শিমুল বাশার

শিমুল বাশার

শিমুল বাশারের স্মৃতিগদ্য ‘মিথোম্যানিয়া’

প্রকাশিত : জুলাই ০৮, ২০২০

রানুর একবার প্যাট বাইজ্যা গেল। নবাবগঞ্জের তুইতাল হাসপাতালে গিয়া ইছামতির পানিতে রানুর প্যাট পরিষ্কার করে আনা হইলো। সারাদিন রান্নাঘরে বসে আঝোরে কাঁদলো রানু। বাসার সবার মুখ থমথমে হয়ে আছে তিন দিন ধরেই। রানুকে উদ্দেশ্য করে আপা অনর্গল নোংরা নোংরা কথা বলছিল। রানুর সেদিনের সেই কান্না আমার খুব অচেনা লাগছিল। আমি ওর কাছে গিয়ে বসতেই ও বললো, আমি আর এ বাইত্তে থাকুম না।

দুদিন পর রানুর ভাই করিম এসে নিয়ে গেল রানুকে। এরপর রানুর সাথে আর দেখা হয় নাই। রানুর সাথে আমি ম্যাকগাইভার দেখতাম। রানু ভালো রান্না করতো। রানু চলে যাবার পর আপার ক্যাঁচক্যাঁচানি আরো বাড়লো। প্রতিদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙতো রান্নাঘর থেকে আসা আপার ওই ক্যাঁচক্যাঁচানি শুনে। বারান্দায় পার্টিসান করা একটা ছোট্টরুমে আমি থাকতাম। খাটের দুই দিকে জানালা, একটা আলনা, পড়ার টেবিল এইটুকুই ছিল আমার পারসোনাল জগৎ।

বাবা- মা ছেড়ে নতুন জায়গায় এসেছি, নতুন স্কুল, চারপাশ অচেনা। খারাপ লাগলে খোলা জানালা ধরে বাইরে নারিকেল গাছের দিকে তাকায়ে থাকতাম। স্কুলে যাবার আগে আপা যা রান্না করতো, তাই-ই খেতাম। আপার রান্না আমার খুব একটা পছন্দ হইতো না... প্রতিদিন কষা কষা মাছ! বোনের বাড়িতে থাকি, রাগ জেদ করা যাবে না। মা বলে দিয়েছিলেন, লক্ষ্মীমতো থাকতে। আমার একাকী রুমের কোল ঘেঁষে ছোট একটা বাগান করেছিলাম আমি। গোলাপ, রঙ্গন, গাদা, জবা, বেলি, দূর্বা আর ঢাকা থেকে বয়ে আনা একটা মোজেন্ডা গাছ। সব সময়ই কোনো না কোনো ফুল থাকতো। আমার হাতে ফুল ফুটতো। জানালা লাগোয়া ছিলো দীঘল কামিনীর গাছ। প্রতি সন্ধ্যায় মৌ মৌ করে আমার রুমে গন্ধ ঢুকতো। কামিনীর গন্ধ মাখা বিছানায় আমি সারারাত ছটফট করতাম। সকালে বাগানের পাশের ওঠান দিয়ে পারভীন খালা, বেবী ও হ্যাপী স্কুলে যেত। যেতে যেতে ওরা সবাই একবার আমার বাগানের দিকে তাকাতো। শিরিন, ইলিয়াস ওরা দুই ভাই বোন প্রতিদিনই লেট। শিরিন শুধু বাগানের ফুল দেখতেই এদিকে তাকাতো কিনা আমি নিশ্চিত না তবে জানালা দিয়ে ওর দিকে তাকালে চোখা চোখি হয়ে যেত আমাদের।

শিরিনের চোখ ছিল ফুলের চেয়েও সুন্দর! এরপর স্কুলে যাবার জন্য আমিও রেডি হতাম। টিফিনের টাইমে বাসায় না ফিরে বেগম আয়েশা গার্লস স্কুলের সামনে যেতাম। বয়েজ আর গার্লস স্কুলের মাঝখানে ছোট্ট খাল। খালের ওপর আধেক চাঁদের মতো একটা সাঁকো। পারাপারের প্রয়োজন নাই তবু ওই সাঁকো থেকে গার্লস স্কুলের গেটটা দেখা যায়। হয়তো ওই গেটের ভেতরটা একবার দেখে ফেলার লোভেই আমি ওপাড়ে যেতাম। তবে ঠিক কি বা কাকে যে দেখতে যেতাম সেটা নিয়ে আমি এখনো কনফিউজড!

