সরকার আবদুল মান্নানের আত্মগদ্য ‘গ্রামের স্মৃতি: স্বাস্থ্য’
প্রকাশিত : জুন ২৭, ২০২০
সত্তর ও আশির দশকের কথা। তখন গ্রামের মানুষের খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার অবস্থা কেমন ছিল? আমরা জানি, সব কিছুই অর্থের সঙ্গে জড়িত, শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তখন মানুষের আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল, শিক্ষাদীক্ষার অবস্থা কেমন ছিল সেটি অনেক বড় ব্যাপার। সেজন্য ওই প্রসঙ্গ এখানে উথ্থাপন করব না। আমার স্মৃতিতে আমাদের গ্রামের মানুষের এবং আমাদের খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার অবস্থা কেমন ছিল তার একটি স্মৃতিনির্ভর পরিচয় দেব।
আমাদের গ্রামের নাম জহিরাবাদ। চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তরের এই গ্রামটি ছিল মেঘনার তীরে। অবশ্য মেঘনার একদম তীরে ছিল এখলাসপুর, জয়পুর, নাওভাঙ্গা। তার পাশেই ছিল জহিরাবাদ। নদী-তীরস্থ অন্যান্য যে কোনো গ্রামের মতই এই গ্রামটি ছিল সমৃদ্ধ। গ্রামের তিরিশ থেকে চল্লিশ ভাগ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেত, পড়াশোনা করত। আর্থিক অবস্থাও খুব খারাপ ছিল না। কিন্তু গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গোরু এবং পুকুর ভরা মাছ আমি কখনই দেখিনি, কোনো পরিবারেই না। অধিকন্তু যাদের অবস্থা ভালো মনে করা হতো, তারাও টানাটানির মধ্যে স্বচ্ছলতা বজায় রাখার চেষ্টা করত।
চাকরি বা ব্যবসার বিরল কিছু নজির বাদ দিলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবাই ছিল ভূমিনির্ভর। কেউ জমির মালিক, কেউ বর্গাচাষি এবং কেউ শ্রমিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে জমির মালিক বা বর্গাচাষি তাকেও অন্যের জমিতে কাজ করতে দেখেছি। যে মাঝি সেও ফসলের মাঠে কাজ করে। যে জেলে সেও ভূমিশ্রমিক। কাঠুরে, নাপিত, ধোপা, মিস্তিরি, কুটির শিল্পী সবাই আবার সুবিধা মতো কৃষিকাজে শ্রম দিত। এমন কি যে চাকরি করে কিংবা ব্যবসা করে সেও কৃষিবিচ্ছিন্ন ছিল না। ব্যবসা থেকে এসে কিংবা চাকরি থেকে ছুটিছাটায় এসে তাদেরকেও কৃষি জমিতে কাজ করেতে দেখেছি।
খাদ্য গ্রহণের চিত্রটা প্রায় একই রকম। সকালে পান্তা ভাত কিংবা শীতের সকালে আগের দিনের বাসি ভাত। তার সঙ্গে লবণ, পোড়া মরিচ ও পেঁয়াজ ।
শুকনো মরিচ ভেজে কাচের বোতলে রাখা হতো। যার দরকার সে বোতল ঝেকে ঝেকে মরিচ বের করে নিতে পারত। বোতলের মুখ বন্ধ থাকত মোটা পাটকাঠি দিয়ে। মুখ খোলা রেখে মার বকা খেয়েছি বহুবার। বোতলের মুখ খোলা থাকলে মরিচ নেতিয়ে যায়। মচমচে থাকে না। খাওয়া যায় না। এ ছাড়া ছিল বিচিত্র ভর্তা। কাচা মরিচের ভর্তা, শুকনো মরিচের ভর্তা, লাল মরিচের ভর্তা, গোল আলুর ভর্তা, বাসি তরকারির ভর্তা, শাকালুর ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, ডাল ভর্তা, কলা ভর্তা, বেগুন ভর্তা, মিষ্টি আলুর ভর্তা।
ভর্তা ছাড়া ছিল বাসি তরকারি, বাসি ডাল। এ ছাড়া কখনো কখনো হতো খিচুরি। সঙ্গে ওইসব ভর্তা। সত্তরের দশকে এসে আটা রুটির প্রচলন হয়। মাটির তাওয়ায় মা রুটি ভাজতেন আর আমরা তাওয়া থেকে ছোঁ মেরে রুটি নিয়ে খেতে শুরু করতাম। ভাজি, ডাল বা বাসি তরকারির অপেক্ষা করতাম না।
