ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম
শিক্ষক ও গবেষক ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম
সরকার আবদুল মান্নানপ্রকাশিত : জুন ১৩, ২০২০
আমার শিক্ষক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। ১৯৮৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আমরা অতি সজ্জন এই মানুষটিকে শিক্ষক হিসেবে পাই। অনার্স-মাস্টার্স শেষে আমার এমফিল গবেষণায়ও স্যারকে কিছুদিন তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পেয়েছিলাম। বলা যায়, পুরো আশির দশকটা আমি সরাসরি স্যারের ছাত্র ছিলাম। প্রায় এই এক দশকের দীর্ঘ সময় ধরে স্যারে স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসাই পেয়েছি।
শিক্ষক নয়, রক্তমাংসের একজন মানুষ হিসেবে কত কারণে মানুষ বিরক্ত থাকে, উদ্বিগ্ন থাকে, উত্তেজিত থাকে। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয়, এই দীর্ঘ সময় ধরে স্যারের সান্নিধ্যে কখনই তাঁকে বিরক্ত অবস্থায় দেখিনি, উদ্বিগ্ন দেখিনি এবং কারো সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে দেখিনি। মনে করতে চেষ্টা করছি, স্যারের কোনো কথায়, কোনো ব্যবহারে, কোনো আচরণে কখনো কি কষ্ট পেয়েছিলাম? কিন্তু কিছুতেই এমন একটি মুহূর্তের কথা মনে করতে পারছি না।
আমার মনে হয়, আমি একা নই, কাইউম স্যারের দীর্ঘ শিক্ষতা জীবনে যারা তাঁর প্রত্যক্ষ শিক্ষার্থী ছিলেন তারা কেউই এমন একটি মুহূর্ত স্মরণ করতে পারবেন না। এক জীবনে এমন নিরহঙ্কার, এমন সহজ-সুন্দর মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না। আমার এই ছোট জীবন এমন কয়েকজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়ে কতভাবে যে ধন্য হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রায় ৮৭ বছরের (০১.০৮.১৯৩৩ - ১২.০৬.২০২০) এক দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করে কাইউম স্যার আজ ১২ জুন, ২০২০ তারিখে পরলোক গমন করেন। তাঁর বিদেহী আত্মার চির শান্তি কামনা করি।
মধ্যযুগের সাহিত্য, মধ্যযুগের ভাষা, মধ্যযুগের সংস্কৃতি, মধ্যযুগের ব্যাকরণ, মধ্যযুগের পত্রপত্রিকা নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণার করার মানুষটি চলে গেলেন। এই ক্ষেত্রে গবেষণা করার মতো তেমন কোনো লোক আর থাকল না। জানি, পৃথিবীতে কেউই অপরিহার্য নয়। সবাইকে চলে যেতে হয়। কিন্তু তবুও কিছু মানুষের চলে যাওয়ায় কোথাও কোথাও শূন্যতা তৈরি হয়। আমাদের মধ্যযুগের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণায় সেই শূন্যতা তৈরি হলো।
বহুদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সঙ্গে নানা রকম রাজনীতি, ক্ষমতার বিচিত্র বলয়, পদ-পদবির টানাপোড়েন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত হয়ে গেছে। কেউ যদি শুধু শিক্ষকতা, গবেষণা ও লেখালেখি নিয়ে থাকতে চান তার জন্য সেই জীবন খুব সুখকর হয় না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষ নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে শিক্ষকতা করছেন না, লেখালেখি করছেন না, গবেষণা করছেন না। বিস্ময়কর বিরূপ পরিস্থিতির ভেতরেও কিছু মানুষ নীরবে-নিভৃতে কাজ করছেন।
কাইউম স্যার যে সময়ে শিক্ষকতা করেছেন সেই সময়টাতেও শিক্ষক-রাজনীতি ছিল। কিন্তু স্বার্থের পটভূমিতে এতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি বলে আমার ধারণা। এবং সেই সহনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না আমার জনা নেই। হয়তো ছিলেন কিংবা ছিলেন না। যদি থেকেও থাকেন সেই থাকাটা কখনোই শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। ফলে শিক্ষক হিসেবে তিনি খুব একটা সম্মানজনক জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন।
