফনের কাপড় কিনেছে। কাফনের কাপড় পড়েই ওরা ভাস্কর্য গুড়ি দেবে। ঝিমিয়ে পরা রাজনীতির মাঠ চাঙা হয়ে ওঠার লক্ষণ বটে। সরকারি তরফ এখন নীরব। বোঝা যাচ্ছে না সরকারি ভূমিকা। মজার ব্যাপার হলো সরকারি টাকায় ঐ ভাস্কর্য নির্মাণ চলছে। নির্মাণ শেষে ভাস্কর্যটি হবে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। অথচ সরকারকে সেই রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় তেমন উদ্যোগী মনে হচ্ছে না। সরকারের মতিগতি বোঝা কঠিন বটে!

চলবে