আপা, ছোট একটা ভাইগ্না আর আমি ছাড়া জয়পাড়ার ওই বাসাতে আর কেউ ছিল না। বিকেলে পারভীন খালাদের তালপুকুরের পাশের খোলা জায়গায়টায় ব্যাডমিন্টন খেলা হইতো। পারভীন খালা খুব ঝগড়াটে স্বভাবের ছিল। তবে আমাকে খালা খুব আদর করতো, খেলতে নিতো। আমরা সবাই একসাথে খেলতাম। পারভীন খালার দাদা খুব বদরাগী মানুষ ছিল, চ্যাচামেচি করতো খেলতে গেলে। ওই বুইড়ারে আমার দুচোখে দেখতে ইচ্ছা করতো না। ওই বুইড়া না থাকলে আমার কৈশোরটা আরো কিছুটা আদর মাখা হইতে পারতো। পারভীন খালা আমাকে সোলস, ইফতেখার সাদী, সেলিম চৌধুরী, সাইফ আর রাকিবের ক্যাসেট উপহার দিয়েছিল। আমার গান শোনার স্বভাবটা সেই কৈশোরেই তৈরি হয়। রাত জেগে গান শুনতাম। পারভীন খালা খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল! বেবী, হ্যাপীও।

এক বিকেলে ওরা সবাই উপজেলা লাইব্রেরতে নিয়ে গেল আমাকে। কত্ত কত্ত বই সেলফে সাজানো! আমি জীবনে সেই প্রথম কোনো লাইব্রেরি দেখলাম। সেখানে বিনা পয়সায় যেকোনো বই পড়া যায়। সেই থেকে খেলা বাদ, বিকেলে বই পড়া শুরু। চিনলাম, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, সুনীল, হুমায়ূন, বুদ্ধদেবদের। তবে আমার ভালো লাগতো শার্লক হোমস। এই বইটা পড়তে গিয়েই পরিচিত হলাম কাকলীর সাথে। দুজনেই ওই একটা বই রিকুইজিশন দিতাম। মার্ক করে রাখতাম কত পাতা পর্যন্ত পড়লাম। লাইব্রেরি থেকে বের হলে কাকলী হাঁটতে হাঁটতে হিন্দি সিনেমার গান করতো। এরপর একদিন আমার বাগানটার নাম রাখলাম `কাকলী গার্ডেন।`

সেই সিনেমার মতো জয়পাড়া এখন আর নাই। কাকলীর বাবার পোস্টিংয়ের পর ওরাও চলে গেছে কোথায় ঠিক জানিনা। আমার সেই কাকলী গার্ডেন আর বারান্দার রুম ভেঙে বিল্ডিং করা হয়েছে সেখানে। টিনের চালায় জামরুল আর আমড়া পরার আচমকা শব্দে আমার আর কোনোদিন ঘুম ভাঙবে না। জয়পাড়া পাইলট হাইস্কুল আর বেগম আয়েশা গার্লসের মাঝখানের সেই বহমান খালটাও শুকিয়েছে কবে! এখন ওই খাল ভরাট করে প্রভাবশালীরা দোকান বসিয়েছে। সাঁকোটা যেখানে ছিলো সেখানে স্বাধীনতার স্মারক, রতন চত্বর।

সমাজহীন এই মানুষের শহরে আজো বিকেল হলে আমি গন্ধে গন্ধে জীবন পড়তে পড়তে অতীতে চলে যাই। জয়পাড়ার পুরনো বিকেলগুলোই আমার হৃদয়ে ফটোগ্রাফ হয়ে ঝুলতে থাকে। নিজের ভেতরে ভয়ঙ্কর মিথোম্যানিয়া রোগ বাসা বেঁধেছে। অবাস্তব একটা সংসারে বাস করি। সেই জগতের সংসারে আমার কত কত হারিয়ে যাওয়া মানুষ, হাসিমুখ! সিনেম্যাটিক ফটোগ্রাফ! সেসব সিনেমায় হায়াত আলী স্যারের বাসার বাঁধানো সিড়ির বারান্দায় নিতু আপা, মিতু আপা আর সুমীর সেই গোধূলির রং মাখা প্রাণোচ্ছ্বল আড্ডা, হলুদ গাদা ফুল, টুটুল, শিপলুর ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট, লুঙি পরা বন্ধু শিপনের মাস্তানি, বৃষ্টি শেষের বিকেলে রংধনু দেখার সাঁকো, রিপার জন্য আমার বন্ধুর ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার হুমকি। যদিও স্মৃতিপট তবুও আজো আমার বুঁকে কাপন জাগায়। আমার মিথোম্যানিয়া। আজকের জয়পাড়াকে আমি আর ভালোবাসি না। এ জয়পাড়া একেবারেই আমার না। আমার জয়পাড়া লুটপাট হয়ে গেছে। আমিও রানুর মতো একদিন বলে এসেছি, এ বাইত্তে আর থাকুম না।

দুই.
গাংপাড়ের বিলকিস ফাঁস নিতে পেতি গাবগাছটাতে চড়ে বসেছে। হাতে গরু বাঁধার এক গোছা দড়ি। চোখ মুখে সন্ধ্যার ঘন ছায়া। পাল্টে গেছে কণ্ঠস্বরও, কিছুটা ভয়ার্ত মানুষের মতো শোনাচ্ছে তার কথাবার্তা। আমাকে যেন সে চিনতেই পারছে না। অথচ যে রাতে খাটের নিচে থেকে আমাকে বের করে এনে বুকে চাপ দিয়ে ধরে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য নানা কথায় বুঝিয়েছিল, সে রাতেও বলে নাই, তার মনে একটা মানুষ আছে যাকে ছাড়া আর কারো কাছে সে এ জীবনে বিয়ে বসবে না।

তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই। নানারকম বুনোফল খাই। কোনো কোনো দিন চতুর্দিকে চোখ রাখা ডোবার কচুরিপানা ফুল খেয়ে দেখি আবার কখনো ভর দুপুরে বান্দরের লাঠি গাছে চড়ে ফুলের মতো হাওয়ায় দুলতে দুলতে হলুদ সোনালু ফুল খাই। একদিন দুপুরে ঝোপের আড়ালে ঘন জঙ্গলের ভেতর একটা গাব গাছের সন্ধান পেলাম। অনেক অনেক পাকা গাব। পকেট ভরে গেল আমার। পরে কলা গাছের ফাঁৎড়া জোগাড় করে পাকা গাবের মালা বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

স্মৃতির পাতায় অশ্রুজল নিয়ে আমি আজো ভাবি সেদিন আমি কতইনা খুশি ছিলাম! গাবগুলোতে ছিলো ক্ষীরের মতো রস! এমন জুসি গাব মায়ের অবশ্যই একবার খেয়ে দেখা উচিত। একবার মুখে দিলেই বুঝতে পারবে কেন আমি সারাদিন গাব খাই! মনের কোনে দারুণ পুলক বয়ে নিয়ে গেলাম মায়ের কাছে। কেমন যেন একটা গর্ব কাজ করছিলো নিজেকে নিয়েই। প্রায় ডজন খানেক গাব দিয়ে একটা ফলের মালা করেছি। মাকে পড়িয়ে দেব আজ। বাড়িতে ঢুকতেই মা আমাকে দেখলেন তারপরই মাইর শুরু! কিছু না শুনে, না বুঝে মারতেই থাকলেন আর বকতে থাকলেন তরে না কইছি আর গাব খাবি না! গাব খাইয়া খাইয়া মুখের লাগামে ঘাও বানাইছোস! জামা কাপড় ছিড়া হালাস, প্যান্টে কষ লাগাস, ধুইলেও যায় না!