নিভৃতচারী এই মানুষটি মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতেন। কিছুক্ষণ পরপর চারদিকটা দেখে নিতেন, বৃক্ষের দিকে তাকাতেন, জলাশয়ের দিকে তাকাতেন, পাখিদের দিকে তাকাতেন, আর যখন শিক্ষার্থীরা তাঁকে ছালাম দিত তখন মাথা উঁচু করে ওই শিক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে ছালামের জবাব দিতেন। খুব দায়সাড়া গোচের জবাব নয়। স্পষ্টতই বোঝা যেত, তিনি শিক্ষার্থীর কল্যাণের জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করছেন। ফলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর একটি মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দহরম-মহরমের সম্পর্ক ছিল, বরং পিতার সঙ্গে পুত্র ও কন্যাদের যে সম্পর্ক তৈরি হয়, কাইউম স্যারের সঙ্গে আমাদের সেই সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
একটি উদাহরণ দিই। নব্বই সালের কথা। তখন আমি কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা করি এবং জগদীশ গুপ্তকে নিয়ে এমফিল ডিগ্রির জন্য গবেষণা করছি। গবেষণা সংক্রান্ত কজে স্যারের মীরপুরের বাসায় গেলাম। তখন বিকেল তিনটে। দরজা খুলে দিলেন স্যার এবং খালাম্মাকে ডেকে বলছেন, “আরে দেখ দেখ, মান্নান এসছে। ও তো দুপুরে খায়নি মনে হয়।”
খালাম্মা ড. রাজিয়া সুলতানা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তিনি আমার হাত ধরে বাথরুমের দিকে নিয়ে চললেন এবং বলছেন, “এসো বাবা, একটু হাতমুখ দুয়ে খেতে বসো। তোমাকে তো খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
আমি দুপুরে খাইনি। সুতরাং ক্ষুধার্ত ছিলাম এবং ক্লান্তও ছিলাম। পিতা-মাতা ছাড়া সন্তানের এই একান্ত ব্যক্তিগত অবস্থা আর কে অনুধাবন করতে পারে! আমার এই গুরু এবং গুরুপত্নী ঠিকই আমার অবস্থা অনুভব করেছিলেন। স্যার আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন এবং লেখালেখির কী একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমাকে খাবার দিয়ে খালাম্মা পুরোটা সময় আমার পাশে বসেছিলেন এবং এটা-সেটা পাতে তুলে দিচ্ছিলেন আর কথা বলছিলেন। পুরো সময়টা আমি আমার বাবা-মার সান্নিধ্যেই যেন কাটালাম। এদেরকেই বলে একাডেমিক ফাদার ও একাডেমিক মাদার।
এমফিল-এ ম্যাথোডলজির জন্য দুইশ নম্বরের একটি কোর্স ছিল। কাপাসিয়া থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তখন আমি এমফিল-এর ম্যাথোডলজির ক্লাসগুলো করি। ক্লাস নেন মোস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম স্যার এবং হায়াৎ মামুদ স্যার। তখন কাপাসিয়া থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার জন্য কমপক্ষে চারবার বাস পালটাতে হতো। কাপাসিয়া থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা, জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে চন্দ্রা, চন্দ্রা থেকে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ, সাভার স্মৃতিসৌধ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এবং প্রান্তিক গেট থেকে হেঁটে কলা ভবন। কিন্তু দেখা যেত অনেক সময় শিক্ষকগণ থাকতেন না। অন্য কোনো কাজে তাঁরা অন্যত্র ব্যস্ত আছেন। অথবা আমার এই বিচ্ছিন্ন ক্লাসটির কথা ভুলে গেছেন।
এই ক্লাসে ছাত্র একজন এবং সে হচ্ছে আমি। বাংলা বিভাগে আর যারা আমার সঙ্গে এমফিল-এ ভর্তি হয়েছিল তারা কেউই চালিয়ে যায়নি। আমি একা বলেই ক্বদাচ এই ক্লাসটি কোনো ক্লাস রুমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্যারদের রুমে গিয়ে বসতাম এবং অড্ডার ছলে ক্লাস শেষ হতো। কিন্তু তাঁদের তো রুমে থাকতে হবে। অনেক সময় দুটি ক্লাসের মধ্যে একটিও হতো না। ফলে এত কষ্ট করে আমার আসা-যাওয়া অনেক সময় ব্যর্থ হতো। কিন্তু আমি খুব ভালোভাবেই অবহিত ছিলাম যে, আমার এই শিক্ষকগণ আমাকে কী পরিমাণ স্নেহ করেন, কী অফুরন্ত ভালোবাসা আমি তাঁদের কাছ থেকে পেয়েছি। ফলে দিনের শেষে আমার মধ্যে কোনো দুঃখ থাকত না। রীতিমতো ক্লাস করার যে দায়িত্ব আমার আছে আমি সুষ্ঠুভাবে তা পালন করার চেষ্টা করতাম। ক্লাস হবে কি হবে না সে দায়িত্ব আমার ছিল না। তবুও একদিন আমি কাইউম স্যারকে কোর্স শেষ না-হওয়ার বিষয়টি জানালাম। স্যার আমাকে তাঁর রুমে নিয়ে গেলেন এবং হন্তদন্ত হয়ে কী যেন খুঁজতে লাগলেন। বুক সেলফের নিচের বাক্স থেকে একটি কাগজের ব্যাগ আমার হতে দিয়ে বললেন, “নাও। এর মধ্যে অনেকগুলো প্রবন্ধ আছে। কোর্স দুটির জন্য তোমাকে আর ভাবতে হবে না। কপি করে রাখবে। আগামী সপ্তায় ব্যাগ ফেরত দেবে।”
আমার জন্য চা-বিস্কুট এসেছে। চা-বিস্কুট খেতে খেতে আমি আলাদা আলাদা স্টেপল করা প্রবন্ধগুলো দেখছিলাম আর স্যারের সঙ্গে কথা বলছিলাম। প্রবন্ধগুলো দেখে আমি খুব খুশি। সত্যি কোর্সগুলো নিয়ে আমার আর ভাবতে হবে না। আমি একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম।
ম্যাথোডলজির উপর পরীক্ষা আমার ভালো হলো এবং রেজাল্টও ভালো হলো। সুতরাং এখন আমি এমফিল রিসার্চ-এর বিষয় পিএইচডিতে ট্রান্সফার করতে পারি। আমার আনন্দের সীমা নেই। তবুও স্যারদের নির্দেশনা দরকার।
পরামর্শের জন্য প্রথমেই গেলাম মোস্তাফা নূরউল ইসলাম সারের বাসায়। ফার্মগেটের এই আকাশপ্রদীপ নামক বাসায় আমি বহুবার গিয়েছি এবং বারবারই পথ হারিয়ে ফেলেছি। আজব বাসা! আমার বিন্দুমাত্র দোষ আছে বলে কখনোই মনে হতো না। মনে হতো খুব একটা প্যাঁচগির মধ্যে বাসাটা অবস্থিত। স্যারকে একবার বলেও ছিলাম। “স্যার, এত প্যাঁচগোচের মধ্যে বাসা করেছেন। খুঁইজ্জা পাই না।” স্যার এবং খালাম্মা হাসতে হাসতে খুন।
ওই দিন কিছুতেই বাসাটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যখন পেলাম তখন দুপুর। খাওয়ার সময়। আমার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে স্যার বললেন, “কি হে মান্নান, বাসা নিশ্চয়ই হারিয়ে ফেলেছিলে।”
আমি বললাম, “ঠিক বলছেন স্যার। একদম নাস্তানাবুদ অবস্থা।”
শুনে খালাম্মা পিটপিট করে হাসেন।
খালাম্মা বললেন, “যাও, হাতমুখ ধুয়ে এসো। খেয়ে নাও। তারপর রেস্ট নেবে। একঘণ্টা পরে তোমার স্যারের সঙ্গে কথা বলবে।”
স্যারের সঙ্গে কথা বলে আমার ভীষণ মন খারাপ হলো। স্যার বললেন, “তুমি তো মাত্রই পাস করে গেলে। এখন এমফিল শেষ কর। সার্টিফিকেট নাও। তারপর পিএইচডি করবে। ট্রান্সফার করা ঠিক হবে না।”
অল্প বয়সে পিএইচডি করব। একটা ভাবসাবের ব্যাপার আছে। কিন্তু স্যার তো সব মাটি করে দিলেন। কী করা। খুব মন খারাপ হলো। কিন্তু স্যারকে বুঝতে দিলাম না। আচ্ছা, আচ্ছা করে স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে সোজা চলে এলাম কাইউম স্যারের বাসায়।
স্যারকে ঘটনা বললাম। ভাবছিলাম কাইউম স্যার হয়তো পিএইচডি করার কথাই বলবেন। কিন্তু যখন শুনলেন মোস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার এমফিল শেষ করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন তখন তিনি বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে বললেন, “ইসলাম সাহেব বলেছেন? তা হলে তো আর কোনো কথা নেই। এমফিল শেষ কর। তারপর পিএইচডি করবে।”
আমি তো হতভম্ব। প্রিয় শিক্ষদের এই সিদ্ধান্ত যে আমার জীবনের মোড় পালটে দিয়েছে, সেই গল্প এখানে করব না। শুধু এইটুকু বলব, প্রথমে বিরক্ত হলেও ওই ঘটনার পর কাইউম স্যারের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ অনেক বেড়ে যায়। সহকর্মীকে সম্মান করা এবং তার সিদ্ধান্তকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার ওই মূল্যবোধের সঙ্গে, সংস্কৃতির সঙ্গে আমি পরিচিত হলাম। হায়াৎ মামুদ স্যারও আমাকে ওই একই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কাইউম স্যার তাঁর বিনম্র ও মৃদু সম্ভাষণের ভেতর দিয়ে এবং পরিমিত আচরণের ভেতর দিয়ে কত রকম সুন্দর ও সত্যের সঙ্গে যে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