খুব ভোরে অবশ্য মুড়ি, চিড়ে ভাজা, কাউনের মোয়া, চাল ভাজা, সিম ভাজা, মটরশুঁটি ভাজা এইসব ভাজাপোড়া খাবারের ব্যবস্থা থাকত কখনো কখনো। বিশেষ করে শীতকালে কোছড় ভর্তি মুড়ি নিয়ে দলেবলে বসতাম গিয়ে সকালের মিষ্টি রোদে।
দুপুরে গরম ভাত এবং সঙ্গে শাক, মাছের তরকারি, ডাল, ভর্তা, বিচিত্র রকমের টক ঝোল, সাধারণ ঝোল। ঝোল রান্না করা হতো পানি দিয়ে কিংবা ভাতের মাড় বা ফেন দিয়ে।
হাস-মুরগীর মাংস বা গোরু-খাসির মাংস ছিল বিরল ঘটনা। মসলা সবই ছিল পাটায় বাটা। মরিচ, হলুদ, জিরা, ধনে, আদা সবই পাটায় বেটে নিতে হতো। প্রচুর ঝাল এবং প্রচুর মসলা দিয়ে রান্না করা হতো তরকারি। রাতেও প্রায় ওই একই রকম খাবারের প্রচলন ছিল। আমাদের ঘরে প্রায় সারা বছর দুধের ব্যবস্থা ছিল। আমরা কখনোই গোরু-ছাগল পোষতাম না। দরিদ্র পাড়াপ্রতিবেশী, যাদের দুধেল গাভী থাকত তারা সারা মাস এক সের করে দুধ দিত প্রতিদিন । মাস শেষে টাকা নিত। একে বলা হতো দুধ রোজ করা।
মাছের মৌসুম ছাড়া মাছ পাওয়া যেত না বললেই চলে। আর অধিকাংশ মানুষের হাতে নগদ টাকা থাকত না। ফলে বাজার থেকে মাছ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য খুব কম লোকেরই ছিল। ভর্তাবার্তি, পেঁয়াজ-মরিচ আর শাকপাতা দিয়ে ভাত খেয়ে দিন গুজরান করতে দেখেছি অধিকাংশ পাড়া-প্রতিবেশীকে।
বাজার থেকে মাছ, শাকসবজি ও তরিতরকারি কেনার প্রচলন কবে হয়েছে জানি না। তবে শৈশবে খুব কম মানুষকেই বাজার থেকে মাছ, শাকসবজি ও তরিতরকারি কিনে আনতে দেখেছি। সবারই ক্ষেতে বা বাড়ির আনাচে-কানাচে শাকসবজি হতো। ওই দিয়েই চলে যেত কোনো রকমে।
খুব মনে পড়ে, বামের বাজারে, আমিরা বাজারে কিংবা দাসের বাজারে আমি কোনো ফলের দোকান দেখিনি। গরীব লোকেরা নিজের গাছের আম, জাম, কাঁঠাল, তাল, বেল, ডেউয়া এইসব মৌসুমি ফল ওড়ায় বা ডালায় নিয়ে বাজারের কোনাকাঞ্চিতে বসত। দরদামে মিললে কেউ কেউ কিনে নিয়ে যেত।
এছাড়া মৌসুমি ফল, বিশেষ করে আম, জাম, বরুই বা কুল, পেয়ারা, লটকন, কামরাঙ্গা, খুঁদিজাম, পেঁপে, তেঁতুল এইসব ফল যখন ধরত তখন সেই কড়া থেকে শিশুরা খাওয়া শুরু করত। ডিল ছুড়ে, ছিপ দিয়ে কিংবা গাছে উঠে পারা হতো এইসব ফল। প্রচুর মরিচের গুড়া, লবণ, কখনো বিচি কলা, আঞ্চলিক নাম আইট্টা কলা এবং তার সঙ্গে তেঁতুল মিশিয়ে কাচা আমের ভর্তা, কাচা কলার ভর্তা, বরুইয়ের ভর্তা, চালতার ভর্তা এরকম নানান ফলের ভর্তা প্রায় সারা বছর খাওয়া হতো।
আমের দিনে প্রায় সকল শিশুর হাতে থাকত ছুরি বা ঝিনুকের কাটারি আর লবণ ও মরিচের গুড়ার মিশ্রণ। ছুরি বা কাটারি না থাকলে পরনের লুঙ্গি খুলে লুঙ্গির ভেতর আম রেখে গাছের সঙ্গে জোরসে আঘাত করা হতো। এতে আম ফাটত, লুঙ্গিও ফাটত। সেই ফাটা লুঙ্গি পরে পাছা দেখিয়ে হাঁটলে কপালে দুর্গতি ছিল। সুতরাং ওই ফাটা লুঙ্গি পরার কায়দা ছিল ভিন্ন। কিন্তু লুকিয়ে রাখা যায় কতক্ষণ? একসময় মা দেখতেন নতুন লুঙ্গী ছিঁড়ে খান খান। মা বলতেন “এই কালকুট্টা, করছচ কি লুঙ্গিরে! আওক তোর ঠায়ুর। দেহামু অনে। লুঙ্গি ছিড়ার মজা বুঝবি অনে।”
ওই ছিঁড়া লুঙ্গি বাবাকে কিন্তু কখনোই দেখাতেন না মা। বরং কখন যে লুঙ্গি সেলাই করে রেখে দিতেন টেরও পেতাম না। ছেঁড়াটা আড়াল করে পড়তে গিয়ে আর খুঁজে পেতাম না। লাল-সবুজের ডোরা কাটা লুঙ্গি লাল অথবা সবুজ সুতা দিয়ে এমনভাবে মা সেলাই করে দিতেন, কিছুতেই দেখা যেত না। আর বাবা যদি কখনো দেখে ফেলতেন তা হলে ওই আমের সিজনে লুঙ্গি পরা বন্ধ, পরতে হবে হাফ প্যান্ট।
বরুইর দিনে প্যান্টের পকেট ভর্তি কিংবা লুঙ্গির কোছর ভর্তি থাকত বরুই। আজকের মতো এমন বড় বড় কুল তখন ছিল না। দেশি বরুই। চুকা কিংবা মিষ্টি। ছাগলের মতো কুট কুট কামড় দিয়ে বরুইর মাংস খেয়ে বিচি ফেলে দিয়ে বরি খাওয়ার চেয়ে না খাওয়া ভালো। বিচিসমেত কটকট কটকট শব্দ করে শিশুরা যখন বরি খেতে খেতে হাঁটত তখন গ্রামের বৃদ্ধরা হা করে তাকিয়ে থাকত। এক দাদা বলতেন, “ওগ বিচি হালানোর সময় নাই। ব্যস্ত।”
জেঠা বলতেন, “বিচি হালাইলে খাইয়া মজা পায় না। এট্টু কম পইড়া যায়।”
বাড়ির আনাচে-কানাচে, বাগানে বা জঙ্গলে বিভিন্ন সময় নানা রকম ফল ফলত। বৈঁচি, গাব, কাউ, খুঁদিজাম, বেতফল, বিলিম্বি, চালতা, ডুমুর- এইসব। বনে-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে সারাক্ষণ এইসব খেতাম আমরা। বিশেষ করে ডুমুর, কাউ, পাকা গাব ছিল আমাদের খুবই প্রিয়। আর বেতুম বা বেতফল ছিল সবচেয়ে বাজে। একটি ফলের গায়ে মাংস এত কম নিয়ে কী করে এটি ফল হলো তাই আশ্চর্য।
ছিপটির ডাল দিয়ে যে মসজিদে, মাদরাসায় ও স্কুলে শুধু পিটুনি দেওয়া হতো তা নয়, এই গাছে খুঁদি জামের মতো ফলও হতো। ওই ফল আমরা খেতাম। আরও একটি গাছের নাম ভুলে গেছি। ছোট গাছ, গুল্ম জাতীয়। দাঁত মাজার জন্য ওই গাছের ডাল ব্যবহার করা হতো। ওতেও খুব ছোট ফল ধরত। টক আর মিষ্টির মাঝামাঝি চমৎকার স্বাদ ছিল।
বর্ষাকালে নৌকা করে আমিরা বাজার বা দাসের বাজার থেকে বাব ও চাচারা যখন ইলিশ মাছ এবং কাঁঠাল নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে আসতেন তখন উৎসব শুরু হতো বাড়িতে। মতলব নিম্নাঞ্চল বিধায় কাঁঠাল হতো না এবং চাঁদপুর ইলিশের জন্য বিখ্যাত হলেও গ্রামীণ জীবনে ইলিশ ছিল দুষ্প্রাপ্য মাছ। সুতরাং পুরো সিজনে আমরা আট-দশটি কাঁঠাল খাওয়ার সুযোগ পেতাম।
এ ছাড়া সারা বছর চাল ভাজা, খুদ ভাজা, ডাল ভাজা, মুড়ি বা উরুম, মুড়ির মোয়া, চিড়া ভাজা, চিড়ার মোয়া, কাউন ভাজা, কাউনের মোয়া, সিম ভাজা, গম ভাজা, মটর ভাজা ইত্যাদি চলত।
মাকে দেখতাম প্রতিদিন রান্নার চাল নেওয়ার সময় একমুঠ চাল পানি ভরা মাটির হাড়িতে ফেলে দিতেন। বেশ কয়েক দিন পরে ওই চাল দিয়ে জাউ রান্না করতেন। ওর নাম ছিল কাঞ্জির সিন্নি। স্বাদ চুকা। লাল মরিচের ভর্তা কিংবা শুটকি ভর্তা ছাড়া কাঞ্জির সিন্নি খাওয়া যায় না। শুনেছি গায়ে ব্যথা থাকলে কাঞ্জির সিন্নি খেলে ভালো হয়ে যায়। আমরা যেসব ব্যথা পেতাম- পড়ে গিয়ে ব্যথা, মারামারি করে ব্যথা, ধরতে গিয়ে ব্যথা, ছাড়তে গিয়ে ব্যথা, আনতে গিয়ে ব্যথা, নিতে গিয়ে ব্যথা, টানাটানি করতে গিয়ে ব্যথা, উঠতে গিয়ে ব্যথা, নামতে গিয়ে ব্যথা ওইসব ব্যথা ভালো হতো বলে মনে হয় না। ভালো না হলেও কিছু যেত-আসত না।
সত্তর-আশির দশকে গ্রামীণ জীবনে শিশুদের যে খাবারের কথা উল্লেখ করা হলো তাকে পর্যাপ্ত ও পরিমিত ভাবার কোনো করণ নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত খাবার ছিল না এবং যেসব খাবার পর্যাপ্ত ছিল সেগুলো পরিমিত পরিমাণ খাওয়া হতো না। এর সঙ্গে ছিল প্রচুর পরিমাণ ঝাল ও টক খাওয়ার বিষয়। আবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষিত হতো না। ফলে অধিকাংশ সময় শিশুদের পেট খারাপ থাকত।
খুব ছোট বেলায় গ্রামে টিউবওয়েল দেখিনি। আমাদের বাড়িতে টিউবওয়েল বসানো হয় আশির দশকে। বাড়ির দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার পাশে ছিল ওই টিউবওয়েল। পাঁচ-ছয়টি বাড়ির রান্না ও খাবারের পানির সংস্থান হতো ওই একমাত্র টিউবওয়েলের জলে। আর যারা ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত, টিউবওয়েলটার কাছে এলেই তাদের হাত-মুখ ও পা ধোয়ার কথা মনে হতো। বিচিত্র মানুষের বিচিত্র কায়দায় কল চাপতে হতো বিধায় অধিকাংশ সময় কলটি নষ্ট থাকত। কখনো কখনো পানি দিয়ে পানি বের করতে হতো। এই দিগদারি সহ্য হতো না বলে পুকুরে পানি এবং খালের পানিই ছিল খাবার ও রান্নাবান্নার পানি। ফলে সত্তর ও আশির দশকে দেখেছি ছোট-বড়, শিশু, কিশোর, জুয়ান, বৃদ্ধ সবারই নানা রকম পেটের অসুখ। কখনো কখনো ডাইরিয়া, কখনো আমাশয় লেগেই থাকত।
সব বাড়ির পেছনে একাধিক খোলা টয়লেট ছিল। আমাদের এলাকায় বলত টাটকি। বাঁশ কুপে আড়াআড়ি বেঁধে আর একটি বাঁশ দিয়ে সাঁকোর মতো টয়লেট। নিচে সম্পূর্ণ খোলা। কলার ডগা, সুপারির ডগা, ধানের নাড়া কিংবা চট দিয়ে বেড়ার কাজ সাড়া হতো। দরজা হিসেবে ব্যবহৃত হতো পাটের চট বা ছালা। সাধারণত খালে, বিলে, পুকুরে, ডোবায় গিয়ে পড়ত মনুষ্য বিষ্টা। এই ধরনের ফর্মাল ও চিরস্থায়ী টয়লেট ছাড়াও অনেক স্থায়ী ও আস্থাী টয়লেট তৈরি হয়ে যেতো যেখানে-সেখানে।
খুব ভোরে জঙ্গলে, খালে, বিলে, নর্দমায়, ডোবায়, ক্ষেতে, খামারে, একটু আড়ালে-আবডালে চলত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কাজ। বর্ষাকালে পুরুষেরা এবং ছেলেছোকড়ারা নৌকা নিয়ে চলে যেত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। শিশু-কিশোররা গাছের ডালে বসে মজা করে কাজ সাড়ত। অনেক সময় একজনে নয়, কয়েকজনে একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে কাজ শেষ করত এবং ওই পানিতেই ঝাপিয়ে পড়ত। আর শিশু-কিশোররা প্রায় যেখানে-সেখানে কাজ সেড়ে ফেলত। বিশেষ করে গাছের শিকড়ে বসে, গোড়ায় বসে, গর্তের কিনারে বসে, রাস্তায়, রাস্তার পাশে, এককথায় যত্রতত্র। ফলে মনুষ্য বিষ্টায় পা নষ্ট হওয়া ছিল নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার।
পায়খানা শেষে পরিষ্কার হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পানি সহজলভ্য ছিল না। এক বদনা মানে এক লিটারও নয়। ওই পানি দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পরিষ্কার হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তারপর ভালো করে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ও সচেতনতাও ছিল না। আর শিশু-কিশোররা পরিষ্কার হওয়ার জন্য নেমে যেত খালে, বিলে, পুকুরে, ডোবায়। কিন্তু সেই সুযোগ সবসময় থাকত না। তখন ব্যবহার করত মাটির ডিলা, শুকনো কচুরিপানার শিকড়-বাকর কিংবা তারও যদি ব্যবস্থা না থাকত তা হলে গাছের সঙ্গে বা জমির আলের সঙ্গে কিংবা উঁচু মাটির মসৃণ জায়গাটুকুতে একটু লেছুড় দিয়ে নিত।
আমার মনে হয় শুধু সত্তর-আশির দশক নয়, শত শত বছর এদেশের মানুষের মুত্র ত্যাগ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয় এমনই ছিল। আর যদি শুধু প্রস্রাব করার বিষয় বিবেচনা করা হয়, তা হলে সেখানে কোনো বিবেচনার বিষয় ছিল না বললেই চলে। বিশেষ করে ছেলেদের প্রস্রাব করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থান ছিল না। ঘর থেকে বের হয়ে যেখানে-সেখানে তারা প্রস্রাব করার অধিকার রাখত। আর রাতের বেলা নারীপুরুষ নির্বিশেষে এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত।
সেই সময় দেখেছি, চাল, ডাল, মাছ, তরিতরকারি, শাকসবজি সবকিছু ধোয়া হতো পুকুর, খাল, বিল ও ডোবার জলে। ওই জল খাওয়াও হতো। শত শত বছর ধরে এদেশের মানুষ এমন অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করে এসেছে। ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় কতগুলো রোগ কোনো দিনই এদেশের মানুষের পিছু ছাড়েনি।
ছোট বেলায় দেখেছি, ডায়রিয়া লেগেই থাকত। ছোটবড় সবারই ডায়রিয়া হতো। কেউ কেউ মারাও যেত। মতলবে icddr, b আছে। বর্ষকালে ওই অফিসের স্পিডবোটগুলো বামের বাজারে ভিরানো থাকত। কোনো বাড়িতে ডায়রিয়ার রুগী আছে জানতে পারলে স্পিডবোটে করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতো। একবার হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলে আর কেউ মারা গেছে বলে শুনিনি। আমাকেও একবার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। স্পিডবোটে উঠে আমি এত মজা পেয়েছিলাম যে, মাঝেমধ্যে মনে হতো আবার কেন ডায়রিয়া হয় না। কিন্তু ডায়রিয়া হয়ে আমার এক জেঠা আমাদের চোখের সামনে মারা গিয়েছেন। রাজ্যের মানুষ দেখল। মুখে এক ফোটা পানি দিতে দেয়নি কেউ। অনেক কষ্ট পেয়ে জেঠা মারা গেলেন। তারপর থেকে আর ডায়রিয়া হয়ে স্পিডবোটে উঠার ইচ্ছা হয়নি।
আমাশয়ও ছিল ঘরে ঘরে। ছিল জলবসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডিপথেরিয়া, ম্যালেরিয়া আর হুপিংকাশি। আরও ছিল পোলিও, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড।
শিশুকিশোরদের কৃমি সংক্রান্ত অসুখ ছিল প্রায় ঘরে ঘরে। কত রকমের কৃমি : গুড়া কৃমি, ফিতা কৃমি, সুতা কৃমি, গোল কৃমি, হুকওয়ার্ম। পেট ব্যাথা হলে, ঘুমানোর সময় মুখ থেকে লালা পড়লে, অতিরিক্ত মিষ্টি খেতে চাইলে, পায়ুপথ চুলকালে বাবা বুঝতেন পেটে কৃমি হয়েছে। হোমিও ডাক্তার মান্নান দাদার দোকানে আড্ডা দিতে বসে বাবা ডাক্তার হয়ে উঠেছিলেন। বাবা ঔষধ নিয়ে আসতেন। কিন্তু যখন-তখন ওই ঔষধ খাওয়া যেতো না। বৃষ্টিবাদলের দিনে কিংবা পরিবেশ কিছুটা ঠান্ডা হলে কৃমির ঔষধ সেবন করতে হতো। তখন সংসারের সবাই খেতাম।
ঘুমাতে গেলে যদি গুড়া কৃমির অত্যাচার শুরু হতো তখন মা পায়ুপথে কেরোসিন তেল লাগিয়ে দিতেন। বাবা বলতেন ওরা নাকি ডিম পারতে পায়ুপথের দিকে আসে।
চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর কিছুতেই পায়খানা করতে পারছিল না। কেচোর মতো কী একটা ওর পায়ুপথ থেকে বের হয়ে আছে। দেখলাম, চাচি পায়ুপথ থেকে টেনে ওই কৃমি বের করে আনছেন।
সেই সময় দেখেছি, ছোট ছেলে-মেয়েদের শরীরে খোস-পাঁচড়া হতো। আঙ্গুলে, আঙুলের ফাঁকে, হাতে, হাতের কবজিতে, পায়ে, নাভিতে, নাভির চারপাশে, যৌনাঙ্গে, পশ্চাৎদেশে খোসপাঁচড়ায় ভরে যেত। প্রচণ্ড চুলকানি হতো। বিশেষ করে রাতের বেলায় চুলকানির জন্য ঘুমানো যেত না।
নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের জন্য এই রোগ হতো। মাকে দেখেছি, চাচি-জেঠিদের দেখেছি, আম পাতা, জাম পাতা, নিম পাতা দিয়ে পানি গরম করে ওই পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিতেন। এতে চুলকানি কমে যেত এবং গোটা থেকে কস বের হওয়াও অনেকাংশে কমে যেত।
এছাড়া কারো কারো শরীরে ছুলি এবং দাদ হতেও দেখেছি। খুবই বিশ্রী অসুখ। মারাত্মক ছোঁয়াচে। শরীরের কোথাও একটু জায়গায় হতো তার পর ছড়াতে থাকত। প্রচণ্ড চুলকানি হতো। অসহ্য।
কারো কারো হতো ফোড়া। ফোড়া হলে নাকি জমিতে ধান বেশি হয়। ধান বেশি হয় কিনা জানি না, কিন্তু ফোড়ার যন্ত্রণা যে কত ভয়াবহ তা জানি, হাড়ে হাড়েই জানি। ফোড়ার চারদিকে চুন দিয়ে দেওয়া হতো। চুন দিলে নাকি ফোড়া দ্রুত পেকে যায়। একসময় আপনজনেরা ফোড়া গলিয়ে দিতেন। তখন জান বেরিয়ে যাওয়ার দশা। কখনো কখনো ছিদ্রটার মধ্যে কাপড়ের সলতা বসিয়ে দেওয়া হতো। ওই সলতা দিয়ে দুষিত রক্ত বের হয়ে যেত।
আবার বর্ষাকালে কাদার মধ্যে হেঁটে হেঁটে অনেকের পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে পচন ধরত। নোখের কোনাকানচিতেও ঘা হতো এবং সেখান থেকে পুচ বা কস বের হতো। খুবই দুর্গন্ধযুক্ত কস। এসবের জন্য কাউকে কোনো ঔষধ সেবন বা ব্যবহার করতে দেখিনি কখনোই। শুধু ওই এক ঔষধ-নিমপতা মিশ্রিত গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখা। এতেই নাকি একটু আরাম হতো।
ম্যালেরিয়া ও টাইফয়েড হতো ঘরে ঘরে। ঔষধ হলো মাথায় পানি ঢালা। কিন্তু দিনের পর দিন, সপ্তাহর পর সপ্তাহ কত পানি ঢালা যায়! সুতরাং মাথার উপরে মাটির কলসি ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। পানির কলসির নিচে ফুটো করে কাপড়ের সলতা বানিয়ে দেওয়া হতো। ওই সলতা বেয়ে সারাক্ষণ কপালে ও মাথায় পানি পড়ত। মাঝেমধ্যে শুধু কলসিতে পানি দিয়ে রাখলেই হতো।
ছেলে-মেয়ে সবার মাথায়ই উকুন হতো। বিশেষ করে মেয়েদের মাথাভর্তি উকুন থাকত। মেয়েরা সারি হয়ে বসে একজনের মাথার উকুন আরেকজন এবং তার মাথার উকুন অন্যজনে পরিষ্কার করত আর গল্প করত আর বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখের উপর উকুন রেখে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখ দিয়ে চেপে পুটুস পুটুস শব্দ করে মারত।
আমি সবসময় বড় বড় চুল রাখতে পছন্দ করতাম। আর চুলে অনেক উকুন হতো। মা, বড় আপা, তাহমিদা আপা এবং রহিমা আপা আমার মাথার উকুন বেছে দিত। তখন কি যে ভালো লাগত। আরামে চোখে ঘুম চলে আসত। এখন খুব দুঃখ। মাথায় উকুন হয় না। মাথায় হাতও দেয় না কেউ। আহারে সুখের জীবন!
ঘরে ঘরে হতো ছারপোকা। খাট ও চকির ফাটলে এবং ফাঁকফোকরে, কাঁথায়, লেপ-তোশকে ছারপোকা হতো। ছারপোকার যন্ত্রণায় সারা রাত ঘুমাতে পারত না গ্রামের লোকজন। খাট-চকি পুকুরে ফেলে রাখতেও দেখেছি। কয়েকদিন ফেলে রাখার পর উঠিয়ে এনেছে। কিন্তু তেমন কোনো লাভ হয়নি। কিছু দিন পরেই দেখা যেত, যেই লাউ সেই কদু।
সেই সময় ডাক্তার বলে তেমন কেউ ছিলেন না। এখন নয়া বাজারে যে প্রাণকৃষ্ণ ডাক্তার আছেন, তাঁর বাবা রামকৃষ্ণ দাদা এবং উপেন্দ্র চাচা ছিলেন দশ গ্রামের ডাক্তার। যতটা মনে পড়ে, তাদের কোনো চেম্বার বা দোকান ছিল না। বামের বাজারে তাদের কোনো দোকান ছিল কি না, এখন আর মনে পড়ছে না। নম-সানকিভাঙ্গা ছিল তাদের বাড়ি। তারা গ্রামে ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা করতেন। আবার কারো জরুরি প্রয়োজন হলে তাদের বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে আসতে পারতেন।
তারা কাচের বোতলের মধ্যে চুন দিয়ে তার উপর দাগ দিয়ে দিতেন। দাগ পরিমান ঔষধ প্রতিবার খেতে হবে। কখনো কখনো বোতলে কাগজ লাগিয়ে দিতেন। ওই কাগজ এমনভাবে কাটা হতো যাতে পাশে তীর চিহ্নের মতো কাটা থাকত। প্রতিবার ওই তীর চিহ্ন সমান ঔষধ সেবন করতে হবে। কখনো কখনো কাগজে প্যাচিয়ে বরি দেওয়া হতো।
তারা ছিলেন সব রোগের চিকিৎসক। মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, জ্বর, সর্দি, কাশি, আমাশয়, ডায়রিয়া, খোস-পাঁচড়া, কাটা-ছেড়া সব রোগেই তারা চিকিৎসা দিতেন।
খুব মনে পড়ে, আশির দশকের গোড়ার দিকে। আমার জেঠা করিম মাস্টারের গলায় ব্যথা। বেশ কয়েক দিন ধরে ব্যথা। ঔষধ দরকার। বিলে তখন আঠাই পানি। ওই পানি সাঁতরিয়ে গিয়েছিলাম রামকৃষ্ণ দাদার বাড়িতে। ঔষধ নিয়ে আসি। জেঠা ঔষধ সেবন করেন, কিন্তু ব্যথা সারে না। পরে দাদা বললেন, অবস্থা সুবিধার ঠেকছে না। ঢাকা নিয়ে যাও।
ঢাকা নিয়ে যাওয়ার পর জানা গেল, করিম মাস্টার জেঠাজির ক্যান্সার হয়েছে এবং কয়েকদিন পরে তিনি মারা যান। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, জেঠাজির যে ক্যান্সার হয়েছে রামকৃষ্ণ ডাক্তার সেটা বুঝতে পেরেছিলেন।
বামের বাজারে ছিল মান্নান দাদার হোমিও দোকান। মান্নান দাদার বাড়ি ফরাজি কান্দী। মান্নান দাদাকে বাবা সম্বোধন করতেন চাচা বলে। আমরা যখন ছোট তখন তিনি বৃদ্ধ ছিলেন এবং আমরা যখন প্রায় বৃদ্ধ তখনোও তিনি বৃদ্ধই আছেন। আজই খোঁজ নিয়ে জানলাম, মাস পাঁচ-ছয়েক আগে তিনি মারা গেছেন। সারাক্ষণ হাসিখুশী দাদা আমাকে খুব স্নহ করতেন। আমাকে বলতেন মিতা। ছোটখাটো অসুখে তিনি আমাদের ঔষধ দিতেন। অসুখ ভালো হতো কি না জানি না। কিন্তু ওই মিষ্টি ঔষধ খাওয়ার জন্য আমরা অস্থির হয়ে উঠতাম। বাজারে গেলেই আমরা দাদার দোকানে বসতাম আর দাদা আমাদের ঔষধ খাওয়াতেন।
স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য একবার দাদা আমাকে ঔষধ দিয়েছিলেন। স্মৃতিশক্তি বেড়েছে কি না জানি না, কিন্তু আমার নিজের ছোট-বড় ভাই-বোনেরা এবং চাচাতো-জেঠাতো ভাই-বোনেরা আমাকে খুব করে ধরেছিল। অপরাধ হলো, আমি একা কেন বাজারে গিয়ে মনে রাখার ঔষধ খেয়ে এসেছি। ওদের জন্য কেন আনিনি। আমি নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে স্মৃতিশক্তির ঔষধ খাই। এই জন্যই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাই, ইত্যাদি।
বাবা পর দিন মান্নান দাদার কাছ থেকে স্মৃতিশক্তির অনেক ঔষধ নিয়ে আসেন এবং স্কুলে পড়ুয়া বাড়ির প্রায় সবাইকে সেই ঔষধ খেতে দেন। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষার ফল আগের মতই হয়েছে, কারোরই ভালো হয়নি। ওই দোষও আমার ঘাড়েই বর্তিয়েছিল। আমি নাকি আসল ঔষধ খেয়েছি আর ওরা খেয়েছে নকল ঔষধ।
গ্রামের কেউই তখন জুতা, স্যান্ডেল, পঞ্চ, চটি পরত না। বাবা এক ধরনের প্লাস্টিকের কালো জুতা পরে হাটবাজারে যেতেন, বিচার-আচারে যেতেন।
আমরা সারাদিন খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার পর পরই পা ধুয়ে আমাদের খড়ম পরতে হতো। কাঠের উপর পেরেক দিয়ে টায়ার লাগানো খড়ম। আর বইলা লাগানো খড়ম পরতেন বৃদ্ধরা। ওই খড়ম পরে হাঁটা খুব কষ্টকর ছিল। টায়ার লাগানো খড়ম বা বইলা লাগানো খড়ম যাই হোকনা কেন নষ্ট হওয়ার কোনো আশঙ্কা ছিল না। কোন খড়ম কবে কেনা হয়েছে তার কোনো ইতিহাস নেই। এ অনেকটা বংশানুক্রমে ব্যবহারের মতো।
গ্রামের দরিদ্র পরিবারের কেউই জুতা, স্যান্ডেল, খড়ম কিছুই পরত না। এমনকি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও পা ধোয়ার বিষয় ছিল না। বস্তায় বা কাপড়ে পা মুছে শুয়ে পড়ত।
রাতে অলোর জন্য কুপি বা হারিকেনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু অধিকাংশ ঘরেই ঘণ্টাখানেকের বেশি কুপি জ্বালিয়ে রাখা হতো না। যে ঘরে ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করত সে ঘরেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কুপি-হারিকেন জ্বলত।
এই বিপুল অস্বাস্থ্যকর গ্রামীণ জীবনে আমাদের বাড়ির কয়েকটি পরিবার ছিল কিছুটা ভিন্ন রকম। আমার বাবা আবদুল হাকিম সরকার স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন এবং দশ গ্রামে বিচার-আচার করতেন। পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনের জন্য তিনি বিচিত্র আইন-কানুন ও বিধিনিষেধ জারি করতেন। এবং কোনো বিধি-নিষেধই তিনি জোর করে আরোপ করতেন না। কী করলে কী হবে, কীভাবে করতে হবে, কখন করতে হবে ইত্যাকার যাবতীয় বিষয় তিনি আমাদের বুঝিয়ে বলতেন এবং নিজে পালন করতেন।
মা ছিলেন আরও এক কাঠি সরেস। তিনি খুব সুন্দরী ছিলেন এবং গ্রামীণ জীবনে নারীদের বিপুল এক কর্মজজ্ঞে উদয়াস্ত ব্যস্ত থাকার পরেও তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতেন। দুটি উদাহরণ দিই।
ভাত খাওয়ার সময় আমার হাতের বেশ উপরে উঠে যেত ভাত। মা-র কথা হলো, হতের তালুতে ভাত লাগতে পারবে না। কিন্তু আমার হাতের তালুতে তো লেগে যেতই, আরও উপরেও উঠে যেত। মা মাঝেমধ্যেই আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন, “তোর আতের কী অবস্থা? গোরুর মতন খাইতেছস কিলিগা। ভালা কইরা খা কইলাম।”
সেই সময় কাঠের চামিচ ছিল, কাঠের খুন্তি এবং নাড়ানি ছিল। এমনই একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় মা আমার হাতের দিকে চেয়ে ভীষণ রেগে গেলেন, “কী খাস। জানোয়ারের মতন খাইতেছস কিলিগা?” বলেই হাতে থাকা কাঠের খুন্তি দিয়ে আমার হাতে এক ঘা লাগিয়ে দিলেন। সেখানেই শেষ নয়। আমাকে বললেন “উঠ। তোর খাওয়ার দরকার নাই।” বলে আমার সামনে থেকে থালাটা নিয়ে নিলেন। ওইদিন দুপুরে আমি অভুক্ত ছিলাম। অনেকবার মাকে অনুরোধ করেছিলাম। মা আমাকে খেতে দেননি। বলেছেন, “তোর আক্কেল অওন দরকার।”
আমার ভালোই আক্কেল হয়েছিল। এক জীবনে ওই শাস্তির কথা কখনোই ভুলিনি এবং পরিচ্ছন্নভাবে খাওয়ার কথাও ভুলিনি।
খুব ছোট বেলায় দেখেছি, আমাদের ঘরে লোহার একটি ইস্ত্রি ছিল। চুলার তাওয়ার উপর রেখে গরম করে কাপড় ইস্ত্রি করা হতো। কিন্তু কী করে যেন এক সময় ইস্ত্রিটি হারিয়ে যায়। এখন জামাকাপড় ইস্ত্রি করা হবে কীভাবে? মা কাসার বাটিতে গরম পানি নিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করে দিতেন। কখনোই আমরা ভাজপড়া সার্ট পরে স্কুলে যাইনি।
প্রায় চল্লিশ বছর পেরিয়ে এসে আজ যখন পিছন ফিরে তাকাই তখন মনে হয় কী জীবন আমরা যাপন করেছি! স্বাস্থ্যকর খাবারের কোনো ধারণাই মানুষের মধ্যে ছিল না। মলত্যাগ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল মানবেতর। চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে কোনো বিষয়ও তখন ছিল না। ঝাড়ফুক, তাবিজ-তুমার, হাতুড়ে ডাক্তার এইসবের মধ্যেই ছিল মানুষের আশ্রয়। এখন সেই গ্রামের চিহ্নমাত্রও নেই। ঝাড়ফুক, তাবিজ-তুমার এবং হাতুড়ে ডাক্তার এখনো আছে। কিন্তু সর্বময় অস্তিত্ব নিয়ে বহালতবিয়তে নেই। এখন সময় এসেছে, মানুষের শুভ বুদ্ধির বিজয় পতাকা উড়ানোর।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
























