সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জনপ্রিয় একগুচ্ছ কবিতা

প্রকাশিত : জুন ২৫, ২০২০

কবি ও ছড়াকার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আজ মৃত্যুদিন। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ১৯২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নিকটবর্তী নিমতা গ্রামে তার জন্ম। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত জনপ্রিয় কয়েকটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

ইলশে গুঁড়ি

ইলশে গুঁড়ি          ইলশে গুঁড়ি
              ইলিশ মাছের ডিম
ইলশে গুঁড়ি          ইলশে গুঁড়ি
              দিনের বেলায় হিম।
           কেয়াফুলে ঘুণ লেগেছে,
        পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে,
       মেঘের সীমায় রোদ হেসেছে
             আলতা-পাটি শিম।
ইলশে গুঁড়ি          হিমের কুঁড়ি,
             রোদ্দুরে রিম্ঝিম্।
হালকা হাওয়ায়          মেঘের ছাওয়ায়
             ইলশে গুঁড়ির নাচ,
ইলশে গুঁড়ির          নাচন্ দেখে
            নাচছে ইলিশ মাছ।
কেউ বা নাচে জলের তলায়
ল্যাজ তুলে কেউ ডিগবাজি খায়,
নদীতে ভাই জাল নিয়ে আয়,
           পুকুরে ছিপ গাছ।
উলসে ওঠে মনটা, দেখে
           ইলশে গুঁড়ির নাচ।

  ইলশে গুঁড়ি          পরীর ঘুড়ি
           কোথায় চলেছে,
ঝমরো চুলে          ইলশে গুঁড়ি
           মুক্তো ফলেছে!
      ধানেক বনে চিংড়িগুলো
    লাফিয়ে ওঠে বাড়িয়ে নুলো;
    ব্যাঙ ডাকে ওই গলা ফুলো,
           আকাশ গলেছে,
বাঁশের পাতায়          ঝিমোয় ঝিঁঝি,
            বাদল চলেছে।

মেঘায় মেঘায়          সূর্য্যি ডোবে
          জড়িয়ে মেঘের জাল,
ঢাকলো মেঘের          খুঞ্চে-পোষে
          তাল-পাটালির থাল।
       লিখছে যারা তালপাতাতে
      খাগের কলম বাগিয়ে হাতে
     তাল বড়া দাও তাদের পাতে
           টাটকা ভাজা চাল;
পাতার বাঁশি          তৈরি করে
          দিও তাদের কাল।

  খেজুর পাতায়          সবুজ টিয়ে
           গড়তে পারে কে?
তালের পাতার          কানাই ভেঁপু
           না হয় তাদের দে।
     ইলশে গুঁড়ি   জলের ফাঁকি
      ঝরছে কত বলব তা কী?
      ভিজতে এলো বাবুই পাখি
          বাইরে ঘর থেকে;
পড়তে পাখায়          লুকালো জল
        ভিজলো নাকো সে।

  ইলশে গুঁড়ি!          ইলশে গুঁড়ি!
          পরীর কানের দুল,
  ইলশে গুঁড়ি!          ইলশে গুঁড়ি!
          ঝরো কদম ফুল।
      ইলশে গুঁড়ির খুনসুড়িতে
     ঝাড়ছে পাখা   টুনটুনিতে
    নেবুফুলের          কুঞ্জটিতে
         দুলছে দোদুল দুল্;
ইলশে গুঁড়ি           মেঘের খেয়াল
         ঘুম-বাগানের ফুল।

ছিন্নমুকুল

সবচেয়ে যে ছোট পিঁড়ি খানি
সেখানি আর কেউ রাখে না পেতে,
ছোট থালায় হয় নাকো ভাত বাড়া
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে।
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট
খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল,
তারই খাওয়া ঘুচেছে সব আগে।

সবচেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি,
খুশি ছিল ঘেষাঘেষির ঘরে,
সেই গেছে হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে,
দিয়ে গেছে জায়গা খালি করে।
ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি।
ভয়ভরা সে ছিল যে সব চেয়ে
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।

হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ওরে!
হারিয়ে গেছে `বোল` বলা সেই বাঁশি
দুধে ধোওয়া কচি সে মুখখানি
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলী ফুলের রাশি,
ঢুকেছে হায় শশ্মান ঘরের মাঝে
ঘর ছেড়ে হায় হৃদয় শশ্মানবাসী।

সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট,
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।

দূরের পাল্লা

ছিপখান তিন-দাঁড়
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিন-ভোর
দ্যায় দূর-পাল্লা!
         পাড়ময় ঝোপঝাড়
         জঙ্গল-জঞ্জাল,
         জলময় শৈবাল
         পান্নার টাঁকশাল।
কঞ্চির তীর-ঘর
ঐ-চর জাগছে,
বন-হাঁস ডিম তার
শ্যাওলায় ঢাকছে।
         চুপ চুপ ওই ডুব
         দ্যায় পান্ কৌটি
         দ্যায় ডুব টুপ টুপ
         ঘোমটার বৌটি!
ঝকঝক কলসির
বক্ বক্ শোন্ গো
ঘোমটার ফাঁক বয়
মন উন্মন গো।
         তিন-দাঁড় ছিপখান
         মন্থর যাচ্ছে,
         তিনজন মাল্লায়
         কোন গান গাচ্ছে?
রূপশালি ধান বুঝি
এইদেশে সৃষ্টি,
ধুপছায়া যার শাড়ি
তার হাসি মিষ্টি।
         মুখখানি মিষ্টিরে
         চোখদুটি ভোমরা
         ভাব-কদমের ভরা
         রূপ দেখ তোমরা!
ময়নামতীর জুটি
ওর নামই টগরী,
ওর পায়ে ঢেউ ভেঙে
জল হোলো গোখরী!
         ডাক পাখি ওর লাগি
         ডাক ডেকে হদ্দ,
         ওর তরে সোঁত-জলে
         ফুল ফোটে পদ্ম।
ওর তরে মন্থরে
নদ হেথা চলছে,
জলপিপি ওর মৃদু
বোল বুঝি বোলছে।
         দুইতীরে গ্রামগুলি
         ওর জয়ই গাইছে,
         গঞ্জে যে নৌকা সে
         ওর মুখই চাইছে।
আটকেছে যেই ডিঙা
চাইছে সে পর্শ,
সঙ্কটে শক্তি ও
সংসারে হর্ষ।
         পান বিনে ঠোঁট রাঙা
         চোখ কালো ভোমরা,
         রূপশালী-ধান-ভানা
         রূপ দেখ তোমরা

দুই.
পান সুপারি! পান সুপারি!
এইখানেতে শঙ্কা ভারি,
পাঁচ পীরেরই শীর্ণি মেনে
চলরে টেনে বৈঠা হেনে;
বাঁক সমুখে, সামনে ঝুঁকে
বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে
বুক দে টানো, বইটা হানো
সাত সতেরো কোপ কোপানো।
হাড়-বেরুনো খেজুরগুলো
ডাইনি যেন ঝামর-চুলো
নাচতে ছিল সন্ধ্যাগমে
লোক দেখে কি থমকে গেল।
জমজমাটে জাঁকিয়ে ক্রমে
রাত্রি এলো রাত্রি এলো।
ঝাপসা আলোয় চরের ভিতে
ফিরছে কারা মাছের পাছে,
পীর বদরের কুদরতিতে
নৌকা বাঁধা হিজল-গাছে।

তিন.     
আর জোর দেড় ক্রোশ
জোর দেড় ঘণ্টা,
টান ভাই টান সব
নেই উৎকণ্ঠা।
         চাপ চাপ শ্যাওলার
         দ্বীপ সব সার সার,
         বৈঠৈর ঘায়ে সেই
         দ্বীপ সব নড়ছে,
         ভিল্ ভিলে হাঁস তায়
         জল-গায় চড়ছে।
ওই মেঘ জমছে,
চল্ ভাই সমঝে,
গান গাও দাও শিশ,
বকশিশ! বকশিশ!
         খুব জোর ডুব-জল
         বয় স্রোত ঝিরঝির,
         নেই ঢেউ কল্লোল,
         নয় দূর নয় তীর।
নেই নেই শঙ্কা,
চল্ সব ফূর্তি,
বকশিশ টঙ্কা,
বকশিশ ফূর্তি।
         ঘোর-ঘোর সন্ধ্যায়,
         ঝাউ-গাছ দুলছে,
         ঢোল-কলমীর ফুল
         তন্দ্রায় ঢুলছে।
লকলক শরবন
বক তায় মগ্ন,
চুপচাপ চারদিক
সন্ধ্যার লগ্ন।
         চারদিক নিঃসাড়,
         ঘোর-ঘোর রাত্রি,
         ছিপ-খান তিন-দাঁড়,
         চারজন যাত্রি।

চার.  
জড়ায় ঝাঁঝি দাঁড়ের মুখে
ঝউয়ের বীথি হাওয়ায় ঝুঁকে
ঝিমায় বুঝি ঝিঁঝির গানে
স্বপন পানে পরাণ টানে।
        তারায় ভরা আকাশ ওকি
        ভুলোয় পেয়ে ধূলোর পরে
        লুটিয়ে পল আচম্বিতে
        কুহক-মোহ-মন্ত্র-ভরে!

পাঁচ.  
কেবল তারা! কেবল তারা!
শেষের শিরে মানিক পারা,
হিসাব নাহি সংখ্যা নাহি
কেবল তারা যেথায় চাহি।
        কোথায় এলো নৌকাখানা
        তারার ঝড়ে হই রে কানা,
        পথ ভুলে কি এই তিমিরে
        নৌকা চলে আকাশ চিরে!
জ্বলছে তারা! নিভছে তারা!
মন্দাকিনীর মন্দ সোঁতায়,
যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে কোথায়
জোনাক যেন পন্থা-হারা।
        তারায় আজি ঝামর হাওয়া
        ঝামর আজি আঁধার রাতি,
        অগুনতি অফুরান তারা
        জ্বালায় যেন জোনাক-বাতি।
কালো নদীর দুই কিনারে
কল্পতরু কুঞ্জ কি রে?
ফুল ফুটেছে ভারে ভারে
ফুল ফুটেছে মাণিক হীরে।
        বিনা হাওয়ায় ঝিলমিলিয়ে
        পাপড়ি মেলে মাণিক-মালা;
        বিনি নাড়ায় ফুল ঝরিছে
        ফুল পড়িছে জোনাক জ্বালা।
চোখে কেমন লাগছে ধাঁধা
লাগছে যেন কেমন পারা,
তারাগুলোই জোনাক হলো
কিম্বা জোনাক হলো তারা।
        নিথর জলে নিজের ছায়া
        দেখছে আকাশ ভরা তারায়,
        ছায়া-জোনাক আলিঙ্গিতে
        জলে জোনাক দিশে হারায়।
দিশে হারায় যায় ভেসে যায়
স্রোতের টানে কোন্ দেশে রে?
মরা গাঙ আর সুর-সরিত
এক হয়ে যেথায় মেশে রে!
        কোথায় তারা ফুরিয়েছে, আর
        জোনাক কোথা হয় শুরু যে
        নেই কিছুরই ঠিক ঠিকানা
        চোখ যে আলা রতন উঁছে।
আলেয়াগুলো দপদপিয়ে
জ্বলছে নিবে, নিবছে জ্বলে
উল্কোমুখী জিব মেলিয়ে
চাটছে বাতাশ আকাশ-কোলে!
        আলেয়া-হেন ডাক-পেয়াদা
        আলেয়া হতে ধায় জেয়াদা
        একলা ছোটে বন বাদাড়ে
        ল্যাম্পো-হাতে লকড়ি ঘাড়ে;
সাপ মানে না, বাঘ জানে না,
ভূতগুলো তার সবাই চেনা,
ছুটছে চিঠিপত্র নিয়ে
রণরণিয়ে হনহনিয়ে।
        বাঁশের ঝোপে জাগছে সাড়া,
        কোল্-কুঁজো বাঁশ হচ্ছে খাড়া,
        জাগছে হাওয়া জলের ধারে,
        চাঁদ ওঠেনি আজ আঁধারে!
শুকতারাটি আজ নিশীথে
দিচ্ছে আলো পিচকিরিতে,
রাস্তা এঁকে সেই আলোতে
ছিপ চলেছে নিঝুম স্রোতে।
        ফিরছে হাওয়া গায় ফুঁ-দেওয়া,
        মাল্লা মাঝি পড়ছে থকে;
        রাঙা আলোর লোভ দেখিয়ে
        ধরছে কারা মাছগুলোকে!
চলছে তরী চলছে তরী
আর কত পথ? আর ক`ঘড়ি?
এই যে ভিড়াই, ওই যে বাড়ি,
ওই যে অন্ধকারের কাঁড়ি
        ওই বাঁধা-বট ওর পিছন্
        দেখছ আলো? ঐতো কুঠি
        ঐখানেতে পৌঁছে দিলেই
        রাতের মতন আজকে ছুটি।
ঝপ ঝপ তিনখান
দাঁড় জোর চলছে,
তিনজন মাল্লার
হাত সব জ্বলছে;
        গুরগুর মেঘ সব
        গায় মেঘ মল্লার,
        দূর-পাল্লার শেষ
        হাল্লাক্ মাল্লার!

উত্তম ও অধম

মূল: শেখ সাদী

কুকুর আসিয়া এমন কামড়
দিল পথিকের পায়
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তাই।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
জাগে শিয়রের আগে।
বাপেরে সে বলে ভর্ৎসনা ছলে
কপালে রাখিয়া হাত,
তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে
তোমার কি নাই দাতঁ?
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
‘তুই রে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়ে
দংশি কেমন করে?’
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে
মানুষের শোভা পায়?