কাইউম স্যারের মনের গড়নটাই ছিল গবেষণামুখী। ১৯৭০ সালে তিনি লন্ডন যান পিএইচডি গবেষণার জন্য। ভর্তি হন ‘স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-এ। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ব্যাকরণ রচনার তিনজন পথিকৃৎ, নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড, উইলিয়াম কেরি এবং জি.সি. হটন প্রণীত বাংলা ব্যাকরণের মূল্যায়ন। এ সময় স্যার জানতে পারেন যে, হ্যালহেড কলকাতায় থাকাকালীন বাংলা ও অন্যান্য প্রাচ্য ভাষার প্রচুর পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন এবং সেগুলো লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে রক্ষিত আছে। সেখানে তিনি বাংলা-ফারসি শব্দকোষের একটি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পান। হ্যালহেড তাঁর মুন্শি বা শিক্ষকদের সাহায্যে বাংলা ভাষা শেখার জন্য যেসব পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলে এটি তার একটি। এবং তিনি গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে ওই অভিধানটি পূর্ববঙ্গের কোনো পণ্ডিত কর্তৃক রচিত প্রথম অভিধান। ২০০২ সালে বাতায়ন প্রকাশন থেকে ওই পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশিত হয়েছে “বাঙালি প্রণীত প্রথম বাংলা অভিধান” নামে। সঙ্কলন ও সম্পাদনায় মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। এক জীবন তিনি অসাধারণ পরিশ্রমসাধ্য এইসব গবেষণার কাজ করে গেছেন এবং আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছে আমাদে অস্তিত্বের সঙ্গে, নিরন্তর উত্তর সাধনার আদিলগ্নের সঙ্গে।
১৯৩৩ সালের ১লা অগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন পুরনো ঢাকার রহমতগঞ্জে। পড়াশোনা করেছেন আরমানিটোলা স্কুলে, ঢাকা কলেজে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭০ সালে তাঁর বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির শিরোনাম “পাণ্ডুলিপি পাঠ ও পাঠ-সমালোচনা”। মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি পাঠের কৌশল আয়ত্ত করার জন্য এই একমাত্র গ্রন্থটি দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যতালিকাভুক্ত। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় আরেক দিকনির্দেশনামূলক গবেষণাগ্রন্থ A Critical Study of Bengali Grammars: Halhed to Haughton। এছাড়া স্যারে অমূল্য কিছু গবেষণাগ্রন্থ ও পরিশ্রমসাধ্য সঙ্কলনের নাম উল্লেখ করি। “অভিধান” (১৯৮৭); “চকবাজারের কেতাবপট্টি” (১৯৯১); “উনিশ শতকের ঢাকার সাহিত্য সংস্কৃতি” (১৯৯১); “ঢাকার ইতিবৃত্ত: ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি”; “রত্নবতী থেকে অগ্নিবীণা: সমকালের দর্পণে” (১৯৯১); “সাময়িকপত্রে সাহিত্যিক প্রসঙ্গ” (১৯৯২); “সাময়িকপত্রে রবীন্দ্র প্রসঙ্গ” (১৯৯২); “নানা প্রসঙ্গে নজরুল” (২০০২); “নজরুল-সংবর্ধনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ” (২০০৭); “প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা ভাষার অভিধান” (প্রথম খণ্ড, ২০০৭)। জীবনী: “মুহম্মদ এনামুল হক” (১৯৮৭); “খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ” (১৯৮৯); “কাজী ইমদাদুল হক” (১৯৯৩)। সম্পাদনা: “আর্জুমন্দ আলীর প্রেমদর্পণ” (১৯৬৬); “মোজাম্মেল হক রচনাবলী”; “মোহম্মদ বরকতুল্লাহ রচনাবলী” (৩খণ্ড, ১৯৮৯- ১৯৯৩); “আলাওল রচিত সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী” (১৯৯২); “মীর মশাররফ হোসেন ও শতবর্ষে বিষাদসিন্ধু” (১৯৯১); “আলাওল রচনাবলী” (২০০৭)। ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন “ মেপল পাতার দেশে” (২০০৫) এবং ছোটদের জন্য লিখেছেন “মোদের গরব মোদের আশা” (২০০৫)। প্রবন্ধ সাহিত্য ও গবেষণায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৯১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
























