রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ২৪

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জুন ১৫, ২০১৯

২৫.
আজকের পত্রিকা আর চ্যানেললগুলোর বড় খবর হলো, পালাতে গিয়ে লাল-শুয়ার নিহত। জানা গেছে, ফতুল্লা এলাকায় লাল-শুয়ারকে নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনী অস্ত্র উদ্ধারে গেলে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা লাল-শুয়ারের দোসররা পুলিশ-র‌্যাবের ওপর হামলা চালায়। র‌্যাব-পুলিশও পাল্টা হামলা চালায়। এ সময় লাল-শুয়ার পালাতে চেষ্টা করলে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। হামলায় র‌্যাবের দুজন সদস্য আহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটা পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া লাল শুয়ারের মৃত্যুর সংবাদে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মিছিল ও মিষ্টি বিতরণের খবর নিয়ে সাইড স্টোরি বেরিয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে ইটের ভাটায় ঢুকিয়ে লাল-শুয়ার কীভাবে মানুষ হত্যা করতো তার রোমহর্ষক বিবরণ।

ঘুম থেকে উঠে চ্যানেলের খবর আর পত্রিকার বিবরণ পড়ে ঈশানের মনটা খারাপ হয়ে গেল। রূপনি এখন নিজেকে সামলাবে কীভাবে? রূপনির মাকে ঈশানের একজন সাধারণ মায়ের মতো লেগেছে, খুনির স্ত্রী মনে হয়নি। এখন ওদের কত ধরনের ঝক্কি মোকাবেলা করতে হবে! ঈশান নিশ্চয়ই যাবে। রূপনির পাশে থাকার চেষ্টা করবে। কিন্তু একা আর কতটা পারবে! রূপনির অন্য বন্ধুরা এগিয়ে এলো খুবই ভালো হতো। ইকবাল ভাইকে মনে পড়ল। তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই রূপনির পাশে দাঁড়াতেন। থানা-পুলিশ গোয়েন্দাদের পরোয়া করতেন না। যাক, আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ঈশান রূপনিদের ল্যান্ড ফোনে ডায়াল করল। যা ভেবেছে তাই, কেউ ফোন ধরছে না। তারপর আনাকে ফোন করলো। এত সকালে আনা ঘুম থেকে ওঠে না। কিন্তু আনাকে পাওয়া গেল। কিছু বলার আগেই আনা বলল, ‘কাল রাতে তেমন ঘুম আসেনি, টিভি দেখছিলাম। তখন দেখলাম খবরটা। তারপর আর ঘুমাতে পারিনি। রূপনির জন্য খুব খারাপ লাগছে। আমি তৈরি হয়ে আছি, তুই চলে আয়। রূপনির কাছে থাকতে হবে।

রূপনিদের বাড়িটা এখন যেন মৃতপুরী। দুজন গার্ড একজন কেয়ার টেকার আর তিনজন বুয়া ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ নেই। ঝামেলা দেখে অনেকেই পালিয়েছে। রূপনি ওর মায়ের বেডরুমে মাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। রূপনি যেন পাঁচ-ছয় বছরের জীবনে ফিরে গেছে। মাকে এ মুর্হূতের জন্য ও কাছ ছাড়া করতে চায় না। রূপা বিবি জানতেন, এই কঠিন দিনটা আসবে। ডিবি অফিস ও বিভিন্ন লোকের কথা থেকে এমনই আভাস তিনি পাচ্ছিলেন। মন শক্ত করে ছিলেন। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। কালরাতেই থানা থেকে ফোন করে রূপা বিবিকে সব জানানো হয়েছে। চাইলে মর্গে গিয়ে লাশ দেখে আসতে পারে, তবে পোস্ট মটের্ম রির্পোটের পর লাশ হস্তান্তর করা হবে। লাশ দাফনের প্রস্তুতির জন্য থানা থেকে বলা হয়েছে। কীভাবে কি করতে হবে কে জানে! আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিত মানুষ কেউ আর এ বাড়িতে আসে না। তারপর আশা, একটা লাশের সাথে এখন আর কিসের শত্রুতা। হয়ত কেউ না কেউ এসে পাশে দাঁড়াবে। কাজগুলো অনেক সহজ হয়ে যাবে। এখন সব চেয়ে বড় সমস্যা, রূপনিকে ওর পাপার মৃত্যুর খবর জানানো। রূপনিকে ঘুম থেকে তুলে তিনি কীভাবে এ খবর দেবেন? কালরাতে রূপা বেগম রূপনির ভয়ে কাঁদেননি। তারপরও তিনি চোখের পানি আটকাতে পারছেন না। লাল-শুয়ারকে তিনি ঘৃণা করতেন, হয়তো মৃত্যুও কামনা করতেন। তারপর লাল শুয়ারের সাথে গাঁথা ছিল এ জীবনটা। এখন ছিটকে পড়েছেন এক অজানা অন্ধকার গহ্ববরে! গহ্বরের কোথায় আলো তিনি জানেন না। তার দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

এ এলাকার বাড়িগুলো যেমন হয়, পাশের বাড়ির খবরও কেউ রাখে না। আর একজন বাড়ির মালিক যদি হয় মারাত্মক এক খুনি, তার মৃত্যু নিয়ে প্রতিবেশীদের কৌতূহল থাকলেও নিজেদের ছক বাঁধা জীবনের দামি সময় নেই নষ্ট করতে চাইবে না। এ কারণে আনা আর ঈশান ওই বাড়িতে এসে তেমন কাউকে দেখল না। অথচ কিছু দিন আগে ইকবাল ভাইয়ের মৃত্যুতে সারা পাড়া যেন ইকবাল ভাইয়ের বাড়িতে ভেঙে পড়েছিল। এলাকা আর মানুষে কত পার্থক্য। কাজের বুয়া এসে ওদের নিয়ে ড্রইং রুমে বসালো। রূপনি আর ওর মা এখনো উপরের তলায়। কিছুক্ষণ পর এক বুয়া এসে ওদেরকে উপরে যেতে বলল। রূপনির মা মূর্তির মতো স্থির হয়ে রূপনির মাথার কাছে বসে আছেন। তার চোখের দৃষ্টি যেন দেয়াল ভেদ করে অনেক দূরে কিছু একটা দেখছে। ঈশান, আনা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ঠিক এ সময় রূপনির দেহটা একটু নড়ে উঠল। যেন আড়মোড়া ভাঙল। তারপর রূপনি চোখ মেলে তাকালো। রূপনি উঠে বসল, সুতীব্র চীৎকারে বলে উঠল, আমার পাপা আমার পাপা। রূপনির বুক ফাটা চিৎকার ঈশানের কাছে অসহনীয়। ও ধীর পায়ে রুমের বাইরে চলে এলো। আসার আগে দেখল আনা রূপনিকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে। আনার চোখে পানি চকচক করছে।

ঈশান বুঝতে পারলো, এখন রূপনি কিংবা রূপনির মায়ের সাথে কোন ব্যাপারে কথা বলে লাভ নেই। ওদের কোন আত্বীয়-স্বজন আসবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বাড়ির বারান্দায় একজন বয়স্ক মত কেয়ার-টেকারকে পেয়ে গেল। ঈশান এই দারওয়ানের সাথে কথা বলা শুরু করলো। লোকটি অনেক তথ্য দিল। পুলিশ জানিয়েছে বিকেলের আগে মর্গ থেকে লাশ বের করা যাবে না। লাশ নেয়ার সময় রূপনি অথবা রূপনির মাকে হাসপাতালে থাকতে হবে। লোকটি আরও জানালো, এ বাড়িতে এখন আর পরিচিত লোকেরা আসে না। এমন অনেকে, যারা এ বাড়িতে চাকুরি করত, মালি, বাবুর্চিদের অনেকে ভয়ে হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে হোক, পালিয়েছে। যত অসহনীয় হোক শোকের বাড়িতেও সময় পার হয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে রূপনি এক সময় নিশ্চুপ হয়ে যায়। দুপুর শেষে বিকাল শুরু হয়। রূপনি, রূপনির মা, আনা ঈশান রূপনিদের জীপে করে হাসপাতালের মর্গে আসে। মর্গের সামনে আগে থেকেই ভিড় করে আছে একদল ফটো সাংবাদিক। ওরা গাড়ি থেকে নামতেই ক্যামেরার ফ্লাশ লাইট গুলো জ্বলে উঠে। একেই বলে মড়ার ওপর খাড়ার ঘা। রূপনির মা আঁচল দিয়ে মুখ লুকাবার বৃথা চেষ্টা করছে।

ওরা তালা মারা মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ কর্মকর্তদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। দু ঘণ্টা পর সন্ধ্যা হবো হবো সময়ে পুলিশের লোকজন আসে। পুলিশেরই একটা পিকআপ ভ্যানে লাশ তোলা হয়। রূপনি আর কাঁদছে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখছে কেবল। পুলিশ বিভিন্ন কাগজপত্রে রূপনির মায়ের স্বাক্ষর নিল। রূপনির মা একটা কথাও না বলে, কাগজগুলো না পড়ে স্বাক্ষর দিলেন। লাশবাহী পুলিশের গাড়িটা আগে আগে চলতে লাগল। রূপনিদের গাড়িটা ওটার পেছন পেছন চলতে লাগল। বিভিন্ন হোন্ডা আর গাড়িতে করে সাংবাদিকদের দলটা আসছে। কবরস্থানে এসে অনেক সমস্যার খুব সহজ সমাধান হয়ে গেল। কবরস্থানের সামনে একটা বিশেষ জায়গায় পুলিশের তত্ত্বাবধানে লাশের দ্রুত গোছল ও কাফনের কাপড় পড়ানো হলো। রূপনিকে বাবার লাশের মুখ দেখার জন্য বললে রূপনি হ্যাঁ না কিছুই বলল না। কেবল শূন্যে তাকিয়ে থাকলো। রূপনির অসহায় অবস্থা দেখে রূপনির মা আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। অচমকা সশব্দে কেঁদে উঠলেন। চলবে