শশী হকের গদ্য ‘ভবে মানুষপশু নিষ্ঠা যার’
প্রকাশিত : জুন ১৫, ২০২০
কলিম খান পড়ার সময় `পশু` শব্দে এসে একটা অদ্ভুত ধাক্কা খেলাম। তিনি বলছেন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শব্দকোষ পশু বলতে আসলে অ্যানিম্যাল না, অর্থ করেছিল, `যে অবিশেষে দেখে` সে-ই পশু। আর `অবিশেষে দেখা` হচ্ছে, বেদ বা নলেজকে বিভাজিত আর অপূর্ণরূপে দেখা। এ দেখা শুধু কার্যরূপকে দেখা, কারণসূত্রকে না, এই দেখা যা-তা দেখা। এই দেখা অপ্রশ্ন, অন্ধ।
এখন এই অর্থের বিপরীতে যে প্রস্তাবটা আমাদের মগজে দাঁড়ায় তা হচ্ছে, তাইলে `যে বিশেষে দেখে` সেই তো মানুষ। কিন্তু কলিম খান সেই দিকে না গিয়ে দেখালেন যে, মানুষও আসলে একপ্রকার `অবিশেষে দেখে`, কারণ সে যা কিছু বিশেষে (পূর্ণাঙ্গ রূপে) দেখে বলে ভাবে তা আসলে হাজার বছরের এক মৌলবাদ (পুরাতন) তারে দেখায়, নিজে দেখে না। তাই প্রশ্নহীন ভাবে সে একটা দরকারি চার্টের ভিতর, রুদ্ধ নিরাপত্তার ভিতর, কমপ্লিট কোডের ভিতর, শুধু পালের পশু হয়ে বাঁচে, আর কিছু না। কলিম খান এই মানুষদেরকে বলেছেন `উত্তম-পশু`।
আহ, আবারো সেই `সব স্বরের এক রা`। সেই মহান (?) অপমান-কথা, `জন্মাইলেই মানুষ হয় না, হইয়া উঠতে হয়`, বা, `হুস হয় যার, সেই মানুষ` বা আরেকটু আগাইয়া, `সবাই মানুষ না, কেউ কেউ মানুষ`। এবং এর সাথে এন্টি-থট হিসাবে খাঁড়ায়, পশু এক হীন হিংস্র ঘৃণিত সত্তা, এবং মানুষ পশু না, অন্যকিছু, বানর থেকে না, আকাশ থেকে আসা সৃষ্টির সেরা সে, পশু না। এই যে এক বিপুল বিভ্রম, এখান থেকেই আসলে মৌলবাদের যাত্রা, এবং কইতে দ্বিধা নাই, কী বৈদিক (শরা, প্রতিষ্ঠান) কী অবৈদিক (বেশরা, অপ্রতিষ্ঠান), মানুষের হাজার বছরের অহং এই একই ঝাণ্ডাই শুধু উড়ায়ে গেছে নানা ঢঙে, আর এখনো উড়াইতেছে... এইসব ভাইবা যে পৃথিবীর দুই ভাগ, একভাগে `মানুষ` (human) আর অন্যভাগে `না-মানুষ` (non-human)।
এখন ফেরা যাক সেই `দেখার` ভিতর, হরিচরণের পশুর সেই `অবিশেষে দেখার` ভিতর, যা দেখা হয়েছে মানুষের জ্ঞান-চক্ষুতে। পশুর `দেখা`কে জানা যদিও অসম্ভর, কিন্তু এইটা বুঝি যে, সে হয়তো ঠিক দেখে না, দৃষ্ট হয়। তার দেখাটা হয়তো সমগ্র শরীরের অনুভবের সম্পর্কে দেখা। তার দেখা আরো ধারালো (স্মার্ট) হবার এক নিগুঢ় তাগিদ থেকে দেখা। এই দেখা শুধু সময়ের সাথে বোঝাপড়া আর থাকতে থাকার দেখা, আর কিছু না। তাই, এই আমি, যদি `পশু` শব্দের অর্থ করতাম, তবে বলতাম, `যে সদা বর্তমানে থাকে` সে-ই পশু।
মানুষের দেখা, মানে অই `বিশেষে দেখা`টা তবে কেমন, সেই ব্যাপারটা ধরা যাক। মানুষের মনো-চেতনা আসলে এক অদ্ভুত দুর্বার মতি (তৃষ্ণা), যে ভাবতে চায়, যা দৃষ্ট হয় তাই সব না, দেখার ভিতরও আরো দেখা থাকে, আর সেটাই আসল দেখা। মানুষের কাছে ঘটনার চেয়েও ঘটনার কারণ বড়, এবং সেই কারণ-সমষ্টিই তার আসল বাস্তবতা (actual reality), তার সত্যতা। আবার অন্যদিকে বিজ্ঞানেরও আসল বাস্তবতা বস্তুজগত বা প্রকৃতি না, বরং তার আড়ালের কণাজগৎ, তার গহীন রহস্য সূত্র... তার ল, ইকোয়েশান আর বহু থিওরীর বিমূর্ত সত্যতা। মানুষের `বিশেষে দেখা` বা কন্সাসনেস তাই একপ্রকার বিনির্মিত বাস্তবতাকে (Re/De-constructed realiti) দেখা। এবং আশ্চর্য ব্যাপার, এক্ষেত্রে, এই সৃজনে, লজিকেল ডিস্কোর্স মাস্ট না।
আমি আজ ভাবি, খুশি মনেই ভাবি, মানুষ তো প্রথমে পশু, পশুই, তারপর মানুষ। সে আসলে, বরং বলা ভালো, আশ্চর্য এক মানুষপশু, যে যুগপৎ অবিশেষ এবং বিশেষে দেখতে পারে। এই ক্ষমতা সে প্রাপ্ত হয়েই জন্মায়। কিন্তু কলিম খান যা বলেছেন, সেই মতে ভাবা যায় যে, মৌলবাদের খপ্পরে পরে মানুষের এই সহজাত ক্ষমতা আজ নষ্ট হয়ে গেছে। আর আমি দেখছি, মানুষের আম ও ছালা দুই-ই বরবাদ। সে না পারছে আপন মানুষের `অবিশেষে দেখাকে` দেখতে, না পারছে আপন পশুর সেই `অবিশেষে দেখা`র কাঁচা স্বাদ নিতে। তাই কলিম খান অই মানুষদের যখন উত্তম-পশু বলেন, সেটাও `পশু হচ্ছে হীন`, মৌলবাদের সেই পুরাতন বেসিক থেকে আসা সিদ্ধান্ত। যাই হোক, আমামতে অই অবিকশিত মানুষেরা আসলে ভাগ্যদোষের ফেরে পরা `অধম পশু`।
আমি আজ আমার পশুটারে আমার মানুষের ভিতর পাইতে চাই, আমি আজ আমার মানুষটারে আমার পশুর ভিতর পাইতে চাই। আমি চাই না কোন এপোলোনিয়ান ভার্চু, কোনও রাম-বৈভব। আমি আমার মতো শুধু বিকশিত হতে চাই। বাস্তবতা তার যতটুক নিয়ে যেভাবে আমার কাছে আসে, আমি শুধু তার যোগ্য হয়ে উঠতে চাই, তার প্রেমিক হতে চাই, আর কিছু না। আমি ডাইয়ানায়সিসের (Dionysus) উদ্দামতাকে, মদকে, উল্লাসকে, নৃত্যরসকে মন্থন করতে চাই। আমি পেতে চাই আমার শিবশক্তির মাধুরিলীলা। শিবের অনুচরের মতো আমি হতে চাই পশু, হতে চাই প্রমথ। আজ সময় হইছে ভূতের ক্যাসেলগুলি সব ভেঙে ফেলার। আজ সময় হইছে নতুন ভাব নিয়ে গান গাইবার, `ভবে মানুষ-পশু নিষ্ঠা যার, সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার, সিদ্ধ হয় তার...
লেখক: কবি
