সেদিন আমার মনে কী যে ভয়াবহ অভিমান কাজ করেছিল! শিশুদের মনোজগত নিয়ে আমাদের দেশে রিসার্চ খুব বেশি নেই। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, শিশুরা বড়দের চেয়েও অনেক বেশি সংবেদনশীল। বিজ্ঞান বলছে, শিশু-মস্তিষ্কের সামর্থ্য বা ক্ষমতা বিস্ময়কর। চাইল্ড অ্যামনেশিয়া স্বীকার করলেও ইন্দ্রিয়লব্ধ বিশেষ কিছু তথ্য মস্তিস্কে চিরকাল রয়ে যায়। হয়তো শৈশবের সেইসব স্মৃতির সাথে আমার স্নায়ুর সংযোগ কখনো চ্ছিন্ন হয়নি। ফলে এখনো যখন ওই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবার দিনটির কথা মনে পড়ে, কান্না এসে যায়। শৈশবের একান্ত কিছু স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে রয়ে গেছে যা আমার কাছে সব সময়ই খুব দামি।

নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরি জনগোষ্ঠী নিজেদের অতীতকে খুব গুরুত্ব দেয়। তাদের অনেকে আড়াই বছর বয়সের স্মৃতিও সযত্নে ধরে রেখেছে। একদল গবেষক মনে করেন, স্মৃতির বিবরণ প্রকাশে ভাষার তাৎপর্য অনেক। ভাষা স্মৃতিকে সুসংবদ্ধ করে একটা বিশেষ রূপ দেয়। এভাবে একটা গল্প তৈরি হয়।

সেদিন মায়ের পিটুনি খেতে খেতে আমি যখন সইতে পারছিলাম না তখন কাঁদতে কাঁদতে বলে ফেলি, আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, আমি আর এ বাড়িতে থাকবো না। মা মারা বন্ধ করেন। আমি এরপরই হাঁটা ধরলাম বকুলদের বাড়ির পাশ দিয়ে ফিরিঙ্গিদের ফেলে যাওয়া কবরগুলো পেরিয়ে। চলে যাচ্ছি বাড়ি ছেড়ে। হাঁটতে হাঁটতে বুকের ভেতর খুব কষ্ট টের পেলাম। শেষবারের মতো নিজের বাড়ি দেখার জন্য কিংবা মায়ের মুখটা দেখার জন্য ফিরে তাকালাম। দেখি মা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। মা তার নিজের ভুলটা বুঝে পেছন পেছন আমাকে নিতে আসছেন কিনা এটা দেখার জন্য কয়েক কদম এগিয়ে আবার পেছনে ফিরে তাকালাম। দেখি মা চিৎকার করে বলছেন, যা, আবার এদিকে চাস ক্যান? খিদা লাগলে ঠিকই আবিনে আবার!

আমার ছোট্ট শিশু মনটা মায়ের ওই কথাতেই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। আমি সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম।

ক্লাশ ফোরে পড়ি। সে সময় সত্যি আমার সারাদিন ক্ষুধা লাগতো! এমন কোনো গাছলতাপাতা নাই যা আমি খেয়ে দেখিনি, বেশিরভাগ গাছের পাতাই খুব কষ! খেলেই ওয়াক করে বমি এসে যায়। বন জঙ্গলের ভেতর এত সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটে, আহা বেশিরভাগই ভয়ঙ্কর তিতা! এজন্যই হয়তো গরু ফুল খায় না।

বাড়ি ছাড়ার প্রথম রাতটা ফিরিঙ্গি বাড়ির স্কুল ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। পরের দিন সকাল থেকে খুব ক্ষুধা লাগতে থাকলো। আমি গাঙপাড়ের পোড়া বাড়ির জঙ্গলে ঢুকে লতাপাতা, অচেনা বুনোফল খেতে শুরু করলাম। হঠাৎ সাপ খেলা দেখার সময় সাপুড়েদের কাছ থেকে জানা এক প্রকার লতা দেখে চিনতে পারলাম। সাপুড়েরা বলেছিল, সাপের মুখে বিষ হয়। কারণ তারা একধরনের লতা খায় যার নাম কুমড়ো লতা। আমি সেই লতার নরম ডগাগুলো ছিড়ে ছিড়ে খেলাম। ভয়ঙ্কর তিতা! তবুও খেলাম আর ভাবতে থাকলাম, একদিন আমারো মুখে সাপের মতো বিষ জমা হবে তখন কারো সাথে ঝগড়া হলে আমি শুধু একটা কামড় দেব! আরো একটা ভয়ঙ্কর ভাবনা এলো মনে। বাবাকেও একটা কামড় দিতে হবে।

গাঙের ওপাড়ে চাষাবাদের জমি জমা। এক সাঁতারে ওপাড়ে চলে গেলাম। আগের কয়েকটা দিন বৃষ্টি হয়েছিল। সেই বৃষ্টিতে একটা জমিতে মিষ্টি আলুর কুড়ি জেগে ওঠেছে। সেই কুড়ি ধরে গর্ত খোড়া শুরু করলাম। মাটির নিচে বিরাট এক মিষ্টি আলু! ক্ষুধায় আমার তখন আর কোনোদিকে খেয়াল নাই। হঠাৎ কেডারে বলে চিৎকার দিয়ে ওই জমির মালিক একটা দাঁ নিয়ে ধাওয়া করলেন আমাকে। আমি প্রাণভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম খালের পানিতে। ওই লোকটাও পেছন পেছন এলেন ছুটে। আমি বাড়ি পর্যন্ত দৌড়ে এলাম। বাড়ির কোণে এসেই আমার মনে পড়লো, আমিতো বাড়ি ছেড়ে চলে গেছি! তাছাড়া ওই জমিঅলা বিচার নিয়ে বাড়িতে আসবে, সেটাও প্রায় নিশ্চিত। ভয়ে উল্টা দিকে দিশেহারা হয়ে ছুটতে ছুটতে আবার গাঙপাড়ের গাব গাছের ঘন জঙ্গলটতে গিয়ে লুকালাম।

জঙ্গলের কাছেই বিলকিস আপাদের বাড়ি। সন্ধ্যার দিকে চুপে চুপে তাদের একটা ঘরে ঢুকে খাটের নিচে বসে রইলাম। রাতে এমন ক্ষুধা লাগলো কিছুতেই আর কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। কান্না শুনে বিলকিস আপা ভয়ে তার মাকে ডাকলেন। সবাই এসে খাটের নিচ থেকে আমাকে বের করে আনলেন। জানতে চাইলেন কি হইছে? আমি কাঁদতেই থাকলাম। তারা আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। এ কথায় আমার কান্না আরো বেড়ে গেল এবং আমি জানালাম আমি বাড়িতে যাব না কিছুতেই। পরে বিলকিস আপা আমাকে ভাত এনে দিলেন এবং খুব করে অনুনয় করতে লাগলেন খাবার জন্য আমি সেই ভাত খেতে বসেও পারলাম না খেতে। কিছুতেই কান্না থামছে না আমার। পেট মোচড় দিচ্ছে বারবার! পরে তারা নিশ্চিত করলেন বাড়ি যেতে হবে না। তাদের বাসাতেই থাকবো আমি।

সেদিন বিলকিস আপার সাথে রাতে ঘুমাতে গেলাম। তিনি সারারাত গল্প শোনালেন আমাকে। সকালবেলা সবার আগে আমি ওই বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে গেলাম। মেঘুলা বাজারের ওপাশে নদীর ঘাটে গিয়ে একটা ট্রলারের ছাদে ওঠে বসলাম। তারপর জয়পাড়ায় নেমে পায়ে হেঁটে প্রায় সাত-আট কিলোমিটার দূরে বোনের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে অনেকদিন থাকলাম। কত বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা যে হলো আমার.. জীবনে প্রথমবারের মতো চাইল্ড এবিউজিংয়ের শিকার হলাম ওইবার। তারপর আপা আমাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু আমার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।

গাঙপাড়ের সেই বিলকিস আপাও একদিন পালিয়ে যায়। তারপর আর তার সাথে আমার দেখা হয়নি। আমার শৈশবের অনেক স্মৃতিই হয়তো সত্যিকারের স্মৃতি নয়। যেহেতু আমার মন ছাড়া এসব ঘটনা আর কোথাও লেখা নেই। তবে মানুষ অবচেতন মনে অতীতের নানারকম ঘটনার টুকরো টুকরো অংশ নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে মনে করার চেষ্টা করে। মানুষের মস্তিষ্কে স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কোষগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা লাগে। বিজ্ঞান বলছে, সংযোগ স্থাপনকারী তন্তুগুলোর নাম হল ‘সিন্যাপ্স’। কোষে কোষে জমা হওয়া তথ্যগুলোকে আমাদের মস্তিষ্ক বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে রাখে, যাকে বলা হয় ‘কন্সোলিডেশন’। কোনো কিছু মনে রাখতে হলে ওই স্মৃতিগুলোকে মাঝে মাঝে মনে করতে হবে, যাতে সিন্যাপ্স এর সংযোগগুলো আবার কাজ করার সুযোগ পায়। আমি হয়তো এটাই করেছি আজীবন।

যেমন ৯ মাস বয়সে আমার বাবা যে আমাকে পানিতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিটাও আমার মনে আজীবন রয়ে গেছে। ওই যে ক্লাশ ফোরে মুখে সাপের মতো বিষ হোক এই কামনা করে কুমড়ো লতা খেয়ে বাবাকে একটা কামড় দিতে চাইতাম! গবেষণা বলছে, হাইলি সুপেরিয়র অটোবায়োগ্রাফিক্যাল মেমোরি অনেকের থাকতে পারে। যারা কোনো কিছুই সহজে ভুলতে পারে না। অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক বিষয় নিয়ে সেসব মানুষ মাত্রাতিরিক্ত অবসেশনে ভুগতে থাকে। এটা একটা ক্লিনিক্যাল মানসিক পরিস্থিতি। যেমন, কেউ একজন হয়তো অনেকদিন আগে ওই হাইলি সুপিরিয়র অটোবায়োগ্রাফিকাল মেমোরি সমৃদ্ধ মানুষটার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল যাকে তিনি আর কোনোদিন ভুলতে পারেননি। তবে আমি আমার বাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছি অনেক আগেই। বাবা এখন আর বেঁচে নেই। ঈদ এলেই আমার বাবাকে খুব মনে পড়ে।

তিন.
ঘোটা কুনি পিওন চাচা চিঠি নিয়ে এসেছে। খামের ভেতর ফিরোজা কালারের অনেকগুলো কাগজ। উঠানে বসে আমি চিঠি পড়ছি আর হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছেন আমার বাবা। একটা জলচৌকিতে তিনি বসে আছেন শক্ত হয়ে। দুই লাইন শোনার পরই কতক্ষন কাঁদেন। আমি বুঝি এ কান্না কষ্টের নয়, আবেগে আপ্লুত হবার কান্না। শৈশবে আমাকে কাঁধে করে গান গাইতে গাইতে যে ভাইটা গাঙপাড়ে গোসল করতে নিয়ে যেতেন, প্রবাসে চলে যাওয়া সেই ভাইয়ের চিঠি এসেছে আজ। আগ্রহ ভরে আমি মেঝো ভাইয়ের সেই চিঠি পড়তে থাকি...

বাবা, আমার সালাম ও কদমবুছি রহিলো। বাড়ির ছোট বড় সকলের প্রতি আমার দোয়া ও সালাম জানাবেন। কাকা ও ফুপুজানকে আমার সালাম দিবেন। হাবিব-কামরুল ওদের প্রতি আমার আদর ও দোয়া রহিলো। গত কিছুদিন আগে আপনার পত্র পেয়ে সকল সংবাদ অবগত হলাম।

বাবা, ভাইয়ের ব্যাপারে অনেক কিছু লিখেছেন যার উত্তরে আমি কিছুই লিখতে পারলাম না। সে আমার কাছে অনেকদিন পত্র দেয় না এবং তার ব্যাপারে আমার কিছু বলাও ঠিক নয় কারণ সে আপনার বড় ছেলে। আমার চেয়ে তার দায়িত্ব অনেক বেশি। বর্তমানে আমার মনে হয় ভাইয়ের বৌ যা করে খুশি থাকে তাই করুক তাতে সংসারে একটু শান্তি থাকবে। তারপর ভাই যখন দেশে যায় তখন একটা কিছু করা যাবে। কোরবানির টাকা দেই নাই, কি কোরবানি দিলেন তাহাও জানতে পারলাম না। আপনার টাকা যখনই প্রয়োজন হয় আমাকে লিখবেন। আপনি কোনো প্রকার কষ্ট করবেন না। টাকার জন্য ভাইয়ের আশায় বসে থেকে নিজেরা কষ্ট করবেন আর আমি এখানে সুখে খাব, এটা হয় না। আমি ইচ্ছা করে টাকা পাঠাচ্ছি না কারণ এই মাসের ২৮ তারিখ আমাদের এয়ারপোর্টের কাজ শেষ। এখন কি করে বলা যায় না। যদি দেশে পাঠিয়ে দেয়! এদিকে অনেক চেষ্টা করেও একটি ভিসার ব্যবস্থা করতে পারলাম না। দেখি কপালে কি আছে!

আর এমারতকে না হয় এবার জয়পাড়াতেই ভর্তি করেন। ও যদি ঢাকা পড়ে তাহলে কহিনুরকে কে দেখবে? হয়তো এমারতের একটু ক্ষতি হবে। জয়পাড়া কলেজে লেখাপড়াতো তেমন ভালোনা। কিন্তু কি করা যাবে? তবে এমারত পাশ করেছে শুনে খুব খুশি হয়েছি। আমিতো মনে করেছিলাম পাশ করতে পারবে না। কত যে আল্লাকে ডেকেছি তা আল্লাহতালাই জানে। যাক, আল্লাহ আমার ডাক শুনেছে হাজারো শুকরিয়া তার দরবারে। আপনি কোনো প্রকার চিন্তা করবেন না। ভালো খাওয়া দাওয়া খাবেন। আমি ভালো আছি জানবেন। আর ফুপুজানকে জিজ্ঞাসা করবেন বিদেশ থেকে তার জন্য কি জিনিস আনতে হবে। আজ আর নয়, ইতি আপনার বাবুল।

আমার সেই জেদি আর আবেগী কৃষক বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আজ ঈদের দিন। কারো সাথে যোগাযোগ করিনি। আমার যোগাযোগের দরকার হয় না! আমি ঢাকায় অচিন একাকিত্ব নিয়ে বসে থাকি। আমার মিথোম্যানিয়া! প্রতিরাতে চোখ বন্ধ করলে অন্ধকারের অপরূপ আলোয় আমার ভেতরে অন্য এক পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সে পৃথিবীতে প্রাচীন এক উঠানে বসে আমি আমার বাবাকে আজ তার প্রিয় সন্তানের একটি চিঠি পড়ে শোনালাম। বাবা, আমার কান্না কেউ দেখতে পায়নি। আপনার মৃত্যুর দিন শত শত মানুষের ভিড়ে আমি মিষ্টি খেতে চেয়েছিলাম।

বাবা, মেঝো ভাই আমার আর গাঙপাড়ের জনা মোল্লার মেয়ে ফরিদা আপার বিষয়ে চিঠিতে যে কিছুই লিখলো না! এখন ফরিদা আপা জানতে চাইলে আমি কি বানায়ে বানায়ে বলবো?

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী