
শ্রেয়া চক্রবর্তী
শ্রেয়া চক্রবর্তীর আত্মগদ্য ‘রাত গভীরের সংলাপ’
প্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০২১
১৫.
সম্ভাবনার বীজ বোনে নারী। পেটের ভেতর একটি প্রাণের অঙ্কুর কী অদ্ভুত নিয়মে রোপিত হয়। প্রকৃতির কেবল একটিই অপেক্ষা। আরেকটি নতুন প্রাণের। পরাগের অপেক্ষায় বসে থাকে অনিষিক্ত প্রাণ। একটি সম্ভাবনা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়, কারণ সে খণ্ডিত। তার বাকি অর্ধেক অন্য কোথাও পরাগধানীর ভেতর সুষুপ্তিতে পড়ে আছে। অথচ দেখা হলেই অসম্ভব কিছু একটা ঘটে যেতে পারত। যে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় না বহু রক্তক্ষরণকে সাক্ষী রেখে সে কেবল ঝরে যায় নতুন সম্ভাবনার পথ প্রশস্ত করবে বলে। এত এত সম্ভাবনারা সত্যি হয়ে উঠবে না বলেই মানুষ আজীবন পাথর ভাঙে, কবিতা লেখে, দূরদেশে পাড়ি দেয়, ভালোবাসায় খুন হয়ে পড়ে থাকে শহরের রাস্তায়।
১৬.
আমি কোনদিন ওড়না ব্যবহারে খুব একটা স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। ব্যাগ সামলে বাসে কিংবা ট্রেনে ওটাকে আমার অতিরিক্ত ঝামেলা মনে হতো। হয় এদিকে ঝুলে যায়, নয় ওদিকে। কলেজে গেলাম যখন জুটে গেল একদল পিছনে ফিসফাস করা দল। চিরদিনই জুটেছে। আমার ওড়না ব্যবহার না করা নিয়ে তাদের আপত্তি। আরও কত সামান্য কিছু নিয়েই। শালীনতা বলে একটি বিষয় যে আছে সে আমি জানি। মানিও। তার সাথে এটাও মানি, ব্যক্তি রুচি ও দেহসৌষ্ঠব অনুযায়ী শালীনতার সংজ্ঞা আলাদা হতে পারে। শালীনতার থেকেও যার ওপর আমি বেশি আস্থা রাখি সে হলো নন্দনতত্ত্ব। সে যাই হোক, বিষয় সেটা নয়। বিষয় হলো একটি বিশেষ দেহাংশকে নিয়ে মেয়েদের সারাক্ষণ এত সচেতন করে রাখা হয় কেন? হয় তাকে আড়াল করো নয় তাকে সচেতনভাবে উন্মোচিত হতে দাও অথবা নকল ময়ূর পুচ্ছের মতো কৃত্রিমতায় তাকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলো বা তাকে আরও উন্নত করে তুলে সারাক্ষণই মনে মনে তার বিশেষত্বকে বিস্মৃত না হতে দাও।
যৌন আবেদন খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলো, যখন কোনো সমাজে যৌনতার মধ্যে দিয়ে কোরো একটি বিশেষ লিঙ্গকে অসম্মান করার দৃষ্টিভঙ্গি জুড়ে যায়। এর কারণ বহুমুখী, যেমন সার্বিক হতাশা, যথেষ্ট যৌনশিক্ষার অভাব, কোনো একটি বিশেষ শ্রেণিকে অসম্মান করাটাই যখন দস্তুর ও যৌনতা সেখানে একটি অস্ত্র মাত্র এবং সর্বোপরি অবদমিত ও অমীমাংসিত যৌন কামনা যেগুলো থাকলে তবেই একটি সমাজ ধর্ষকামী হয়ে উঠতে পারে। এর পরেও আরেকটি বিষয় আছে। অনেক বছর আগে এক ভোরবেলা কেউ সজোরে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছিল। ঘুম চোখে দরজা খুলতেই কাঁপতে কাঁপতে যে ধরাম করে পায়ের কাছে এসে পড়েছিল সে আমাদের পাশের বাড়ির কাজের মেয়ে। প্রায় হুইলচেয়ার নির্ভর এক আশি বছরের বৃদ্ধকে সে দেখাশোনা করত। গভীর রাতে অসুস্থ ও অক্ষম ওই বৃদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মেয়েটির ওপর। এমন অসুস্থতাকে ভেতরে লুকিয়ে রেখেই এ সমাজ আজও নারীকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
আমি যে নারী তা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক কেবল আমার পুরুষ প্রেমিকের কাছে। কিন্তু যাকে আমি জন্ম দিয়েছি, যার আমি সন্তান, যার আমি বন্ধু, এবং আমার যে কর্মক্ষেত্র সেখানে আমি নারী না পুরুষ এর প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? কেন আমার বারবার মনে পড়ে যাবে যে, আমি একজন মহিলা? কেন আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়া হবে যে, আমার মগজাস্ত্রের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আমার আছে, যাকে যৎপরনাস্তি আগলে রাখা সাজিয়ে রাখা সবার চোখে নিঁখুত দেখানো কর্তব্য আমার, সে আমার মহা স্তনযুগল! এসমাজ আসলে এক অসুখী সমাজ। যৌনতায় কেবল তার মুক্তি নেই,আছে তার যাবতীয় প্রতিশোধ।
১৭.
মাঝে মাঝেই গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পড়া ভালো। ত্বক চুঁইয়ে জল ঢুকুক শরীরের প্রতি কোষে। কোষ বেয়ে অন্তরাত্মায়। ইনফিলট্রেশন... ছুঁয়ে যাক প্রতিটি সুখানুভূতি ও বেদনা। সেই যে ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, যাওয়ার সময় দুম করে ছুঁড়ে দিলো কিছু কথা, বুকের ভেতর সেই কথা লেগে রক্তক্ষরণ ও কালশিটে তার ওপর জল এসে লাগুক...
কথা রাখেনি যে, রেখে গেছে সাপের খোলসের মতো ঘোলাটে অবিশ্বাস, মাথার ভেতর বিষপাত্রে রোজ দু’এক ফোঁটা করে যে গ্রাস করে নিচ্ছে তোমার সত্তাকে, সেই অবিশ্বাসের গোড়ায় এসে লাগুক জল... সুখ জমে জমে উইয়ের ঢিবি হয়ে আছে যে পিঠের ওপর সেখানেও জল দিয়ে চোখ বুজে দাঁড়াও বারবার...
ঈর্ষা গেঁজিয়ে উঠে পচা মদের মতো বিষাক্ত করছে তোমার শিরা উপশিরা। ভাবছো ওই মদ অন্যকে গিলিয়েই শান্তি। নাহ্ জল নাও তোমার রক্তে। জল নাও আকণ্ঠ। জল নাও নাভিকোষে। তোমার মাথা থেকে পা অবধি তোমায় ধুয়ে দিতে পারে জল... বিশ্বাস না হলে পরখ করে দেখো। যাও ঝর্ণাতলে। নিজেকে স্নান দাও, বারবার দাও...
১৮.
সামান্য মতান্তর হলে মানুষে মানুষে বিচ্ছেদ হয়। ঘর ভাঙে। ভাঙে পরিবার। যে যার মতো বেছে নেয় পথ। অথচ আমরা স্বপ্ন দেখি হাজার পথ হাজার মত আর তারচেয়েও বেশি মতানৈক্য নিয়ে একটি দেশ অখণ্ড থেকে যাবে। দুটো মানুষ ভিন্নমতে বিশ্বাসী হয়ে একটি ছাদের নিচে টিকে থাকতে পারে না, টিকে থাকলেও প্রেমে থাকে কদাচিৎ, কারণ মানুষ তার বিশ্বাসের কাছে এমনই বশীভূত। আর কোটি কোটি মানুষের রক্তাক্ত স্বাতন্ত্র্যকে আমরা ধারণ করার স্বপ্ন দেখি দেশপ্রেমের অছিলায়। `ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি` মাঝে মাঝে মনে হয় এ আসলে সোনার পাথরবাটি! কিংবা সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ।
১৯.
সেল্ফ লাভ` নিয়ে একটা গদ্য লিখব ভাবছিলাম। তো ভাবতে গিয়ে মনে হলো, বাংলায় ভালোবাসা ও প্রেম বলে দুটি শব্দ আছে। মা সন্তানকে ভালোবাসে। আর পাড়ার অমুক ছেলেটি তমুকের মেয়ের সাথে প্রেম করে। অর্থাৎ ভালোবাসার সাথে যৌন আকর্ষণ যুক্ত হলেই তা প্রেম। ইংরেজিতে দুটোই Love. Mother loves her baby. He is in love with her, অর্থাৎ দুটি ভিন্নধর্মী সম্পর্কের গোড়ার আসক্তি যে ভালোবাসা তাকেই মান্যতা দেয়া হয়েছে। যৌনতা একটা প্রয়োজন, আহার নিদ্রা কিংবা শৌচ কর্মের মতোই একটা কম্পালশন। ভালোবাসাও এক ধরনের কম্পালশন,যখন তা নিজের প্রতি। নিজের প্রতি যে ভালোবাসায় মানুষ আসক্ত, সেটাই তাকে অন্য মানুষের প্রতি আসক্তি বা ভালোবাসায় আবদ্ধ করে। নিজের প্রতি ভালোবাসার যে ধর্ম বা প্রকৃতি তা প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে কিছুটা এক আবার অনেকটাই আলাদা, সেই অনুরূপে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের ওপর যেভাবে নির্ভরশীল বা কখনো কখনো অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে তার প্রকৃতিও আলাদা।
তবে নিজের প্রতি যে ভালোবাসা সেটাই সকল ভালোবাসার উৎস, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিজেকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলার ভাব আসলে ভাণ মাত্র। কারণ যে ভালোবাসা আত্মসুখের পরিপন্থী হয়ে ওঠে তাতে মানুষ থেকে যেতে পারে একমাত্র বাধ্য হয়ে ও তা কতখানি ভালোবেসে থাকা তাতে আমার গভীর গভীরতর সন্দেহ আছে। একজন মানুষের জীবনের কেন্দ্র বিন্দু সে নিজেই। সকল কিছুই আছে বা অনেক কিছুই নেই এই অনুভবের একমাত্র বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তার নিজস্ব উপস্থিতি। নিজেকে ভালোবাসা পবিত্র কর্তব্য। একজন মানুষ অন্যকে যেভাবে ভালোবাসে যতটুকু সততার সাথে বাসে তা তার নিজের প্রতি ভালোবাসা ও সততারই প্রতিফলন। যে দুটি মানুষের নিজের প্রতি ভালোবাসার ধরনটি খানিক এক তারা একসাথে অনেকটা পথ চলতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। একে অপরের প্রতি যে ভালোবাসা ও তৎজনিত যে আনন্দ তাও দীর্ঘস্থায়ী হবে। যদিও দরিদ্র দেশের সমাজ উল্টোটাই বলবে। আপনাকে মহান হতে বলে বলিতে চড়াবে। আপনি ফেক অর্গাজমের আনন্দে চোখ বুজে থাকবেন আর ওরা স্যাডিস্টিক প্লেজার নিতে নিতে আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসবে।
যাহ্। লিখব না লিখব না করে এতটা লিখে ফেললাম!
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক